মৃত্যু শোক সামলে ফের ভোটের লাইনে নুরজাহান বিবির পরিবারের সদস্যরা।
দুষ্কৃতীদের ছোড়া বোমার আঘাতে গত ২২ জুলাই চতুর্থ দফায় মুর্শিদাবাদে ভোটের বলি হন বেলডাঙার কাজিশাহ গ্রামের পূর্বপাড়ার বাসিন্দা নুরজাহান বিবি। বেলডাঙা-১ ব্লকের বেগুনবাড়ি পঞ্চায়েত এলাকায় ওই ঘটনার পরেই ৪১ নম্বর কাজিশাহ প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটগ্রহণ কেন্দ্র লাগোয়া এলাকায় ব্যাপক উত্তেজনা ছড়ায়। তারই জেরে ২২/১ ও ২২/২ নম্বর বুথে ভোটগ্রহণ বন্ধ হয়ে যায়। জেলাপ্রশাসনের কাছ থেকে বিস্তারিত রিপোর্ট পেয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশন দুটি বুথে বৃহস্পতিবার পুনর্নির্বাচনের সিদ্ধান্ত নেয়।
এ দিন পুনর্নির্বাচনে ফের ভোটের লাইনে গিয়ে দাঁড়ান নুরজাহান বিবির পরিবার। এদিন সকাল থেকেই ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে ছিল কেন্দ্রীয় বাহিনী ও জেলা পুলিশের কড়া সতর্কতা। ফলে তিন দিন আগের গণ্ডগোলের চিত্র যেমন এদিনের ভোটে দেখা যায়নি, তেমনি ভোটগ্রহণকে কেন্দ্র করে এলাকায় সামান্য উত্তেজনাও ছিল না। |
তা দেখে নুরজাহান বিবির স্বামী আসাদুদ্দিন সাদিকের আক্ষেপ, “গত সোমবার ভোটের দিন যদি এলাকা এই রকম শান্ত থাকত তাহলে স্ত্রীকে হারাতে হত না। ছেলেমেয়েরাও তাদের মা-হারা হত না।”
যদিও ভোট দিতে যাওয়া নিয়ে এ দিন পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দ্বিধা ছিলই। এগিয়ে আসেন আসাদুদ্দিনের বৃদ্ধা মা মাহমুদা বিবি। তিনিই পরিবারের সকলকে ভোট দিতে যাওয়ার কথা বলেন। এমনকী ওই বৃদ্ধাও যান ভোট দিতে। ছোট ছোট তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে হাজির হন বাবা আসাদুদ্দিনও। আসাদুদ্দিন বলেন, “কোনও রাজনৈতিক দল যখন জনপ্রিয়তা হারায়, তখন তারা সন্ত্রাসের পথ বেছে নেয়। সন্ত্রাসের কাছে মাথা নত করব না বলেই ভোট দিতে গিয়েছি।”
মাকে হারিয়ে একলা হয়ে যাওয়া তিন ছেলেমেয়ে এখনও শোক সামলে উঠতে পারেনি। এ দিন তাই বাবার সঙ্গে ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে গিয়ে মহিলাদের ভোটারদের সারিতে মায়ের মুখ দেখতে না পেয়ে ‘আমার মা কোথায়’ বলে কান্না জুড়ে দেয় বছর দুয়েকের সুলতান আবিদ। ওই কান্নায় নীরবতায় ছেয়ে যায় ভোটের লাইনে। |
শিশুটিকে সামাল দিতে ছুটে আসেন পিসি মর্জিয়া বিবি। তিনি বলেন, “সকালের দিকেও ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে এক বার নিয়ে গিয়েছিলাম। তখনও কান্না জুড়েছিল। কোনও রকমে সামলাচ্ছি।” কথা শেষ করতে পারলেন না তিনি। কান্নায় বুজে আসে কথা। আসাদুদ্দিন শেখও বলেন, “সোমবারের পর থেকে রাতে এক বারের জন্য দু’চোখের পাতা এক করতে পারিনি। সারা রাত জেগে ছেলে মা-মা করে কাঁদছে। ছেলেকে সামলাতে গিয়ে আমিও ঘুমোতে পারছি না।” যদিও নুরজাহান বিবি মারা যাওয়ার পরে নাতি-নাতনিকে সামাল দিতে ঠাকুমা মাহমুদা বিবি ছেলের বাড়িতে এসে থাকছেন। কাজিশাহ হাইমাদ্রাসার পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী মেয়ে সাবিহা শবনমের মুখে শুধুই মাকে হারানোর কথা। ছোট্ট সাবিহা জানায়, “মা আমায় তারানা বলে ডাকত। সেদিন তখনও আমার মা ভোট দিতে যায়নি। ভোটের লাইনে ঝগড়া হচ্ছিল বলে মা আমাদের নিয়ে ফুফুর বাড়িতে চলে আসে। ওই বাড়ি থেকেই আমার ছোট বোন বাইরে বেরিয়ে যায়। তাকে আনতে বাইরে যায়। তখনই আমার মাকে বোমা মারা হয়।” তার দাবি, “আমার মায়ের সঙ্গে যা হয়েছে, তা যেন অন্য কারও মায়ের সঙ্গে না হয়।” |