প্রবন্ধ ৩...
‘সবাইকে মেরে ফেলবে’
সন্ধেবেলায় সেনাপতি রাজার সম্মুখে এসে দাঁড়ালেন। প্রণাম করে বললেন, মহারাজ, শৃগাল কুকুর ছাড়া এ গ্রামে কারও মুখে শব্দ শুনতে পাবেন না।
মন্ত্রী বললেন, মহারাজের মানরক্ষা হল।


শাহানারা খাতুন ক্লাস এইটের ছাত্রী। আজ মাসখানেক হল তার সমস্ত প্রাইভেট টিউশন বন্ধ। গ্রামের মাঝবরাবর যে একমাত্র পিচ-রাস্তা, তার থেকে প্রায় চার কিলোমিটার ভিতরে ওদের বাড়ি। ইছামতীর বাঁধের ধার ঘেঁষে। ইট-বাঁধানো সেই রাস্তা বর্ষায় শ্যাওলা জমে পিছল। দু’পাশে ধু ধু জল, বাগদা চাষের ভেড়ি। সন্ধ্যায় ওই পথে টিউশন পড়ে মেয়েটি একলা সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরত। কামদুনি কাণ্ডের পর ওর আব্বা-আম্মি সন্ধ্যার পর আর ওকে ওই রাস্তায় একা ছাড়তে নারাজ।
ক্লাস নাইনের শোভন মণ্ডলকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে তাকে স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। শোভন তার এক সহপাঠিনীকে প্রেমের প্রস্তাব পাঠিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে প্রকাশ্যে তার মুখে অ্যাসিড মারবে বলে শাসিয়েছে। আর হুমকি দিয়েছে, ‘পুরো কামদুনির কেস করে দেব’। মেয়েটি ভয়ে স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়েছে। শোভনকে সত্যি সত্যি তাড়ানো হয়নি বটে, তবে ইদানীং সেই পড়াশুনোয় ভাল, শান্ত আর মনোযোগী ছেলেটা কেমন যেন রুক্ষ আর একরোখা হয়ে উঠেছে, স্কুলেও আসছে কম।
ক্লাস টেনের ফার্স্ট বয় স্বপ্নদীপ মৃধা আজ চার দিন হল শহরে তার এক মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে আশ্রিত। পঞ্চায়েত ভোটের দিন থেকে তারা সপরিবারে বাস্তুচ্যুত। তার চোখের সামনে তার ঠাকুমার মাথায় টাঙির কোপ মারা হয়েছে। মাথায় ছ’টা সেলাই নিয়ে বৃদ্ধা হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। স্বপ্নদীপের বাবা-মা অনেক দূরের গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আত্মগোপন করে রয়েছেন। তাঁদের বাড়ি তছনছ করেছে রাজনৈতিক দুষ্কৃতীরা। আলমারি খুলে লুট করেছে যাবতীয় শাড়ি-গয়না। বালিশ-তোশক, মায় টিভি সেটটাও পুকুরে ছুড়ে ফেলে দিয়ে গেছে। ছেলেটার পড়াশুনো যাতে বন্ধ না হয় সেই আশায় তাকে মাস্টারমশাইয়ের হাতে তুলে দিয়ে গিয়েছিলেন তার বাবা। কিন্তু গত চার দিনে এক লাইনও পড়তে পারেনি স্বপ্নদীপ। থেকে থেকে কেবলই কেমন শিউরে শিউরে উঠছে আর বিড়বিড় করে বলছে, ‘ওরা আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে স্যর, সবাইকে মেরে ফেলবে...’
পঞ্চায়েত ভোটের পর যে দিন স্কুল খুলল, ক্লাসে ঢুকে দেখলাম জনা পনেরো ছেলেমেয়ে গুটিসুটি মেরে বসে আছে। ভয়ার্ত শুকনো মুখ। হাসি নেই, লাফঝাঁপ নেই, পরস্পরের বিরুদ্ধে নালিশের ভাণ্ডার খুলে বসা নেই। একে একে শুনলাম, কারও বাড়ি ভেঙেছে, কারও উঠোনে বোমা পড়েছে, কারও বা সারা রাত ঘুম হয়নি গুলির শব্দে। তবু ওরা স্কুলে এসেছে। এক বেলার ভরপেট খাওয়ার নিশ্চয়তা আর ঘন্টা ছয়েকের নিরাপত্তার আশ্বাস।
ওদের ওই থম মেরে সিঁটিয়ে থাকাটা সহ্য হচ্ছিল না। বললাম, ‘তোরা তোদের গ্রামে যা যা হয়েছে লিখে ফ্যাল, আমি খবরের কাগজে ছাপিয়ে দেব।’ মিথ্যে আশ্বাস পেয়ে ওরা মন খুলে লিখল। লিখল সি পি এম তৃণমূলের কথা, পুলিশের মুখে শোনা কুৎসিত গালিগালাজের কথা, লিখল সামরিক বাহিনীর নির্বিচারে লাঠি আর গুলি চালানোর কথা। অপটু হাতে লেখা, বানান ভুলে ভরা সেই লিপিগুলি এখনও আমার ব্যাগে বন্দি। একটা রক্তঝরা সময়ের জীবন্ত দলিল।
ইদানীং বড় বিপন্ন লাগে। ‘আমি মারতেও পারিনে, কাটতেও পারিনে’, শৈশবকে শ্বাসরুদ্ধ করে মারার এই হিংস্র সাম্রাজ্যে স্কুলশিক্ষকের জন্য তবে আর কোন কাজ পড়ে রইল?

(সব নাম পরিবর্তিত)


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.