বীরপাড়া-২ নম্বর গ্রাম পঞ্চায়েত আসনের ভোট। বুথ হয়েছে রামঝোরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। মালতী লোহার দাঁড়িয়েছিলেন ভোটের লাইনে। শিবনন্দন লোহারের কথা বলামাত্রই ভোটের লাইন ছেড়ে গুদাম লাইনে, নিজের ঘরের উঠোনে এসে দাঁড়ালেন প্রৌঢ়া। দাঁড়ালেন তাঁর বাড়ির কাঠটগর গাছটার পাশে, ঠিক যেখানে এসে দাঁড়িয়েছিলেন এক দীর্ঘদেহী মানুষ। গোপালকৃষ্ণ গাঁধী।
সেটা ২০০৭। বন্ধ রামঝোরা চা বাগানের মৃত্যু-মিছিল চলছে। তারই খোঁজ নিতে এসেছিলেন তৎকালীন রাজ্যপাল। মালতীর স্বামী শিবনন্দন লোহারের হাত দু’টি ধরে তিনি জেনেছিলেন, কী ভাবে তাঁর ১৮ বছরের মেয়ে সীমা প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যায়। ঝরঝর করে কেঁদেও ফেলেছিলেন। এর দু’বছরের মাথায় মারা যান স্বামী শিবনন্দনও। আরও দুই মেয়েকে নিয়ে সংসারটাকে টেনেছেন মালতী। আট বছর বন্ধ-থাকা রামঝোরা চা বাগানে অপুষ্টি, অসুখে মারা গিয়েছেন দু’শোরও বেশি শ্রমিক। বাগান খোলে ২০১০ সালে। সেই বাগানে আজ ভোটের বাদ্যি বেজেছে। |
কোলের শিশুকে নিয়েই ভোট দিতে। জলপাইগুড়ির ডেঙ্গুয়াঝাড় চা বাগানে ছবি তুলেছেন সন্দীপ পাল। |
চলছে কী ভাবে? যখন বন্ধ ছিল, তখনই বা পেট চলত কী করে? ভুটান পাহাড়ে পাথর ভেঙে দিনে ৪০-৫০ টাকা মিলত। তাতেই সংসার চলত। রামঝোরা খুললে দিনে ৮৫ টাকা মজুরিতে পাতা তোলার কাজ শুরু করেন আবার। কাজ মেলে মাসে ১২-১৪ দিন। ঘরের অবস্থা অবর্ণনীয়। হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে বাড়ির চারপাশ দেখালেন মালতী। বাঁশের কঞ্চি আর ভাঙা টিনের চাল, এই হল বাড়ি। ভোট দিতে গেছিলেন কেন? একটু হেসে বলেন, “ভোটার কার্ডটা মিইয়ে যায়, তাই মাঝেমাঝে চাঙ্গা করি।” মালতীর দুঃখ একটাই, সেই একবারই এসেছিলেন গোপালকৃষ্ণ। “যদি আরও একবার আসতেন, তা হলে আমাদের জীবন হয়তো একটু শুধরাতো।”
মালতী যদি ভোটের একটি মুখ হ’ন, আর একটি মুখ তবে আশা মুণ্ডা। কাঁঠালগুড়ি চা বাগানের বেনিয়া লাইনের বাসিন্দা আশার স্বামী সুভাষ মুণ্ডা আত্মহত্যা করেন ২০০৭ সালে। বন্ধ চা বাগানে অভাবের তাড়না তিনি আর সহ্য করতে পারেননি। তাঁর দেহ মেলে রেড ব্যাঙ্ক চা বাগানের রেললাইনের পাশ থেকে। সুভাষের দেহ ময়নাতদন্ত করতে পুলিশ পাঠিয়ে দেয় জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালে। কিন্তু দেহ ফিরিয়ে আনা হবে কী করে? ঘরে কোনও টাকা নেই। পড়শিদেরও হাত শূন্য। শেষে আশা-সুভাষের বাড়ির একটি ঘরের দরজা-জানলার কাঠ এবং টিনের চাল বিক্রি করে মেলে হাজার টাকা। তা থেকে ৮০০ টাকা খরচ করে দেহ আনা হয় ভ্যানে করে।
এখন কেমন আছেন আশা? যখন সুভাষ মারা যায়, তখন ছোট মেয়ে শালিনীর বয়স ছিল দেড় মাস। তার বয়স এখন ছয়। দুই ছেলে-মেয়ে আর শাশুড়িকে নিয়ে আশার পরিবার। আশা বাগানে মজুরি খাটতে যান। অতি কষ্টে সংসার চলে। শাশুড়ি মিনা বয়স হয়ে যাওয়ায় আর পাথর ভাঙতে যেতে পারে না। আশার আঙুলে ভোটের কালির দাগ। কীসের আশায় ভোট দিলেন। অবাক হয়ে চেয়ে রইলেন আশা। তারপর বললেন, “জানি না তো।” |