সব গুলি ছোড়া হয়েছিল শূন্যে। পর পর ছ’টা। থ্রিনটথ্রি রাইফেলের ফায়ারিংয়ের আওয়াজেই ক্ষিপ্ত জনতা ছত্রভঙ্গ। পুলিশ ঘেরাওমুক্ত।
গুলি চালিয়েছিলেন যিনি, কলকাতা পুলিশের সেই প্রাক্তন কমিশনার নিরুপম সোম বলছেন, “দিনটা মনে আছে। ১৯৫৯-এর ৩ সেপ্টেম্বর, খাদ্য আন্দোলনের উত্তাল সময়। আমি তখন অবিভক্ত ২৪ পরগনার এএসপি (নর্থ)। সোদপুর স্টেশনে জনতা আমাদের ঘিরে লাইনের পাথর তুলে ছুড়তে থাকে। এক কনস্টেবল লুটিয়ে পড়েন।”
ওই সঙ্কটকালে পরিত্রাতা হয়ে দাঁড়ায় থ্রিনটথ্রি। “আমি নিজে ছ’রাউন্ড ফায়ার করি। ক্ষিপ্ত মানুষকে ভয় পাওয়াতে থ্রিনটথ্রি-র আওয়াজই যথেষ্ট ছিল।” বলেন নিরুপমবাবু। তাঁর কথায়, “তখনও কিন্তু কলকাতা পুলিশকে ব্যাপক ভাবে ওই রাইফেল দেওয়া হয়নি। মূল আগ্নেয়াস্ত্র বলতে তখন মাস্কেট। যা থেকে এক বার গুলি ছোড়ার পরে ফের গুলি ভরতে হয়। ক্রমে তার জায়গা নিল থ্রিনটথ্রি।”
পুলিশি অস্ত্রে বিবর্তনের সেই প্রক্রিয়ায় এ বার থ্রিনটথ্রি-ও বাতিলের পর্যায়ে পড়তে চলেছে। তার জায়গা নিতে আসছে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। লালবাজারের কর্তারা জানাচ্ছেন, ফোর্সকে যুগোপযোগী হাতিয়ারে সুসজ্জিত করতেই এই সিদ্ধান্ত। অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (৩) দেবাশিস রায়ের বক্তব্য, “সময়ের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পুলিশকে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত করে তোলা হচ্ছে।” নিরুপমবাবুও বলছেন, “এখন অটোম্যাটিকের যুগ।
অপরাধ-জগত সে ভাবেই সাজছে। থ্রিনটথ্রি তাদের টক্কর নিতে পারবে না, কারণ তাতে প্রতি বার গুলি ছোড়ার আগে বোল্ট করতে হয়। অনেকটা সময় লাগে।” |
বোল্ট, অর্থাৎ ট্রিগারের উপরে ছিটকিনির মতো অংশটি পিছন দিকে টেনে গুলি চালানো। যেমন চালিয়েছিল শোলের জয় আর ভিরু। জলের ট্যাঙ্কে থ্রিনটথ্রি হাতে দাঁড়ানো অমিতাভ-ধর্মেন্দ্রকে মনে পড়ে? এক-এক বার বোল্ট করে অব্যর্থ লক্ষ্যে ফায়ারিং! রণে ভঙ্গ দিচ্ছে গব্বরের দল। কিংবা ট্রেন-লুঠেরা ঘোড়সওয়ারদের মহড়া নিতে গার্ডের কামরা থেকে ধুন্ধুমার গুলির লড়াই! দু’পক্ষের হাতেই থ্রিনটথ্রি। বলতে গেলে ওই একটা ফিল্মই সাবেক আগ্নেয়াস্ত্রটির সঙ্গে ‘জান-পহেচান’ করিয়ে দিয়েছে তামাম ভারতের আমজনতার। এর নাম থ্রিনটথ্রি কেন?
কারণ, রাইফেলটির কার্তুজ.৩০৩ ইঞ্চি (৭.৭ মিলিমিটার) বোরের। তাই চলতি কথায় থ্রিনটথ্রি। জেমস লি নামক এক মার্কিন এই ‘বোল্ট অ্যাকশন’ রাইফেলের নকশা বানিয়েছিলেন বলে পোশাকি নাম লি এনফিল্ড।
এবং এনফিল্ডের রয়্যাল স্মল আর্মস ফ্যাক্টরিতেই রাইফেলটি প্রথম তৈরি হয়। সেটা ১৯০৭। তার পরে শুরু হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। সেখানেই বিশ্ব প্রথম দেখল থ্রিনটথ্রি’র পরাক্রম। ১৯১৪-য় মসের লড়াইয়ে ব্রিটিশ সেনা লি এনফিল্ড রাইফেল থেকে এমন দাপটে গুলিবৃষ্টি করে যে, প্রতিপক্ষ জার্মানেরা ভেবেছিল মেশিনগান! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও ব্রিটিশ পদাতিক বাহিনীর প্রধান অস্ত্র লি এনফিল্ড। এমনকী, জাহাজ থেকে ডাঙার জার্মান ঘাঁটি আক্রমণেও তা বিশেষ ভূমিকা নেয়। কেননা এর পাল্লা (রেঞ্জ) এতটাই যে, এক কিলোমিটার দূরের লক্ষ্যকেও ঘায়েল করতে পারে। তবে মারণ-পাল্লা মোটামুটি পাঁচশো মিটার। ওই দূরত্বের মধ্যে পর পর তিন জনকে এ-ফোঁড় ও-ফোঁড় করে দিতে পারে থ্রিনটথ্রি-র একটা বুলেট!
ব্রিটিশ জমানার কলকাতা পুলিশকে থ্রিনটথ্রি দেওয়ার শুরু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে। ভারত ছাড়ো আন্দোলন তখন তুঙ্গে। তা দমনের জন্য এ হেন একটি অস্ত্রের সমূহ দরকার পড়েছিল। পরবর্তী আট দশকে সেটাই পুলিশের নিয়মিত হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। পুলিশ-কর্তারা এ-ও জানাচ্ছেন, থ্রিনটথ্রি রাইফেল নিছক একটি আগ্নেয়াস্ত্র নয়। এর পরতে পরতে জড়িয়ে আছে ইতিহাস ও কলকাতা পুলিশের সাফল্য-ব্যর্থতা ঘিরে নানা বিতর্ক।
যেমন, কলকাতার আমেরিকান সেন্টারে জঙ্গি হানার ঘটনা। ২০০২-এর ২২ জানুয়ারি সেই কাকভোরে জঙ্গিরা ওখানে একটামাত্র এ কে-৪৭ থেকে ৫৪ রাউন্ড গুলি চালিয়েছিল। আর একটা নাইন এমএম পিস্তল থেকে এক রাউন্ড। পাঁচ পুলিশের প্রাণ যায়, জখম হন ১৮ জন। কিন্তু কুড়ি জন পুলিশকর্মীর হাতে থ্রিনটথ্রি রাইফেল থাকলেও তাঁরা কেউ একটা গুলিও ছুড়তে পারেননি! ২৬/১১-র হানায় পর্যুদস্ত মুম্বই পুলিশের অনেকেও আক্ষেপ করে বলেছিলেন, “মান্ধাতার থ্রিনটথ্রি নিয়ে একে ফর্টি সেভেনের সামনে দাঁড়াব কী করে?” আবার ১৯৯৩-এর ২১ জুলাই যুব কংগ্রেসের মহাকরণ অভিযানে পুলিশের গুলিতে যে ১৪ জন প্রাণ হারান, তাঁদের প্রত্যেককেই বিদ্ধ করেছিল থ্রিনটথ্রি’র বুলেট।
বস্তুত আমেরিকান সেন্টারে হানাদারির পরেই কলকাতা পুলিশকে ব্যাপক ভাবে স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত করার ভাবনা শুরু হয়। পটনা, গুয়াহাটির মতো কিছু রাজধানী শহরের পুলিশ অবশ্য আগেই থ্রিনটথ্রি বাতিলের তোড়জোড় শুরু করেছে। ভারতে থ্রিনটথ্রি রাইফেলের উৎপাদনে দাঁড়ি পড়েছে আশির দশকে, বন্ধ এর বুলেট তৈরিও। কলকাতা পুলিশে থ্রিনটথ্রি-র জায়গা নেবে যে, সেই সেল্ফ লোডিং রাইফেলে (এসএলআর) তিরিশ কার্তুজের ম্যাগাজিন। তা পরের পর গুলি ছুড়তে সক্ষম, বোল্টের বালাই নেই। তবে এখানে দক্ষতার প্রশ্ন উঠছে। রাজ্য পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত ডিজি অরুণপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের সংশয়, “বহু পুলিশকর্মীর অস্ত্র প্রশিক্ষণ ঠিকঠাক হয় না। আনাড়ি হাতে সেমি-অটোম্যাটিক বা অটোম্যাটিক রাইফেল এলে বেশি প্রাণহানির আশঙ্কা থাকবে না কি?”
লালবাজার অবশ্য আশাবাদী, তালিমের মান বাড়িয়ে এই আশঙ্কা কমানো যাবে। পর্যায়ক্রমে প্রায় দেড় হাজার থ্রিনটথ্রি বাতিল করার পরেও কলকাতা পুলিশের হাতে এই মুহূর্তে তার সংখ্যা প্রায় চার হাজার। কর্তাদের ধারণা, থ্রিনটথ্রি পুরোপুরি তুলে দিতে আরও বছর চারেক লাগবে। এক শীর্ষ অফিসারের কথায়, “বছরে পাঁচশো, বড়জোর এক হাজার এসএলআর আমরা কিনতে পারি। তাই সমস্ত থ্রিনটথ্রি বদলানো সময়সাপেক্ষ।” খরচটাও বড় সমস্যা। অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি থেকে এক-একটা এসএলআর কিনতে পড়ে ৪২ হাজার টাকা। লালবাজারের তথ্য বলছে, বাহিনীর হাতে হাজারখানেক এসএলআর মজুত। এ ছাড়া ইনস্যাস শ’পাঁচেক এবং এ কে-৪৭ আছে শ’তিনেক, যেগুলো কম্যান্ডো আর স্পেশ্যালাইজ্ড অ্যাকশন ফোর্স (স্যাফ)-এর জন্য। থ্রিনটথ্রি তুলে এসএলআর দেওয়া হবে মূলত সশস্ত্র বাহিনী, র্যাফ ও থানার পুলিশকে।
থ্রিলার-লেখক জ্যাক হিগিন্সের বর্ণময় বন্দুকবাজ চরিত্র সিন ডিলন মরুভূমিতে শত্রুবধের জন্য অস্ত্রসম্ভার থেকে বেছে নিয়েছিল আদ্যিকালের লি এনফিল্ড-কে। বহ দূর থেকে নির্ভুল চাঁদমারিতে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল সন্ত্রাসবাদীদের শিরদাঁড়া। “এটা এত দিন পুলিশের অস্ত্রাগারেরও মেরুদণ্ড হয়ে ছিল। যুগধর্মের খাতিরে তাকে এ বার রিটায়ারমেন্টে পাঠাতে হচ্ছে!” স্মৃতিমেদুর মন্তব্য লালবাজারের এক কর্তার। কালের নিয়মেই পুলিশের সংগ্রহশালায় ঠাঁই পেতে চলেছে ভুবনজয়ী লি এনফিল্ড ওরফে থ্রিনটথ্রি। |