চার জামিন অযোগ্য ধারা দিলেন বিচারকই
যে কাজ করার কথা ছিল পুলিশের, সেটা করতে হল আদালতকে। আর তার জেরে আরও প্যাঁচে পড়লেন বীরভূম জেলা তৃণমূল সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল।
প্রকাশ্য সভায় উস্কানিমূলক মন্তব্য করার দায়ে অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে পাড়ুই থানাকে শুক্রবার জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা করার নির্দেশ দিলেন সিউড়ির মুখ্য বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট (সিজেএম) রাজেশ চক্রবর্তী। শুধু তা-ই নয়, কোন কোন ধারায় পুলিশ ওই মামলা করবে, তা-ও জানিয়ে দেন সিজেএম। আইনজীবীরা জানাচ্ছেন, অনুব্রতকে গ্রেফতার করতে হলে পুলিশকে আর আদালতের অনুমতি নিতে হবে না।
এখানেই উঠেছে আসল প্রশ্ন: এর পরে পুলিশ কী করবে? তারা কি বীরভূমের তৃণমূল জেলা সভাপতিকে আদৌ গ্রেফতার করবে? আইনজীবীদের একাংশের মত, আদালত নির্দেশিত ধারাগুলিতে মামলা শুরু হলে গ্রেফতার না করে বসে থাকা পাড়ুই থানার পক্ষে কঠিন।
বস্তুত, অনুব্রতর বিরুদ্ধে মামলা শুরুর ক্ষেত্রে পুলিশের যে গাফিলতি রয়েছে, সেটা আগেই চোখে পড়েছে সিজেএমের। সে জন্য বৃহস্পতিবার এসপিকে পাঠানো লিখিত নির্দেশে তিনি বলেছিলেন, ‘এটি পুলিশের দিক থেকে নিষ্ক্রিয়তা। যা হাল্কা ভাবে নেওয়া উচিত নয়।’ তার পরিপ্রেক্ষিতে আইনজীবীদের একাংশ প্রশ্ন তুলেছেন, “যে কাজ পুলিশের করা উচিত, তা আদালতকে করতে হচ্ছে কেন? আদালতকে কেন বলে দিতে হচ্ছে, কোন কোন ধারায় মামলা হবে?” তাঁদের মতে, আসলে পুলিশ গোটা ঘটনাকে লঘু করে দেখাতে চেয়েছে।
দলীয় বৈঠক সেরে বোলপুরে নিচুপট্টির বাড়িতে ফিরে মুড়ি-ছোলার
ডালে সেরে নিচ্ছেন জলযোগ। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী।
এ ব্যাপারে মুখ খোলেননি জেলার পুলিশ কর্তারা। এ দিন সন্ধ্যায় বীরভূমের পুলিশ সুপার মুরলীধর শর্মা শুধু বলেছেন, “আদালতের নির্দেশ এখনও পাইনি। পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” তবে, অনুব্রতর হুমকির পরে হামলায় খুন হওয়া সাগরচন্দ্র ঘোষের পুত্রবধূ শিবানীদেবী রেজিস্ট্রি ডাকে যে অভিযোগ পাঠিয়েছিলেন, তার প্রাপ্তি স্বীকার করেছেন পুলিশ সুপার। এবং জানিয়েছেন, “ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”
গত ১৭ জুলাই বোলপুরের কসবা এলাকায় প্রকাশ্যে নির্দল প্রার্থীদের বাড়ি জ্বালিয়ে দিতে এবং পুলিশের উপরে বোমা মারতে বলেছিলেন অনুব্রত মণ্ডল। ওই বক্তৃতার পরেই কসবা অঞ্চলে একাধিক নির্দল প্রার্থীর (বিক্ষুব্ধ তৃণমূল) বাড়িতে হামলা, বোমাবাজি হয়। নির্দল প্রার্থী হৃদয় ঘোষের বৃদ্ধ বাবা সাগরবাবুকে গুলি করে মারা হয়েছে। প্রতিটি ঘটনাতেই অভিযোগের তির শাসক দলের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর দিকে। উস্কানিমূলক বক্তৃতা এবং তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে অনুব্রতর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জেলাশাসক এবং পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দেয় নির্বাচন কমিশন। শিবানীদেবীর অভিযোগে অনুব্রত-সহ তৃণমূলের ৪১ জন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে নালিশও জানানো হয়। অভিযোগ, তবু পুলিশ অনুব্রতকে গ্রেফতার করেনি। আদালতেও ত্রুটিপূর্ণ নথি জমা দিয়েছে। ছিল না অনুব্রতর সেই বক্তৃতার সিডি-ও। বৃহস্পতিবার বিচারক সেই আবেদন গ্রহণ না করে নতুন করে জিডি-র সারমর্ম জমা দিয়ে আবেদনের নির্দেশ দেন। তার পরই তড়িঘড়ি সেই নথি জমা দেয় পুলিশ।
শুক্রবার দুপুর ১২টা নাগাদ সিজেএমের এজলাসে ওই আবেদনের শুনানি শুরু হয়। বৃহস্পতিবার অনুপস্থিত থাকলেও এ দিন এজলাসে ছিলেন পাড়ুই থানার ওসি সম্পদ মুখোপাধ্যায়। ওসি প্রথমেই বিচারককে বলেন, “স্যার আমার এলাকায় ব্যাপক গণ্ডগোল চলছে। গত কালও গণ্ডগোলের আশঙ্কা ছিল বলে কোর্টে হাজির হতে পারিনি।” সেই জবাবে সন্তুষ্ট হলেও সিজেএম ওসি-র কাছে জানতে চান, পুলিশ বিষয়টি নিয়ে কোর্টে কেন এল? তারা নিজেরাই কেন তদন্ত শুরু করল না?
এ বার জবাব দেন অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি (এপিপি) কুন্তল চট্টোপাধ্যায়। তিনি জানান, যে দু’টি ধারায় পুলিশ অভিযোগ এনেছে, তা নিয়ে তদন্ত করতে হলে আদালতের অনুমতির প্রয়োজন আছে। তাই পুলিশ আবেদন করেছে। বিচারক ফের সম্পদবাবুর কাছে জানতে চান, জেলাশাসক অভিযোগ জানানো সত্ত্বেও কেন পাড়ুই থানা অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে শুধুমাত্র জিডি করল? এ প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেননি ওসি। এর পরেই বিচারককে অনুব্রতর বক্তৃতার সিডি দেখতে অনুরোধ করেন এপিপি। সম্পদবাবু তখন ওই সিডি জমা দিয়ে জরুরি কাজ থাকার জন্য আদালতের অনুমতি নিয়ে এজলাস ছেড়ে চলে যান। সংবাদমাধ্যমকে এড়াতে কার্যত দৌড়ে বেরিয়ে যেতে দেখা যায় ওসি-কে।
বিচারক এর পরে নিজের ব্যক্তিগত চেম্বারে কুন্তলবাবুকে সঙ্গে নিয়ে সিডি-টি দেখেন। বিকেল চারটে পাঁচ নাগাদ এজলাসে ঢুকে সিজেএম অনুব্রতর বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য ধারায় মামলা শুরুর নির্দেশ দেন। এপিপি বলেন, “পুরনো ধারা দু’টি ছাড়াও বিচারক আরও চারটি ধারা যুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন। পুলিশ এ বার অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১১৭, ৩৩২, ৩৫৩ ও ৪৩৬ ধারা প্রয়োগ করবে। প্রতিটি ধারাই জামিন-অযোগ্য।” এগুলির কোনওটিতেই সাজা তিন বছরের কম নয়।
সিউড়ি আদালত থেকে বেরিয়ে আসছেন পাড়ুই থানার ওসি সম্পদ মুখোপাধ্যায়। তৃণমূল নেতা
অনুব্রত মণ্ডলের প্ররোচনামূলক বক্তব্য নিয়ে তদন্তের ভার তাঁর হাতেই। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।
তবু অনুব্রতকে গ্রেফতার করা নিয়ে সংশয় যাচ্ছে না অনেকেরই। নিহত সাগর ঘোষের ছেলে হৃদয়বাবু বলেন, “পুলিশের একাংশ যে বিষয়টি নিয়ে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করছে, তা বারবার প্রমাণিত হচ্ছে। তাই পুলিশ আদৌ ঠিক ভাবে তদন্ত করবে কি না, তা নিয়ে আমাদের সন্দেহ আছে।”
যাঁকে নিয়ে এত কাণ্ড, সেই জেলা তৃণমূল সভাপতিকে এ দিন বিকেলে বোলপুর শহরের নিচুপট্টিতে নিজের বাড়িতে খোশমেজাজেই পাওয়া গেল। মুড়ি খেতে খেতে বললেন, “এই পেটে কিছু পড়ল।” আদালতের নির্দেশ নিয়ে তাঁর প্রতিক্রিয়া, “বিচারক পুলিশকে তদন্ত করতে বলেছেন। পুলিশ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে! আইন আইনের পথে চলবে!” পাশাপাশি তাঁর দাবি, তিনি অসুস্থ। কসবার বক্তৃতায় তাঁর ‘স্লিপ অফ টাং’ হয়ে গিয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বলেছেন, “যা বলার ২৯ তারিখ (ভোটের ফল প্রকাশের দিন) বলব! যদি দেখি বীরভূমের মানুষ আমাদের পক্ষে ভোট দিয়েছে, তা হলে কিছু করার নেই। না হলে ভাবনাচিন্তা করতে হবে।” যা শুনে জেলা কংগ্রেস সভাপতি সৈয়দ সিরাজ জিম্মির কটাক্ষ, “এটাই তৃণমূলের চরিত্র! জিতলে নেতাকে মাথায় করে রাখা। আর হারলে বলির পাঁঠা!” সিপিএমের জেলা সম্পাদক তথা রাজ্য কমিটির সদস্য দিলীপ গঙ্গোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “তৃণমূল কখনওই আইন-কানুনের ধার ধারে না। আইন মেনে চললে এই পরিস্থিতিই তৈরি হতো না!”

দুপুর ১২টা
ওসি-কে বিচারক: নিজেরা তদন্ত না করে পুলিশ কোর্টে এল কেন?
অতিরিক্ত সরকারি কৌঁসুলি (এপিপি): যে দু’টি ধারায় অভিযোগ, তা নিয়ে তদন্তে কোর্টের অনুমতি প্রয়োজন।
ওসি-কে বিচারক: জেলাশাসক অভিযোগ জানাতে বললেও কেন পাড়ুই থানা অনুব্রতর বিরুদ্ধে শুধু জিডি করল?
বিচারককে এপিপি: আপনি সিডি-টি দেখুন।
• নিজের চেম্বারে বসে সিডি দেখলেন বিচারক
বিকেল ৪টে ৫
বিচারকের নির্দেশ
পুরনো ধারা দু’টির সঙ্গে যুক্ত হল আরও চারটি ধারা। পুলিশ এ বার অনুব্রতর বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধির ১১৭ (জনতাকে হিংসায় প্ররোচনা), ৩৩২ (সরকারি কর্মীকে মারধর), ৩৫৩ (সরকারি কর্মীর কাজে বাধা) ও ৪৩৬ (কারও বাড়িতে বোমা মারা বা অগ্নিসংযোগ) ধারা প্রয়োগ করুক। প্রতিটিই জামিন অযোগ্য।
বিকেল ৪টে ৫৮
তখন অনুব্রত। দলীয় বৈঠক সেরে বোলপুরে নিচুপট্টির বাড়িতে ফিরে জলযোগ।

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.