সুন্দরবনে বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব নিয়ে গবেষকদের আগ্রহ প্রচুর।
কিন্তু মানুষের বেঁচে থাকার সঙ্গে তার যোগ নেই। লিখছেন
তুষার কাঞ্জিলাল |
সুন্দরবন সম্পর্কে আমার কিছু জ্ঞানগম্যি আছে, এই কথা রটে যাওয়ায় পরিবেশ বিজ্ঞানী থেকে গবেষক, প্রজেক্টকর্মী, নিয়মিত হরেক কিসিমের মানুষের সঙ্গে মোলাকাত হচ্ছে। এদের মধ্যে অনেকেই প্রাজ্ঞ বিজ্ঞ এবং বড় মাপের বিশেষজ্ঞ। তবে এঁদের একটু তাড়া থাকে সুন্দরবনে পদার্পণের প্রথম দু’দিনের মধ্যেই তাদের সুন্দরবনের তৃণমূলকে জানতে হবে এবং তৃণমূলে বিশ্ব পরিবেশে পরিবর্তনের প্রভাব কতটা দৃশ্যমান, তা দেখতে হবে। নদী এবং নদীবাঁধ, তার ইতিহাস, ভূগোল সব সংগ্রহ করতে হবে এবং দ্বীপ ও নদী-নালার আচার-আচরণের পরিবর্তন লক্ষ করতে হবে। তেমনই একটা গল্প বলি।
আমি জিজ্ঞাসু পরিবেশবিজ্ঞানীদের গাঁয়ের চায়ের দোকানে বসালাম। বললাম, এদের জিজ্ঞাসা করুন, তৃণমূলের খবর পাবেন। প্রথম জন দিন-আনা দিন-খাওয়া মজুর রৌশন আলি। বিশেষজ্ঞের প্রশ্ন: আপনি কি গত এক দশকে আপনার গ্রামের এবং আবহাওয়ার কোনও পরিবর্তন দেখছেন? রৌশন অন্য ক্ষেত্রে তার্কিক, কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তরে খানিক চুপ করে গেল। বলল, এ বারে কিছু দিনের অসহ্য গরম এবং তার পরে অঝরে বৃষ্টি আগে দেখিনি। বীজতলা ভাল হয়নি, কিন্তু রোয়ার কাজটা ভাল ভাবে হয়েছে। যদি অতিবৃষ্টি আকাশ বন্যা তৈরি না করে, প্রয়োজনের সময়ে বৃষ্টি না হয়, তা হলে ফসল কতটা ঘরে উঠবে বলা মুশকিল। |
দ্বিতীয় প্রশ্ন: বিশ্বের আবহাওয়া কি গরম হচ্ছে? উত্তর এল, তা বাবু গরমকালে তো গরম একটু হবেই। মাঝে মাঝে খুব গরম লাগে, তখন মাঠ থেকে উঠে গাছের ছায়ায় কাঁধের গামছা ঘুরিয়ে একটু হাওয়া খেয়ে ঠান্ডা হই। তা গরম আগের বছরের থেকে কম না বেশি, সে তো মনে করে রাখি নাই। আর শীতকালে গায়ের চাদরও নেই, শীতও নেই। তা শুনছিলাম, কী সব যন্তর-মন্তর নিয়ে আপনারা মেপে-ঘুরে দেখছেন। আমরা গরিবগুর্বো চাষা মানুষ, অত সব মাথায় ধরে না।
তার পরের প্রশ্ন: পৃথিবীটা ক্রমেই গরম হচ্ছে সেটা তুমি জান? বিশ্ব-উষ্ণায়ন এবং তার মারাত্মক ফল, যা তোমাদের ভোগ করতে হবে সে সম্পর্কে কি কিছু জানা আছে? রৌশনের সোজা বক্তব্য: তা পৃথিবীটা যদি গরমই হয়ে থাকে, আর তাতে যদি আমাদের ক্ষতি হয়, তবে একটা কাজ করলেই মিটে যায়। পৃথিবীকে ঠান্ডা করা। তেমন কাজ না-করা, যাতে গরম আরও বেড়ে যায়।
বিশেষজ্ঞ এই প্রথম সহজতম উষ্ণায়নের সমস্যার সমাধান খুঁজে পেলেন। পৃথিবী গরম হচ্ছে, তাকে ঠান্ডা করা। তা হলেই সব ল্যাঠা চুকে যায়। কিন্তু রৌশনের জানা নেই, পৃথিবীকে ঠান্ডা করা দরকার, এটা আমরা সবাই বুঝি। কিন্তু যে পথে সেটা করা সম্ভব, তা আমরা করছি না। বরং যাতে গরম আরও বেড়ে যায়, সে কাজগুলি করাতেই আমাদের আগ্রহ।
আমি বিশ্ব-উষ্ণায়নের জটিল তত্ত্বে ঢুকব না। উষ্ণায়ন-জনিত সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে গোটা দুনিয়া জুড়ে জ্ঞানী-বিজ্ঞানী-রাষ্ট্রনেতা তাঁরা মিলে যে গোলমাল পাকিয়ে তুলছেন, তার মধ্যেও ঢুকব না। গ্রিনহাউস এফেক্ট, গ্লোবাল ওয়ার্মিং এ সব বড় বড় বিষয়, রৌশনদের মাথায় ঢুকবে না। ঢোকাবার চেষ্টাও যে ভীষণ ভাবে করা হচ্ছে, তারও লক্ষণ দেখতে পাই না। কিন্তু রৌশনদের জানা নেই যে, এই দুনিয়া জোড়া গ্রিন বাষ্পের প্রথম বলি তাদের হতে হবে। বিশ্বের আবহাওয়া পরিমণ্ডলে পরিবর্তন দেখা দিচ্ছে এবং দেবে। রৌশনরা মাঠে কাজ করতে গিয়ে সে খবর জানবে না। গাঁয়ের পাশ দিয়ে যে-নদী বয়ে যাচ্ছে, তার জল ক্রমে বাড়তে থাকবে। নদী তার স্বাভাবিক গতি হারিয়ে ফেলবে। পাশের জঙ্গল মারণ ব্যাধিতে আক্রান্ত হবে। বনের গাছ, জন্তু-জানোয়ার, সব কিছুর মধ্যে একটা পরিবর্তন ঘটতে থাকবে। নদী থেকে যে-নালা জঙ্গলের ভিতরে ঢুকে গেছে প্রাকৃতিক কারণে, সেটা কমতে থাকবে। যে গাছপালা শুধু নোনা জলেই বাঁচতে পারে, তারা ধ্বংস হবে। তাদের পাশের জঙ্গলে অনেক প্রজাতি অবলুপ্ত হয়ে গেছে, ভবিষ্যতেও হবে। এই গরম কমানোর লড়াইতে যেমন তামাম দুনিয়ায় রাষ্ট্রপ্রধানদের, প্রকৌশলবিদদের বড় ভূমিকা আছে, রৌশনদের ভূমিকাও তার চেয়ে কম নয়। আজকাল শুনি গোটা দুনিয়া একটা গ্রাম হয়ে গেছে। যে গাঁয়ের মুরুব্বি-জ্ঞানী-গুণীরা প্রায়ই বিরাট বড় বড় সভা করছেন এবং ভবিষ্যতের সর্বনাশের সমাধানের পথ খোঁজার চেষ্টা করছেন। কিন্তু কখনও একমত হতে পারছেন না। সভাকক্ষ প্রকম্পিত হচ্ছে। সব রাষ্ট্রপ্রধানরা একে অপরের উপর গলা চড়িয়ে সমাধানের পথ বলে দিচ্ছেন, কিন্তু টলস্টয়ের উটারোহীর মতোই একটা কাজ শুধু করছেন না। তার ভার বইতে উটের কত কষ্ট হচ্ছে, উটটি কতটা ক্লান্ত হচ্ছে, তার জীবনীশক্তি কতটা ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে এ সব নিয়ে বিলাপ আকাশে-বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছেন, কিন্তু উটের পিঠ থেকে নেমে ওজনটাকে হালকা করে দিচ্ছেন না। তা হলে যে ভারটা তাদের নিজেদেরই বইতে হবে। |