কামদুনি এখন প্রতিবাদের গ্রাম। প্রতিবাদিনীদের গ্রাম। গ্রামটা বদলে গেছে। মেয়েরা বদলে গেছেন,
পুরুষরা সে বদল মেনে নিয়েছেন আর মেনে নিতে গিয়ে নিজেরাও বদলে গেছেন। |
দুপাশে ভেড়ির মাঝখান দিয়ে সরু রাস্তা। চার দিকে খালি জল আর সবুজ। কিন্তু এ কোনও ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড় নয়, কারণ গ্রামটার নাম কামদুনি। বাবলা গাছে ল্যাজঝোলা ফিঙের শোভা দেখার আগে আপনার চোখ আটকে যাবে গাছের গায়ে লাগানো পোস্টারে। ধর্ষিতা ছাত্রীর হত্যাকারীদের শাস্তি চাই, প্রতিবাদী শিক্ষকের শোকজ প্রত্যাহার করতে হবে, টুম্পা আর মৌসুমীর নিরাপত্তা দিতে হবে।
কামদুনি এখন শুধু আর ধর্ষিত, নিহত ছাত্রীর গ্রাম নয়। কামদুনি প্রতিবাদের গ্রাম। প্রতিবাদিনীদের গ্রাম। একটি ধর্ষণ, একটি হত্যা এবং তাকে কেন্দ্র করে রাজনীতির অভিঘাতে গ্রামটা বদলে গেছে। মেয়েরা বদলে গেছেন, পুরুষরা সেই বদলকে মেনে নিয়েছেন আর মেনে নিতে গিয়ে নিজেরাও বদলে গেছেন।
নইলে কী ভাবে গোটা গ্রামের মেয়েরা দিনের পর দিন মিছিলে পা মেলালেন, নেতা-মন্ত্রীদের কাছে কৈফিয়ত চাইতে শুরু করলেন, সংবাদমাধ্যমের সামনে বেরিয়ে নিজেদের ক্ষোভ উগরে দিতে লাগলেন? এবং গ্রামের পুরুষরাও এই বিপ্লবটা ঘটতে দিলেন? ঘরের বউ চৌপর দিন হাতা-খুন্তি সামলাতে সামলাতে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলবে, বাড়ির মধ্যে বাইরের লোকের আনাগোনা লেগে থাকবে, কাগজে ছবি বেরোবে আর গোটা গ্রাম সেটা সমর্থন করে যাবে? এও কি সম্ভব?
কামদুনি দেখিয়ে দিয়েছে, সম্ভব। এখনকার মতো অন্তত সম্ভব। তার পিছনে সবচেয়ে বড় কারণ একটাই। ভয়। আজ ওর সঙ্গে যা হয়েছে, কাল আমার সঙ্গে তা হতে পারে... এই ভয়। পুরুষরা সামনে দাঁড়িয়ে থেকে যে মেয়ে-বউকে বাঁচাতে পারবে, এই নিশ্চিন্তি না থাকার ভয়। রক্ষকের যে অহং ঘরের বউকে ঘরে রাখতে চায়, সেই অহং আজ ভেঙে চুর হয়ে গেছে। মেয়েরা নিজেরাই বলছেন, ছেলেরা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছে, যা অবস্থা, ওদের সামনে থেকেও তো কাউকে তুলে নিয়ে যেতে পারে, কাউকে মেরে দিতে পারে, ওরা কি বাঁচাতে পারবে? সেই জন্যে ওরা আমাদের সঙ্গে আছে। |
কামদুনি এখন তাই বদলের গ্রাম। টুম্পা, মৌসুমী সেই বদলের দুটি মুখ। তাদের ঘিরে রয়েছে সরমা, সন্ধ্যা, আশা, কাজলের মতো আরও অজস্র মুখের ভিড়। এই মুখগুলোও রোজ একটু করে বদলে যাচ্ছে। চোয়াল শক্ত হচ্ছে, গলার জোর, ভাষার বাঁধুনি বাড়ছে, সাহস আর আত্মবিশ্বাস তাদের শরীরী ভাষা বদলে দিচ্ছে, বদলে দিচ্ছে দৈনন্দিন জীবন। গত দেড় মাসে বলতে গেলে একটা দিনও যায়নি, যে দিন কামদুনিতে সংবাদমাধ্যমের পা পড়েনি। নিহত ছাত্রীর বাড়ি কোনটা? টুম্পা-মৌসুমীর বাড়ি কোনটা? এই দুটি প্রশ্ন সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়েছে সেখানে।
সেই মৌসুমী কয়ালের বাড়িতে বসে কামদুনির মেয়েদের কথা শুনছিলাম।
আমাদের জীবন আগে কী ছিল বলুন? রান্না করতাম, ঘরের কাজ করতাম, বাচ্চাদের পড়াতে বসাতাম আর টিভিতে সিরিয়াল দেখতাম।
এখন কামদুনির মেয়েরা নিয়ম করে টিভিতে খবর শোনেন। কোথায় কী ঘটছে, কে কী বলছেন, সব জানার চেষ্টা করেন। গেদে-গাইঘাটা-রানিতলা-খোরজুনা-সুটিয়া... গেদের খবরটা আর দেখছি না কেন বলুন তো? ওটা কি ধামাচাপা পড়ে গেল? এই প্রশ্নও করেন। যে মেয়েরা ক’দিন আগে জানতেন না মাওবাদী মানে কী, আজ তাঁরা শিলাদিত্য চৌধুরী, তানিয়ার নাম বলে যান।
মুখ্যমন্ত্রী যখন সিপিএম-মাওবাদী এ সব বললেন, কথাগুলোর মানে কী, সেটা আমরা কিন্তু তখন বুঝিনি। তার পর সাংবাদিকরা বলতে লাগলেন, আপনাদের মাওবাদী তকমা দেওয়া হয়েছে, মাওবাদীরা এই এই করে। তখন খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। তখনই তো শিলাদিত্য-তানিয়াদের নাম শুনলাম। শিলাদিত্যকে তো জেল খাটতে হয়েছিল। আমাদেরও যদি জেলে নিয়ে যায়, খুব ভয় পেয়েছিলাম! এখন তো আরও কত কিছুই শুনছি! আমরা অধীর চৌধুরীর সঙ্গে রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়েছিলাম বলেও কত কথা উঠছে! কী বলি বলুন তো? অন্ধ মানুষ রাস্তা পার হওয়ার সময় কি ভাবে, যে তার হাত ধরল সে সিপিএম না তৃণমূল না কংগ্রেস? আমাদের অবস্থাও তো তাই!
মৌসুমী রান্না চড়িয়ে এসেছেন। এক বার করে রান্নাঘরে যান, আবার এসে কথা বলেন। শাশুড়ি আর জা রয়েছেন, ওঁরাও যোগ দিচ্ছেন।
একদম প্রথম যে দিন রাস্তা অবরোধ হল, সে দিন ছেলেরাই সামনে ছিলেন। সাংসদ হাজি নুরুল ইসলাম পুলিশকে লাঠি চালাতে বলছিলেন। আমরা তখন হাতে ইট তুলে নিয়েছি আর ভাবছি, পুলিশ যদি মারে, ছেলেদের তো আগে মারবে। হয়তো তুলে নিয়ে যাবে, ঝামেলায় জড়িয়ে দেবে। আমরা তাই ছেলেদের বললাম, আমরা সামনে আসব। মেয়েদের উপর অত্যাচার হয়েছে, আমরা মেয়েরাই বুঝে নেব, তোমরা সরো।
খাদ্যমন্ত্রী তো বলেছিলেন, দোষীরা শাস্তি পাবে! সেটা আপনাদের আশ্বস্ত করল না কেন?
কী করে আশ্বস্ত করবে? দোষীদের পিছনে নেতা-মন্ত্রীরাই তো আছেন। তা হলে কী করে শাস্তি হবে? ওদের (অভিযুক্ত আনসারের পরিবার) অনেক পয়সা। টাকা দিয়ে ওরা কী না করতে পারে! ওই জন্যই আমরা ফাঁসির দাবি তুলেছি। ওরা তো জানেই, ওদের বাঁচানোর লোক আছে, সেই জন্যই গ্রামের মেয়ের সঙ্গে এ রকম একটা ঘটনা ঘটাতে পারল। সাধারণ মানুষ হলে কি এতটা সাহস পেত?
ফাঁসি দিয়ে কি কিছু আটকানো যাবে?
দেখুন, আমরা দুটো জিনিস চাই। এমন একটা শাস্তি হোক যেটা দেখে অন্য লোকে অন্যায় করার আগে দুবার ভাববে। আর, আনসাররা যেন আর এলাকায় ফেরার সুযোগ না পায়। ফাঁসি না হলে সারা জীবন জেলে আটকে রাখা হোক! কিন্তু এত বড় অন্যায় করার পরে সে যদি গ্রামে ফিরে আসে, সে তো নিজেকে ভগবান মনে করবে! এই জন্যই আমরা ফাঁসি চেয়েছি, যাতে সে আর কোনও খারাপ কাজ করার সুযোগই না পায়। এই কথাগুলোই দিদিকেও বলতে চেয়েছিলাম।
এই মিছিল, পোস্টার, মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে চাওয়া, এগুলো কী ভাবে সংগঠিত হল?
খুব ভেবেচিন্তে, মিটিং করে কিন্তু কিছু হয়নি। সে দিন রাতে যখন খবর এল, লাশ পাওয়া গিয়েছে, যে যে রকম অবস্থায় ছিল বেরিয়ে পড়েছিল। তার পর থেকে যখনই যা হয়েছে, সবাই ওই ভাবেই বেরিয়ে এসেছে। পোস্টার লেখার কথা কি আগে ভেবেছি কোনও দিন? আমাদের কেউ আগে এ সব কিছু করেনি। ঘর থেকে আলতার শিশি বার করে দিয়েছি, তাই দিয়েই লেখা হয়েছে।
মুখ্যমন্ত্রী যে দিন এলেন, সে দিনও তো আমরা আগে থেকে কিছু জানতাম না। উনি এসেছেন খবর পেয়ে সবাই দৌড়েছিল। অনেকেই গিয়েছিল, দিদিকে সামনে থেকে দেখবে বলে, দুটো কথা বলবে বলে। যার যা মনে হচ্ছে, সে সেটাই বলতে চেয়েছিল। কিছু ভেবেচিন্তে ঠিক করা হয়নি। ওদের (নিহত ছাত্রীর) বাড়িতে জায়গা কম, ওখানে কথা হবে না বলে আমরা ইস্কুলের মাঠে জড়ো হয়েছিলাম। তার পর দেখি, দিদি চলে যাচ্ছেন। তখন টুম্পা বলে উঠল, আমাদের কিছু বলার আছে। উনি বললেন, সব শোনা আছে, সব বোঝা আছে। তার উত্তরে টুম্পা বলে, সব যদি শোনাই আছে, তা হলে এলেন কেন? আমিও বলে ফেলেছিলাম, আপনি তো সিনেমা আর্টিস্ট নন যে, দেখে চলে যাব, আমরা কথা বলতে চাই। তখন দিদি চুপ বলে ধমকে উঠলেন, টুম্পা বলল তা হলে আপনিও চুপ!
সেই দিনটা আর আজকের দিনটার মধ্যেও অনেক তফাত।
এত লোক, নেতা-মন্ত্রী-বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিক সবাই আসেন, কথা বলেন। সারা দিন এই চলছে। এই যে রোজ সাংবাদিকরা আসছেন, আমরা কথা বলে যাচ্ছি! কেন? কারণ আমরা চাই, কামদুনি খবরে থাকুক। নজর সরে গেলেই যদি মামলাটা চাপা পড়ে যায়? ওরা যদি ছাড়া পেয়ে যায়?
আর এই যে এত ছবি, এত কথা, সবাই আপনাদের কথা জানল, সেটা ভাল লাগে না?
মৌসুমী হাসেন। তা লাগে, কিন্তু ভয় করে তার চেয়ে বেশি। আর তো লুকোতে পারব না। কেউ কিছু করবে মনে করলে নিজেকে বাঁচাতেও পারব না। কিন্তু আমাদের আর পিছিয়ে যাওয়ার উপায় নেই! কোনও রকমে একটা তরকারি-ভাত রাঁধছি, কোনও দিন শুধু আলু সেদ্ধ। এই ভাবেই তো চলছে। সারা গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে গিয়েছে। সোমত্ত মেয়েরাও ভয়ে বাবা-মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমোচ্ছে। পাঁচ-ছ’টা মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিল বাড়ি থেকে। সবাই ভাবল, পড়াশোনা করিয়ে আর কাজ নেই, বিয়ে হয়ে অন্য কোথাও চলে গেলে প্রাণে বাঁচবে। এটা চলতে দেওয়া যায় না।
কিন্তু আজ না হয় কাল তো কামদুনি খবর থেকে সরবে, সংবাদমাধ্যমের আনাগোনা বন্ধ হবে। তখন?
আনসাররা শাস্তি পেয়ে যাক, তার পর আমরা আবার পুরনো জীবনে ফিরে যাব। খালি খালি লাগবে না?
কী জানি! তবে মেয়েদের হয়ে কোথাও কোনও সমিতি বা সংগঠন যদি ডাকে, আমরা আবার কথা বলব। আজ আমাদের গ্রামের মেয়ের জন্য বলছি, অন্য কোথাও যদি একই ঘটনা ঘটে, চুপ করে তো থাকা যাবে না। সেটাই তো নিয়ম, কী বলুন? প্লেটে করে শসা কেটে আমার দিকে এগিয়ে দেন মৌসুমী। পরিবর্তন কোনও ঘটনা নয়। পরিবর্তন একটি প্রক্রিয়া। |