ধর্মঘট করব না, বলতে হবে ট্যাক্সিকে |
নিছক মুচলেকায় কাটবে কি হয়রানির গেরো, প্রশ্ন |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
সোজা আঙুলে ঘি উঠছে না। তাই বন্ধ-ধর্মঘটের নামে আমজনতার হয়রানি রুখতে আঙুল বাঁকানোর সিদ্ধান্ত নিল রাজ্য সরকার। কিন্তু ওই বজ্র আঁটুনিতেও কাজ কতটা হবে, সে প্রশ্ন রয়েই গেল। কারণ ফস্কা গেরোর সম্ভাবনা নির্মূল করার কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হল না!
ট্যাক্সি ধর্মঘটে দাঁড়ি টানার লক্ষ্যে মহাকরণের নতুন সিদ্ধান্তের মধ্যে এমন পরস্পর-বিরোধিতারই ইঙ্গিত পাচ্ছে প্রশাসনের একাংশ।
সরকারের শর্ত, নতুন দু’হাজার ট্যাক্সিকে পারমিট পেতে হলে মালিকদের এই মর্মে মুচলেকা দিতে হবে যে, ধর্মঘট-বন্ধ-হরতালে তাঁরা সামিল হবেন না। যাত্রী ফেরানোও চলবে না। গাড়ির সামনে লিখতে হবে ‘নো রিফিউজাল ট্যাক্সি।’ কিন্তু খাতায়-কলমের এই নিয়ম বাস্তবে কতটা সাফল হবে, তা ঘিরে সংশয় দানা বেঁধেছে। মহাকরণ কর্তাদের একাংশের মতে, মালিক-চালকদের সংগঠনগুলি কোনও না কোনও দলের নির্দেশে চলে, তাই ধর্মঘটের ডাকে সাড়া না-দিয়ে তাঁরা পারবেন কি না, তা নিশ্চিত নয়। কারণ, সরকারের তরফে ইউনিয়নকে ধর্মঘট থেকে বিরত রাখার পদক্ষেপ করা হয়নি।
অতএব সংশয় থাকছেই। কর্তাদের আশঙ্কা যে ভিত্তিহীন নয়, ট্যাক্সি-মালিকদের ভাষ্যেও তার আভাস। যেমন বেঙ্গল ট্যাক্সি অ্যাসোসিয়েশনের নেতা বিমল গুহ বলছেন, “আমরা না হয় হলফনামা দেব। তা হলে সরকারও মুচলেকা দিক যে, ধর্মঘটের দিনে ট্যাক্সিতে হামলা হলে তারা ক্ষতিপূরণ দেবে!” মালিক সংগঠনগুলির হিসেব অনুযায়ী, পাঁচ বছরে কলকাতায় অন্তত ন’বার ট্যাক্সি ধর্মঘট হয়েছে। বাম জমানায় চার বার, মমতা সরকারের আমলে পাঁচ বার। বিমলবাবুর দাবি, বাম আমলের ধর্মঘটে তৃণমূলের ইউনিয়নও সঙ্গে থেকেছে। “ধর্মঘট তো অধিকার। তা কখনওই কেড়ে নেওয়া যায় না।” মন্তব্য বিমলবাবুর। সরকারের কী বক্তব্য? |
পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র এক সময়ে ট্যাক্সি-আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন। ধর্মঘটেও নেতৃত্ব দিয়েছেন। এখন মন্ত্রী হিসেবে তিনি ধর্মঘটের বিরুদ্ধে রায় দিচ্ছেন। বলছেন, “এটা সময়ের দাবি। বন্ধ-ধর্মঘটের সংস্কৃতি মানুষ চাইছে না। দলগুলো তা যত তাড়াতাড়ি বুঝবে, ততই মঙ্গল।’’ কিন্তু ইউনিয়নকে ধর্মঘট সংস্কৃতি না-ছাড়ালে শুধু মালিকদের থেকে মুচলেকা নিয়ে কি জনতার হয়রানি রোখা যাবে?
মদনবাবুর ব্যাখ্যা, “আমরা ব্যক্তি মালিককে পারমিট দিচ্ছি। তিনি ইউনিয়ন করতেই পারেন। তবে তিনি যে ধর্মঘটে সামিল হবেন না, সেটা ইউনিয়নকে বলতেই পারবেন!”
মন্ত্রী বিষয়টা এত সহজ করে দিলেও তাঁর দলের শ্রমিকনেতাদের অন্য সুর। তৃণমূল শ্রমিক সংগঠনের নেতা শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় বলেন, “চালকদের ন্যায়সঙ্গত দাবির ফয়সালা আলোচনাতেও না-হলে তাঁরা ধর্মঘটে যেতে পারেন। এটা তাঁদের অধিকার। তবে যেখানে মানুষের হয়রানির সম্ভাবনা, সেখানে সংগঠনগুলিকে সতর্ক থাকতে হবে।” কংগ্রেস এবং সিপিএমের শ্রমিকনেতাদের বক্তব্যেও স্পষ্ট, ধর্মঘটের রাস্তা তাঁরা ছাড়ছেন না। সিটু’র সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সাফ কথা, “আমরা এই নির্দেশ মানব না। সরকার এ ভাবে মুচলেকা নিতে পারে না। গণতন্ত্র-বিরোধী তো বটেই, এটা মোটর ভেহিক্লস আইনেরও পরিপন্থী।” আইএনটিইউসি-র ট্যাক্সিচালক সংগঠনের নেতা বিমল ঘোষ বলেন, “ধর্মঘট মৌলিক অধিকার। সরকার যা করে করুক, প্রয়োজনে ধর্মঘটে যাবই।” তা হলে?
পরিবহণমন্ত্রীর ঘোষণা, মালিকেরা শর্ত জেনেই ট্যাক্সি নামাচ্ছেন। তাই ধর্মঘটের দিনে ট্যাক্সি চালানোর দায়িত্বও তাঁদের। মুচলেকা দিয়েও ধর্মঘটে ট্যাক্সি না-চালালে সরকার অবশ্যই শাস্তির ব্যবস্থা করবে।” ঘোষণা মদনবাবু। যদিও তাঁর ‘হুঁশিয়ারি’র বাস্তবতা সম্পর্কে প্রশাসনের অনেকে সন্দিহান। মহাকরণের এক কর্তার মন্তব্য, “এটা চাপ তৈরির কৌশল। কোনও দল বন্ধ ডাকলে কেউ সাহস করে রাস্তায় গাড়ি বার করবে না। তখন সরকার কতটা ব্যবস্থা নেবে, তাতে যথেষ্ট সন্দেহ।” |