মাত্র পাঁচ মিনিট দেরিতে চলছিল ট্রেনটা। ঠিক সময়ে স্টেশনে পৌঁছনোর চেষ্টাটাই কাল হল। যে গতিতে যাওয়ার কথা, তার চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি জোরে ছুটছিল মাদ্রিদ থেকে ফেরোলগামী ট্রেন। সান্তিয়াগো ডি কম্পোস্টেলার কাছে একটি বাঁকের মুখে উল্টে গিয়ে লাইন থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেল ট্রেনের আটটি বগিই। প্রাণ হারালেন অন্তত ৮০ জন যাত্রী। ৯৫-এরও বেশি আহত। ৩৬ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তবে বেঁচে গিয়েছেন ট্রেনের দুই চালক।
কাল রাত ৮টা ৪১ মিনিটে এই দুর্ঘটনা ঘটে। ট্রেনটিতে ছিলেন ২১৮ যাত্রী। তাঁদের অনেকেই সান্তিয়াগোয় যাচ্ছিলেন সেন্ট জেমসের উৎসবে যোগ দিতে। দুর্ঘটনার জেরে যে উৎসব বাতিল করে দেওয়া হয়েছে।
প্রতি ঘণ্টায় ৮০ কিমি থাকার কথা ট্রেনের গতি। অথচ চালকরা প্রতি ঘণ্টায় গতি তুলেছিলেন ২২০ কিমির। অতিরিক্ত এই গতিকেই দুর্ঘটনার কারণ বলা হচ্ছে। প্রযুক্তিগত ত্রুটি ছিল না বলেই জানিয়েছে স্পেনের জাতীয় রেল কোম্পানি রেনফে। তবে তাঁদের জিম্মায় থাকা ট্রেনের ব্ল্যাক বক্স পরীক্ষা করে আরও কিছু জানা যেতে পারে বলে জানান অফিসাররা। |
মাদ্রিদ থেকে ট্রেন ছেড়েছিল বুধবার দুপুর তিনটে নাগাদ। ফেরোল পৌঁছনোর কথা ছিল সাড়ে দশটায়। যাওয়ার পথে একটি সুড়ঙ্গ থেকে বেরিয়ে প্রচণ্ড গতিতে বাঁক নেওয়ার সময় উল্টে যায় ট্রেনের ইঞ্জিন। ওই বাঁকটির নাম আর্গানদেরা। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, ট্রেনের ইঞ্জিন শূন্যে উঠে এক সেকেন্ডের মধ্যে সোজা এসে ধাক্কা মারে সামনের একটি পোলে। বাকি সব ক’টি কামরা লাইন থেকে সরে গিয়ে খেলনার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়। এক একটি বগি লাফ দিয়ে প্রায় ৫ মিটার উপরে উঠে অন্য বগির উপরে গিয়ে পড়ে। দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া বগির চাপে বহু যাত্রী মারা গিয়েছেন। আগুনেও ঝলসে গিয়েছেন কেউ কেউ। ঘটনাস্থলেই বেশির ভাগ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালে পৌঁছনোর পরে মারা গিয়েছেন চার জন। দুই চালক অবশ্য অক্ষত। মৃত যাত্রীদের মধ্যেই পড়েছিলেন তাঁদের এক জন। উদ্ধারের পরে বিহ্বল অবস্থায় বলেন, “আমার জন্য ট্রেনটা লাইন থেকে ছিটকে গেল। কী করব আমি? কী করব? আশা করি কেউ মারা যাননি। আমরা তো প্রতি ঘণ্টায় ১৯০-এ চালাচ্ছিলাম।” অবশ্য তাঁর এই দাবি ঠিক নয় বলেই জানিয়েছেন তদন্তকারীরা।
মাদ্রিদ থেকে ফোনে কথা হচ্ছিল ইসিদোর ব্রাউনের সঙ্গে। দুর্ঘটনাস্থলের পাশেই একটি জায়গায় মিটিংয়ে ব্যস্ত ছিলেন তিনি। বলেন, “বিকট একটা শব্দ শুনলাম। মনে হল বিস্ফোরণ। ছুটে গেলাম বাইরে। চার দিকে কালো ধোঁয়া। এক সঙ্গে অনেকের চিৎকার, ‘বাঁচাও, আমাকে এখান থেকে বার করো।’’ সব দেখে কেঁপে উঠেছেন ইসিদোরও। তাঁর কথায়, “চার দিকে ছড়িয়ে কামরা। অগুনতি লাশ। এক জন পাগলের মতো চেঁচাচ্ছেন, ‘আমার ছেলে কোথায়?’ ট্রেনের ভাঙা জানলা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছেন কেউ কেউ। রক্তে মাখা। যেন নরক দর্শন হল।” ইসিদোরই জানান, আগুন থেকে বাঁচাতে কম্বল আর জলের বোতল নিয়ে স্থানীয়রাই যান প্রথমে। ট্রেনের ভাঙা অংশ জোড়াতালি দিয়ে স্ট্রেচারের মতো তৈরি করে আহতদের নিয়ে আসার চেষ্টা করেন তাঁরা। লাইন পড়ে যায় রক্ত দেওয়ার জন্যও। মিনিট কুড়ি পরে আসে উদ্ধারকারী দল, অ্যাম্বুল্যান্স, পুলিশ। মাদ্রিদ থেকে যাচ্ছে ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞের দল। |
এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, কী ভাবে ঘাড়ের উপরে এসে পড়া কামরার তলা থেকে টেনেহিঁচড়ে নিজেকে বার করেছেন। তাঁর কথায়, ‘‘বেরোনোর চেষ্টা করছি যখন, বুঝলাম আগুন ধরে গিয়েছে বগিতে। তবু বেঁচে গিয়েছি। কী যে ভাগ্য আমার!” সেন্ট জেমসের উৎসবে যোগ দিতে আসছিলেন এক যাত্রী। তিনি বলেন, “এক মহিলাকে দেখলাম। একটা পা হারিয়েছেন। কিন্তু কান্না-চিৎকার কিছুই নেই। ভাবলেশহীন মুখ। ঘটনার জেরে যেন বোবা।” আর এক ব্যক্তি গিয়েছিলেন আহত যাত্রীদের সাহায্য করতে। মিনিট কুড়ির বেশি থাকতে পারেননি। তাঁর কথায়, “এক যাত্রী জানতে চান, ‘আমার স্ত্রী কোথায়?’ জানতে পারলাম, তাঁর স্ত্রী বেঁচে নেই। দেহ পড়ে একটি বগিতে। কিছু লাশ টেনে বার করলাম। সেই সব মৃত ব্যক্তির সঙ্গে থাকা মোবাইল বাজছে নাগাড়ে। চার পাশে পুলিশ চিকিৎসকরাও কাঁদছেন। আর সহ্য হল না। ছুটে চলে এলাম ওখান থেকে।”
সান্তিয়াগো গিয়ে প্রধানমন্ত্রী মারিয়ানো রাখয় সমবেদনা জানিয়েছেন স্বজনহারাদের। ঘোষণা করেছেন তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক।এমনিতে স্পেনে রেল পরিষেবায় প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করা হয়। রেল-সুরক্ষার দিকটিও যথেষ্ট যত্ন নিয়ে দেখা হয়। এ বার চালকের ভুলেই দুর্ঘটনা ঘটল বলে প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে। স্পেনে ১৯৭২-এ একটি রেল-দুর্ঘটনায় ৭৭ জন মারা গিয়েছিলেন।
|