ইস্টবেঙ্গলের অতীত
আসিয়ান জয়ের দশ বছর পূর্তিতে বেশি আফসোসই হচ্ছে
চুনী গোস্বামীর মুখে শোনা, ’৬২-র এশিয়ান গেমসের আগে গোটা ভারতীয় ফুটবল টিমকে শেখানো হয়েছিল অতুলপ্রসাদের গান, ‘বলো বলো বলো সবে, ভারত আবার জগৎ সভায়...’।
চুনীরা নাকি ম্যাচের আগে, পরে, টিমবাসে, অনুশীলনে ওই গানটাই গাইতেন চিৎকার করে। থঙ্গরাজ থেকে জার্নেল সিংহ। ফ্র্যাঙ্কো, ইউসুফ খান, ত্রিলোক সিংহ সবাই শিখে নিয়েছিলেন ওই গান।
ঠিক ৪১ বছর পর জাকার্তার মাটিতে পা দিয়ে গেলারো বুং কর্ণ স্টেডিয়ামের সবুজে পা রেখে প্রথমেই মনে পড়েছিল চুনী গোস্বামী, প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়দের কথা। ওই তো খেলছেন অরুণ ঘোষ! ওই প্রশান্ত সিংহ! ওই চুনীর পাস ধরে দুরন্ত শটে গোল করছেন পিকে! মাটিতে পড়ে দক্ষিণ কোরিয়ার গোলকিপার। ওই তো গোল করছেন জার্নেল। ভিকট্রি স্ট্যান্ডে ভারতীয় দল। জাতীয় পতাকা... জাতীয় সঙ্গীত। কাঁদছেন অসুস্থ রহিম সাহেব। অদ্ভুত ভাবে ৪১ বছর বাদে যেন সবটার মিল পাচ্ছিলাম। সেই জাকার্তা। সেই গেলারো বুং কর্ণ স্টেডিয়াম। ফাইনালে তাইল্যান্ডের সেই প্রতিপক্ষ, যার কাছে গ্রুপ লিগের প্রথম ম্যাচটাই হারতে হয়েছে। এক স্বপ্নবিলাসী কোচ, যিনি আনন্দের চরম মুহর্তে ড্রেসিংরুমে একা একা কাঁদেন।
শুধু নামগুলো, চরিত্রগুলো আলাদা। চুনী গোস্বামী বদলে গিয়ে ভাইচুং ভুটিয়া। থঙ্গরাজ বদলে গিয়ে সন্দীপ নন্দী। রহিম সাহেব বদলে গিয়ে সুভাষ ভৌমিক। এখানে দেশের বদলে ক্লাব। কিন্তু তাতে কী! দেশেরই তো প্রতিনিধিত্ব। গ্যালারিতে আমরা যারা গুটিকয়েক ভারতীয়, তারা তো দেশকেই সমর্থন করছিলাম। কলকাতা থেকে যে কয়েকজন ইস্টবেঙ্গল সমর্থক ফাইনাল দেখতে জাকার্তায় পৌঁছে গিয়েছিলেন তাঁদের হাতে তো লাল-হলুদের সঙ্গে জাতীয় তেরঙ্গাও।
ম্যাচের দিন সকালে এক সতীর্থ সাংবাদিক জাকার্তা থেকে ফোন করেছিলেন সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। বাংলা ক্রিকেটের লাকি ম্যাসকট। রঞ্জি জয়ী অধিনায়ক। এ রকম দিনে নাকি লাকি লোকজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। শুনেছিলাম আনন্দবাজার অফিসে ম্যাচ রিপোর্ট করতে বসেছিলেন চুনী গোস্বামী। ’৬২-র ক্যাপ্টেন। আমি নিজে তখন জাকার্তার মাটিতে একমাত্র টিভি প্রতিনিধি। আসিয়ান কাপের আগে ইস্টবেঙ্গল নিয়ে ‘কালপুরুষ’ ব্যান্ডকে দিয়ে একটা গান রেকর্ডিং করিয়েছিলাম। অ্যালবাম হিসাবে রিলিজও হয়। ‘মাছের রাজা ইলিশ আর খেলাতে ফুটবল... সে খেলাতে সেরা দল আমার ইস্টবেঙ্গল’। দেশের পাঁচটা ট্রফি এক মরসুমে জিতে সুভাষের টিমও তখন অশ্বমেধের ঘোড়া। আর ইস্টবেঙ্গল মহল্লাগুলোর মোড়ে মোড়ে বেজেছিল এই গান। জাকার্তা যাওয়ার আগে এই অ্যালবামটা ব্যাগে ভরে নিয়েছিলেন সেই সময় লাল-হলুদের ম্যানেজার মণীশ বন্দ্যোপাধ্যায় আর রজত গুহ। টিমবাসে সব সময় এই গানটা বাজত।
বেশ মনে আছে, আসিয়ান ট্রফিটা নিয়ে টিমবাসেই হোটেলে ফিরছি। ‘কালপুরুষ’-এর গানের সঙ্গে তুমুল নাচ চলছে চলন্ত বাসের ভেতরেই। ওকোরো নাচছেন। ডগলাস নাচছেন। দীপক নাচছেন। অ্যালভিটো নাচছেন। গানের প্যারডি করে গেয়ে চলেছেন ষষ্ঠী দুলে। কোচ সুভাষ ভৌমিককে নিয়ে। কিছুক্ষণ আগে হরিপালের এই পাঁচ ফুটের ছেলেটাই অকেজো করে দিয়ে এসেছেন এশিয়ার সেই সময়ের সেরা মিডফিল্ডার বেক তেরো সাসানার চাইম্যান-কে। মাঠে সদর্পে বলে এসেছেন, ‘‘ইউ চাইম্যান, আই ষষ্ঠী দুলে। টু ডে আই হিরো, ইউ জিরো।’’ স্টেডিয়াম থেকে হোটেলের ওই আধঘণ্টার জার্নিটা স্বপ্নের মতো মনে হয়েছিল। মনে হয়েছিল, এই তো স্বপ্নের উড়ানে চড়ে ফেরা গেল। এ বার থেকে উত্তরণ, শুধুই উত্তরণ। সিঙ্গাপুর থেকে যে দিন কলকাতা ফিরছিলাম টিমের সঙ্গে, প্রবল ‘এয়ার টার্বুলান্সে’ পড়েছিল আমাদের বিমান। অথচ কিছু মনেই হয়নি। মনে হয়েছিল, এই তো মসৃণ যাত্রার শুরু। কলকাতা বিমানবন্দরে লাখ লাখ মানুষ। যেন শাপমুক্তির একটা রাত। একশো বছর ধরে ঘুমিয়ে থাকা এ দেশের ফুটবল অবেশেষে বোধহয় জাগল।
দশ বছর পর মনে হচ্ছে, ধুর, ওটা বোধহয় স্বপ্নই ছিল। কিছুই তো বদলাল না! ইস্টবেঙ্গল আবার সেই তিমিরেই। ফেডারেশন কাপ আর আইএফএ শিল্ড জেতার হিসেব রাখে। ভারতীয় ফুটবলে সোনার কাঠি হয়ে উঠতে পারল কই আসিয়ান কাপ?
লাল-হলুদের এক শীর্ষ কর্তা আসিয়ান কাপকে বলেন আসিয়ানা কাপ। আসিয়ানা শব্দটার আভিধানিক অর্থ— আশ্রয়। আসিয়ান সত্যি আসিয়ানা হতেই পারত ভারতীয় ফুটবলে। এক ভারতীয় কোচ দেশের গণ্ডি টপকে বিদেশ থেকে ট্রফি আনার স্বপ্ন আর সাহস দেখিয়েছিলেন। তাঁকে আরও আশ্রয় কিংবা প্রশ্রয় দুটোই দিতে পারত ভারতীয় ফুটবল। আর সাহস বলে সাহস! এই নেই-সাম্রাজ্যের ফুটবলারদের নিয়ে তুললেন পাঁচতারা হোটেলে। সেখানেই আবাসিক শিবির, জিম, সুইমিং পুল। তখনকার ভারতীয় ক্রিকেট টিমের ফিটনেস ট্রেনার অ্যাড্রিয়ান ল্য’রু-র সাহায্য নিয়ে উড়িয়ে আনলেন আর এক দক্ষিণ আফ্রিকান ফিটনেস ট্রেনার কেভিন জ্যাকসনকে। প্রবাসী শিল্পপতি প্রসূন মুখোপাধ্যায়ের সাহায্যে টুর্নামেন্ট শুরুর বেশ কয়েক দিন আগেই পৌঁছে গেলেন জাকার্তায়। ফিলিপিন্সের আর্মি টিম আর ইন্দোনেশিয়ান দুটো চ্যাম্পিয়ন টিমকে হারিয়ে ফাইনালে।
ফাইনালের আগে সাংবাদিক সম্মেলনে অন্য সুভাষ ভৌমিককে দেখলাম। উল্টো দিকে তাইল্যান্ডের বেক তেরো সাসানা। এশিয়ার অন্যতম সেরা দল। আর বিপক্ষের কোচকে পাশে বসিয়ে লোকটা বলে কী! প্রায় উড়িয়ে দেব, গুঁড়িয়ে দেব মেজাজ। আর হোটেলে ফিরে নিজের ফুটবলারদের বললেন অন্য কথা। বললেন, ‘‘উপভোগ করো। এই মুহূর্তগুলো আর পাবে না। ফুটবল উপভোগ করো। ফাইনাল খেলাটা উপভোগ করো।’’
সুভাষ ভৌমিক এখন আর কোচিং করান না। বলা ভাল, কোচিংয়ের চাকরি পান না। কয়েক দিন আগে দেখছিলাম, সিসিএফসি-র অ্যামেচার টিমকে কোচিং করাচ্ছেন। অথচ এ বছরের আই লিগ চ্যাম্পিয়ন কোচ। কী বলবেন! ভারতীয় ফুটবল বোধহয় এ রকমই। সাহসীদের জায়গা নেই। সময়ের আগে যাঁরা ভাবতে পারবেন, তাঁদের লালন-পালন করার মতো ছত্রছায়া নেই। আসিয়ান কাপটা সত্যিই সময়ের আগে ভেবেছিলেন সুভাষ। একশো বছর ধরে অনেক তো হল লিগ, শিল্ড আর ফেড কাপ। মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলের পরিসংখ্যান বাড়ানো ছাড়া কোনও লাভ হয়নি। কখনও ইস্টবেঙ্গল জিতেছে, কখনও মোহনবাগান, কখনও ডেম্পো। আর সেখানেই থেমে গিয়েছে ভারতীয় ফুটবল। যাঁদের হাতে দায়িত্ব, তাঁরা এর বেশি ভাবেনইনি। দশ বছর আগে ওটাই বদলাতে চেয়েছিলেন সুভাষ ভৌমিক। বোধহয় সময়ের একটু আগে।
দুঃখের বিষয়, সময়টা এখনও এল না আমাদের ফুটবলে। কয়েক দিন আগে আসিয়ান জয়ী সেই কোচের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। এখনও স্বপ্ন আর উত্তেজনায় ফুটছেন। “আবার একটা ঠিকঠাক দায়িত্ব দিক কেউ, এএফসি-র ফাইনাল খেলব। সম্ভব, খুব সম্ভব।” অবিশ্বাসী ভঙ্গিতেই তাকাতে হচ্ছিল তাঁর দিকে। ঠিক যেমন ভাবে শুনেছিলাম দশ বছর আগে। আমরা সবাই। ফুটবলাররা, ক্লাব অফিসিয়ালরা, সাংবাদিকরা— সবাই। কে জানে, সুভাষ আবার স্বপ্ন দেখানোর সুযোগ পাবেন কি না। কিন্তু ২০০৩-এর ২৬ জুলাইটা থেকে যাবে। প্রতি দশ বছর অন্তর হয়ত এ ভাবেই এই দিনটাতে আফসোস করব আমরা। অন্তত আমরা, যারা ওই স্বপ্নটার শরিক ছিলাম, আফসোসটা বারবার ফিরে-ফিরে আসবে।
‘চিঠি হাতেই ছিল। ট্যাক্সি দরজাতেই দাঁড়িয়েছিল। আর একটু হিম্মত থাকলে জীবনটাই বদলে যেত...।’ ‘থ্রি ইডিয়টস্’-এর র‌্যাঞ্চোর দাস চাঁচোড়কে খুব মনে পড়ছে। ইস, ভারতীয় ফুটবলের কানে-কানেও এই কথাগুলো বলার মতো ওই রকম যদি কেউ থাকত!

পুরনো খবর:




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.