নিছক প্রহরীর সংখ্যা বাড়িয়ে সুরাহা সম্ভব নয়।
তাই রাতের কলকাতায় মহিলাদের নিরাপত্তার সঙ্কট ও রাজপথে মোটরসাইকেল বাহিনীর দাপাদাপি শহরে একের পর এক ঘটনায় চাপের মুখে পড়ে এ বার নড়ে বসতে চাইছে লালবাজার। বেয়াদপ দু’চাকাকে চিনে রাখতে শুক্রবার রাত থেকে মোড়ে-মোড়ে যেমন ভিডিও ক্যামেরাধারী পুলিশ মোতায়েন হয়েছে, তেমন ফোনে সাহায্যপ্রার্থী মহিলাকে প্রাথমিক ভরসা জোগানোর তালিম দিতে লালবাজারে এসেছে কলসেন্টার। তবে এই সব প্রয়াস কত দূর ফলপ্রসূ হবে, অতীত অভিজ্ঞতা ও পরিকাঠামোর সীমাবদ্ধতার পরিপ্রেক্ষিতে সে সংশয় ইতিমধ্যে মাথা চাড়া দিয়েছে পুলিশেরই কিছু মহলে।
লালবাজার-সূত্রের খবর: কলকাতা পুলিশের উইমেন্স হেল্পলাইনে (১০৯১ নম্বরে) আসা ফোনগুলো ধরে আন্তরিক ভাবে কথা বলার ‘সফ্ট স্কিল’ কলকাতা পুলিশকে রপ্ত করাবেন বিপিও বা কলসেন্টারের কর্মীরা। বর্তমান অবস্থায় এ ক্ষেত্রে যে কিছুটা খামতি রয়ে গিয়েছে, লালবাজারের শীর্ষ কর্তারা তা স্বীকার করে নিচ্ছেন। শহরের বুকে একাধিক ঘটনায় পুলিশি তৎপরতার অভাব এবং অসংবেদনশীল ব্যবহারের বিষয়টি সামনে এসেছে। কলকাতা পুলিশ তাই নিয়ে লাগাতার সমালোচনার মুখে পড়েছে। তাই ঠেলায় পড়ে কতকটা বাধ্য হয়েই এখন তাঁরা কিছু রদবদলের কথা ভাবছেন। |
“এক জন মহিলা যখন বিপদে পড়ে সাহায্য চাইছেন, তখন তাঁর সঙ্গে এমন ভাবে কথা বলা উচিত, যাতে তিনি আশ্বস্ত হন, ভরসা পান। এখানে গতানুগতিক পুলিশি ঢঙে কথা বললে হবে না। অথচ অনেক সময়ে সেটাই হচ্ছে।” আক্ষেপ করেছেন এক অফিসার। হেল্পলাইনের পুলিশকর্মীদের সেই যথাযথ ও পরিশীলিত আচরণেরই প্রশিক্ষণ দেবে বিপিও। কর্তারা জানিয়েছেন, আগামী দু’সপ্তাহ বিপিও-র পুরুষ-মহিলা কর্মীরা কন্ট্রোলে বসে ১০৯১-এ আসা কল ধরবেন। তাঁরা কী ভাবে কথা বলছেন, কী ভাবে কথা শুনছেন এবং কী ভঙ্গিতে সমাধান বাতলাচ্ছেন, কন্ট্রোলের পুলিশকর্মীরা তা হাতে-কলমে শিখবেন। পরে পুলিশকর্মীদের বিপিও-য় তালিম নিতে পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে। একটি বিপিও-র আট-দশ জন কর্মী এ দিনই লালবাজার কন্ট্রোলে কাজ শুরু করে দিয়েছেন। পাশাপাশি কর্তাদের সিদ্ধান্ত, ১০৯১-এ কোনও বিপন্নের ফোন এলে তাঁকে পুলিশের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়ার বদলে পুলিশই তাঁর কাছে পৌঁছে যাবে।
তবে ঘটনা হল, পরিষেবা উন্নয়নের লক্ষ্যে অন্য পেশার সহায়তা লালবাজার আগেও নিয়েছে, অনেক সময়ে রীতিমতো ঢাকঢোল পিটিয়ে। কিন্তু শেষমেশ তা ধরে রাখা যায়নি। যেমন, ২০০৯-এর জুলাইয়ে আইআইএমের প্রাক্তনীরা কলকাতা পুলিশের শ’খানেক অফিসারকে নিয়ে কর্মশালা করেছিলেন। কর্মশালার সুপারিশ ছিল, চাকরিতে ঢোকার সময়ে নিয়মমাফিক তালিমের সঙ্গে সঙ্গে পুলিশকে মানসিক চাপ কাটানোর কৌশলও শেখানো হোক। থানায় থানায় খোলা হোক যোগাভ্যাস ও বিনোদনকেন্দ্র। পুলিশ-সূত্রের খবর: সুপারিশ মেনে প্রতি থানায় দ্বিতীয় একটি অতিরিক্ত ওসি-র পদ সৃষ্টির প্রস্তাবও স্বরাষ্ট্র দফতরে পাঠানো হয়। কিছুই কার্যকর হয়নি।
আবার প্রবীণদের দেখভালের ‘প্রণাম’ প্রকল্পকেও এই ব্যর্থতার উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরছে পুলিশের একাংশ। একা থাকা বৃদ্ধ, বৃদ্ধা কিংবা প্রবীণ দম্পতির ‘ডেটাবেস’ সংগ্রহ ও তাঁদের সহায়তার লক্ষ্যে কলকাতা পুলিশ প্রকল্পটি চালু করে ২০০৮-এ, এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হাত ধরে। এখনও সেটি চালু রয়েছে বটে, তবে স্রেফ নাম-কা-ওয়াস্তে। একা থাকা বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা বিভিন্ন অপরাধের শিকার হয়েই চলেছেন।
এ হেন অভিজ্ঞতার প্রেক্ষাপটে নতুন উদ্যোগটির ভবিষ্যৎ নিয়েও সন্দিহান পুলিশের একাংশ। তাঁদের বক্তব্য, ভিন্ন ধরনের মানসিক গঠনের অধিকারী পুলিশকর্মীরা বিপিও-বিদ্যে কতটা রপ্ত করতে পারবেন, করলেও বাস্তবে কত দিন পর্যন্ত তা প্রয়োগ করবেন, সে সব এখনই বলা শক্ত। একই ভাবে রাস্তায় ভিডিও-বাহিনী মোতায়েনের কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। কী রকম?
লালবাজারের সিদ্ধান্ত, মহানগরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে ভিডিও-ক্যামেরাধারী পুলিশ রাখা হবে। আট-দশটি টিম থাকবে। কর্তাদের আশা, রাতের অন্ধকারে তীব্র গতিতে ছুটে যাওয়া বেপরোয়া মোটরবাইক বা গাড়িকে সঙ্গে সঙ্গে ধরা না-গেলেও ক্যামেরায় ওঠা নম্বর দেখে পরের দিন আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। পথে নারী নিগ্রহের ঘটনায় ভিডিও ফুটেজ দেখে দুষ্কৃতীদের চিহ্নিত করা যেতে পারে। এখানে প্রশ্ন উঠছে, ভিডিও ক্যামেরায় গাড়ির নম্বর আদৌ ধরা পড়বে কি না। “অধিকাংশ ক্যামেরার জুমিং তেমন শক্তিশালী নয়। অন্ধকারে ইমেজ আইডেন্টিফিকেশনও নিখুঁত হয় না। ক্যামেরায় পুলিশকর্মীরা সাধারণ ছবি তুলতে পারলেও দ্রুত গতিতে ছুটে যাওয়া গাড়ি বা মোটরবাইকের নম্বর কতটা নিতে পারবেন, বলা যাচ্ছে না।” মন্তব্য এক অফিসারের।
আর এ ক্ষেত্রেও আসছে পুলিশকর্মীদের মানসিক গঠনের প্রসঙ্গ। অভিযোগ, দু’চাকায় হেলমেটহীন আরোহী কিংবা এক বাইকে তিন-চার সওয়ারকে (অনেক ক্ষেত্রেই যারা মহিলাদের উত্যক্ত করে থাকে) দেখেও পুলিশ হামেশা নীরব দর্শক হয়ে থাকে। ওই সব পুলিশকর্মীর মানসিক গঠন কী ভাবে বদলাবে? |
লালবাজারের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, “আমরা ইতিমধ্যে পুলিশকর্মীদের সচেতন করার কাজ শুরু করেছি। আইন ভঙ্গকারী ও অভব্য আচরণ করা ওই সব মোটরবাইক আরোহীদের থামানোর মতো পরিস্থিতি সব সময়ে না-থাকলেও বলা হয়েছে মোটরবাইকের নম্বর নিয়ে রাখতে। যাতে পর দিন নম্বর ধরে ব্যবস্থা নেওয়া যায়।” কর্তাটি জানাচ্ছেন, কলকাতার রাস্তায় আপাতত শ’আড়াই ক্লোজ্ড সার্কিট ক্যামেরা রয়েছে। পুজোর আগে আরও পাঁচশো ক্যামেরা বসতে পারে। নতুন ক্যামেরাগুলোয় থাকবে ইনফ্রা-রেড সেন্সর, যাতে কম আলোতেও বাহনের নম্বরপ্লেটের স্পষ্ট ছবি ধরা পড়ে। লালবাজারের এক উচ্চ কর্তার ঘোষণা, “আমরা স্থায়ী ভাবে এমন পুলিশি ব্যবস্থা চালু করতে চাইছি, যাতে রাতের কলকাতা শহরবাসীর কাছে নিরাপদ হয়ে ওঠে।”
সেই মতো ভিডিও-টিম এ দিন কাজে নেমেছে। এ দিন থেকেই ডিসি-রা এবং থানার ওসি বা অতিরিক্ত ওসি রাত দু’টো পর্যন্ত রাজপথে থাকছেন। তাঁরা নজর রাখবেন, কিয়স্কে পুলিশ আছে কি না, থাকলেও তারা ঠিকঠাক কর্তব্য পালন করছে কি না। সঙ্গে থাকছে গোয়েন্দা বিভাগের বিশেষ দল। আগামী এক মাস এই ব্যবস্থা চলবে বলে লালবাজারের খবর।
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, সারা দিন কাজ করার পরে রোজ রাত দু’টো পর্যন্ত ডিউটি ওসিরা কত দিন টানতে পারবেন? তা ছাড়া গভীর রাতে নিজের থানা-এলাকার অন্যান্য সমস্যা ছেড়ে পথের নজরদারি করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হবে কি না, তা নিয়েও সংশয় পুলিশমহলের একাংশের।
সংশয় ভুল কি না, সময়ই বলবে। |