ভরা এজলাসে অভিযুক্তকে নিয়ে পুলিশ ঢুকতে না ঢুকতেই আইনজীবীদের চিৎকার ‘শেম-শেম’। এতে অবশ্য খুব একটা বিচলিত মনে হল না তাঁকে। ধীরে ধীরে এজলাস লক-আপে ঢুকে বেঞ্চে বসে পড়লেন সব্যসাচী রায়চৌধুরী। ফুলবাগানে নাবালিকাকে যৌন নির্যাতন মামলার অন্যতম অভিযুক্ত।
ইতিমধ্যে এজলাসে আনা হল দুই মহিলাকে। আবার হইচই। সাদা-কালো চেক সালোয়ার-কামিজ এক মহিলাকে উদ্দেশ করে উড়ে আসতে লাগল নানা ধরনের উক্তি। গোলমাল থামাতে হস্তক্ষেপ করতে হল বিচারককে। পরে এজলাসে বিচারকের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে-থেকেই অঝোরে কাঁদতে লাগলেন ওই মহিলা লাভলি চাড্ডা। মামলার আর এক প্রধান অভিযুক্ত। যাঁর বাড়িতে আটকে রেখেই ওই নাবালিকার উপর দিনের পর দিন যৌন নির্যাতন হয়েছে বলে অভিযোগ।
ঘটনাচক্রে, সব্যসাচী এবং লাভলি এই শিয়ালদহ আদালতেরই আইনজীবী। যে আদালতের অতিরিক্ত মুখ্য বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট অরুণ রাইয়ের এজলাসে বৃহস্পতিবার হাজির করানো হল তাঁদের।
সব্যসাচী ও লাভলির পাশাপাশি এই ঘটনায় ধৃত আরও দুই অভিযুক্ত, লাভলির স্বামী সুব্রত মিশ্র ও নির্যাতিতার মা সঙ্গীতা সর্দারকেও এ দিন হাজির করানো হয় আদালতে। চার জনেরই ৩১ জুলাই পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছেন বিচারক। নির্যাতিতার সৎ-বাবা উত্তম দাস এবং মিলন নামে অভিযুক্ত এক পুলিশ অফিসারের অবশ্য এখনও খোঁজ মেলেনি। |
গোয়েন্দা-প্রধান পল্লবকান্তি ঘোষ বলেন, “মিলনকে খুঁজে বার করতে নির্যাতিতার সঙ্গে কথা বলে তার স্কেচ তৈরি করা হবে।” এক পুলিশকর্তার দাবি, কলকাতা পুলিশে ওই নামে যে ক’জন রয়েছেন, তাঁদের ছবি ওই নাবালিকাকে দেখানো হয়েছে। কিন্তু সে ছবি দেখে অভিযুক্তকে চিহ্নিত করতে পারেনি।
অভিযুক্ত আইনজীবীদের এজলাসে হাজির করানো নিয়ে সকাল থেকেই সরগরম ছিল আদালত। বারান্দা-সিঁড়িতে দলে দলে আইনজীবীরা দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁদের এক ঝলক দেখার জন্য। কোর্ট লক-আপে নিয়ে যাওয়ার আগে কেউ কেউ মোবাইলে ছবি তুলে রাখারও চেষ্টা করেছেন।
বেলা আড়াইটের পর অভিযুক্তদের এজলাসে হাজির করাতে নির্দেশ দেন বিচারক। প্রথমে আনা হয় হলুদ টি-শার্ট আর ধূসর প্যান্ট পরা সব্যসাচীকে। প্রায় একই সঙ্গেই আনা হয় লাভলির স্বামী সুব্রত মিশ্রকে। তাঁর পরনে লাল-নীল চেক টি-শার্ট ও নীল জিন্স। এজলাসের লক-আপে ঢুকে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়ানোর পরেই বেঞ্চে বসে পড়েন সব্যসাচী। সুব্রত অবশ্য দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকেন লক-আপের লোহার জাল আঁকড়ে।
লাভলি ও সঙ্গীতাকে লক-আপে ঢোকানো হয়নি। বিচারকের সামনে দাঁড় করানো হয় তাঁদের। সমবেত চিৎকারে এজলাসে তখন কান পাতাই দায়। এই সময়ে এজলাসে দাঁড়িয়ে এক আইনজীবী নিচু স্বরে সহকর্মীকে বলছিলেন, “এই দু’জনের জন্য সমাজের কাছে আমাদের মান-সম্মান তো গোল্লায় যাচ্ছে!”
বিচারকের হস্তক্ষেপে গোলমাল থামলে শুরু হয় শুনানি। প্রথমে অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবীরা এফআইআর-এর কপি ধরে নানা সওয়াল করতে থাকেন। তাঁরা যুক্তি দেন, অভিযোগে অসংলগ্নতা রয়েছে। অভিযোগকারিণীর বয়স নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে। অভিযোগকারিণী বাড়ি থেকে পালিয়ে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিল। অতএব সে মানসিক ভাবে অসুস্থ বলেও অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবীরা আদালতে দাবি করেন। সরকার পক্ষের আইনজীবী পাল্টা বলেন, আত্মহত্যা করতে যাওয়া মানেই যে কেউ মানসিক ভাবে অসুস্থ, এ কথা মেনে নেওয়া যায় না।
তা হলে তো ভারতীয় দণ্ডবিধিতে আত্মহত্যার প্ররোচনা দেওয়ার ধারাটি অসাংবিধানিক বলে মেনে নিতে হয়।
সওয়াল-জবাব চলার সময় বিচারকের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়ানো লাভলি মাঝেমধ্যেই চোখ মুছছিলেন লাল ওড়না দিয়ে। তাঁর ঠিক পিছনেই দাঁড়িয়েছিলেন সাদা-নীল সালোয়ার কামিজ পরা সঙ্গীতা। সব্যসাচী অবশ্য এজলাস লক-আপে ভাবলেশহীন মুখেই বসে ছিলেন। কয়েক জন পরিচিত আইনজীবীকে ডেকে নিয়ে নিচু স্বরে কথা বলতেও দেখা গিয়েছে তাঁকে। যদিও ওই লক-আপে থাকা আর এক অভিযুক্ত সুব্রত দৃশ্যতই ভেঙে পড়েছিলেন। ঘণ্টাখানেক একসঙ্গে থাকলেও এক বারের জন্যও সব্যসাচীর সঙ্গে কথা বলেননি তিনি।
এজলাসে যখন শুনানি চলছে, তখনও বাইরের করিডরে যাবতীয় চর্চার কেন্দ্রবিন্দু লাভলি-সব্যসাচী। সওয়াল-জবাব চলে ঘণ্টাখানেক। শেষে বিচারক দু’পক্ষের যাবতীয় বক্তব্য নথিভুক্ত করার পর চার অভিযুক্তকেই পুলিশি হেফাজতের পাঠানোর নির্দেশ দেন।
আদালতের বাইরে সরকার পক্ষের আইনজীবী অভিজিৎ চট্টোপাধ্যায় বলেন, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে পুলিশ এ দিন শিশুদের যৌন নিগ্রহ রক্ষা আইনের ৪ ও ১০ নম্বর ধারা যুক্ত করার আর্জি জানিয়েছিল। তা আদালত মঞ্জুর করেছে। কেস ডায়েরিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট প্রমাণও রয়েছে। অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবী উত্তম ঘোষ বলেন, “আমার মক্কেলদের চক্রান্ত করে ফাঁসানো হয়েছে।”
দুপুরে শিয়ালদহ আদালতের বার লাইব্রেরিতে বসে এক আইনজীবী বলছিলেন, “এমন নোংরা ঘটনায় দু’জন আইনজীবীকে আদালতে হাজির করানো হচ্ছে, ভেবেই লজ্জা হচ্ছে।” বুধবার তাঁর চেম্বারে আসা অন্তত দশ জন মক্কেল সব্যসাচী-লাভলিদের প্রসঙ্গ তুলেছেন বলে জানালেন ওই আইনজীবী। বললেন, “বারবারই চেষ্টা করেছি ওঁদের কথা এড়িয়ে যেতে। কী উত্তর দিতাম বলুন তো!” |