আকাশ মেঘমুক্ত থাকলেও দুশ্চিন্তার মেঘ জমেছিল দিনভর। কিন্তু সোমবার ভালয় ভালয় ভোট মিটতেই স্বস্তি ফিরল ডোমকলে। বিক্ষিপ্ত কয়েকটি ঘটনা ছাড়া এ বার ভোটের দিন অন্যরকম ডোমকলকে দেখল এলাকাবাসী।
ডোমকলের নির্বাচনী অতীত বড় সুখের নয়। সীমান্ত ঘেঁষা এই জনপদ যেমন রাজনৈতিক মিছিল-মিটিং দেখেছে তেমনই ডোমকল সাক্ষী থেকেছে মৃত্যু-মিছিলের। পোড়া বারুদের গন্ধ আর স্বজন হারাদের হাহাকারে নির্বাচন রূপান্তরিত হয়েছিল ‘বিভীষিকায়’। ভোট এলেই প্রার্থী নির্বাচনের উত্তেজনার থেকেও আতঙ্কের রেশ ছিল বেশি। ভোট তখন গণতন্ত্রের উৎসবের বদলে হয়ে গিয়েছিল মৃত্যুর উৎসব।
ভোটের আগে বোমা বাঁধতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছিলেন ৭ জন। ভোটের দিন বোমাও ফেটেছে গ্রামে গ্রামে। কয়েকটি গ্রামে চলেছে গুলির লড়াই। জখমের তালিকাটাও লম্বা। তার পরেও ডোমকলের মানুষ সোমবার রাতে লম্বা একটা নিশ্বাস ফেলেছে। ডোমকলের ভগীরথপুর হাসপাতালের চিকিৎসক আতিকুর রহমানের কথায়, “গত দুটি গ্রাম পঞ্চায়েত নির্বাচনে সরকারি হিসাবেই মৃত্যুর সংখ্যাটা ৩০ ছাড়িয়েছিল। ফলে, প্রাণহানি ছাড়া ডোমকলে যে নির্বাচন হবে এই বিশ্বাসটাই আমরা হারিয়েছিলাম। এখন মনে হচ্ছে আমরাও রাজ্যের অন্য প্রান্তের মানুষের মতোই রক্ত না-ঝরিয়ে নির্বাচন করতে পারি।”
কেবল সাধারণ মানুষ নয়, খুশি রাজনৈতিক দলের নেতা থেকে প্রশাসনের কর্তারাও। রাজ্যের অন্য প্রান্ত নিয়ে যখন প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে সোচ্চার বিরোধীরা, তখন ডোমকলের সিপিএম নেতা তথা রাজ্যের বাম সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী আনিসুর রহমানের বক্তব্য, “বিগত দুটি গ্রাম পঞ্চায়েত নির্বাচনে যা হয়েছে তা আমাদের কাছে লজ্জার। আমরা সে সময় বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করেও ওই অবস্থার পরিবর্তন করতে পারিনি। প্রশাসনকে ধন্যবাদ, তারা এ বার বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা করেছে গণ্ডগোল এড়ানোর।”
প্রায় একই সুর ডোমকলের কংগ্রেস নেত্রী শাওনি সিংহ রায়ের গলাতেও। তাঁর কথায়, “আমরা খুশি এ বার ভোটে কোনও প্রাণহানির ঘটনা না ঘটায়। মানুষ শান্তিপূর্ণভাবেই ভোট দিয়েছেন। প্রশাসনের ভাল ভূমিকা না-থাকলে এটা কখনই সম্ভব হত না।”
আর তৃণমূলের নেতা কমলেশ সেনগুপ্তের কথায়, “সিপিএম পুলিশকে কমরেড বানিয়েছিল বলেই নির্বাচন এলেই শুরু হত মৃত্যুর মিছিল। আমাদের সরকার চেয়েছে পুলিশ নিরপেক্ষ থাকুক। ফলও মিলেছে হাতে নাতে।” যদিও প্রশাসনিক মহলের একাংশের দাবি, শাসক দলের তেমন সংগঠন হয়নি ডোমকলে। সিপিএম-এর সংগঠন তলানিতে। স্থানীয় কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকলেও রাজ্য প্রশাসন ও পুলিশ তাদের বুড়ো আঙুল দেখাচ্ছে। সব মিলিয়ে ডোমকলের পুলিশ এবং প্রশাসন এ বার ছিল দলীয় লাগামহীন অবস্থায়। আর তাতেই এই ফল।
তবে চলতি বছরের নির্বাচনে ডোমকল ‘অতীতে’ না ফিরলেও দুর্ঘটনা যে ছিল না তা কিন্তু নয়। বোমাবাজি, দু’পক্ষের মধ্যে বচসা-এসব নিয়ে উত্তেজনা ছিলই। তবে তা বড় কোনও আকার নেয়নি। এর জন্য প্রশাসন সাধুবাদ জানিয়েছিল কেন্দ্রীয় বাহিনীর তৎপরতাকে। তবে বাহিনী সরে যেতেই আবার শুরু হয়েছে সংঘর্ষ। মহকুমাশাসক প্রশান্ত অধিকারী বলেন, “কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতি থাকলে যে কোনও পরিস্থিতির মোকাবিলা করতেই সুবিধা হয়। তা ছাড়া বাহিনীদের শরীরী ভাষাতেও ভয়ে থাকেন বাসিন্দারা।” জেলা পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবীর বলেন, “কেন্দ্রীয় বাহিনীর এই তৎপরতায় ডোমকল অশান্ত হয়নি। এটা যেমন আমাদের স্বস্তি দিয়েছে, সারা জেলায় যদি ঠিক এরকমই হত তাহলে আরও ভাল লাগত এঠুকু বলতে পারি।”
আগে ভোট যুদ্ধ মিটতেই বিধ্বস্ত গ্রামগুলি চেনা ছন্দে ফিরতে ফিরতে শিয়রে এসে দাঁড়াত আবারও একটি নির্বাচন। সাধারণ মানুষ চাইছিলেন মুক্তি। ভোটাররা চাইছিলেন ভরসা। প্রশাসন চাইছিল নিয়ন্ত্রণ। আর তাই ভোট শেষ হতেই চওড়া হেসে জেলা প্রশাসনের এক কর্তা জানালেন, “প্রশাসন ও সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক দলগুলি সকলেরই মিলিত প্রয়াসে ডোমকলে সুষ্ঠু ভাবে কোনও প্রাণহানি ছাড়াই নির্বাচন শেষ হল। এই সাফল্য কারও একার নয়। এর অংশীদার সকলেই। ”
আর আশঙ্কা মিথ্যা হলে কার না ভাল লাগে! |