ভারতের বাণিজ্য খাতে ঘাটতির পরিমাণটি যে কোনও অর্থমন্ত্রীকেই বহু বিনিদ্র রাত্রি কাটাইতে বাধ্য করিবে। ঘাটতির পরিমাণ মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ৪.৮ শতাংশ হওয়া বহু মাত্রায় গভীর উদ্বেগের কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে টাকার দামের লাগাতার পতনেরও। এই ঘাটতির পিছনে একটি কারণ খুঁজিতে হইলে তর্জনী অনিবার্য ভাবেই সোনার দিকে নির্দেশ করিবে। ২০১২-১৩ অর্থবর্ষে ভারত মোট ৫৪০০ কোটি ডলার মূল্যের সোনা আমদানি করিয়াছে, যাহা দেশের বাণিজ্য ঘাটতির ৬১ শতাংশ। এই আমদানি বাদ দিলে ভারতের বাণিজ্য খাতে ঘাটতির পরিমাণ অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের দুই শতাংশেরও কম হইত। অর্থমন্ত্রীর নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটিবার কোনও সম্ভাবনাই থাকিত না। সোনা অতি আকর্ষণীয় ধাতু, সন্দেহ নাই কিন্তু জাতীয় অর্থনীতির চোখ দিয়া দেখিলে ইহা অবান্তর আমদানি। সোনায় গাড়ি চলে না, বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয় না, সোনা খাওয়াও অসম্ভব। কাজেই, বাণিজ্য ঘাটতি কমাইতে হইলে সোনা আমদানির পরিমাণেই কোপ দেওয়া বাঞ্ছনীয়। পালনিয়াপ্পন চিদম্বরম গত ছয়-সাত মাসে বহু পথে সেই চেষ্টা করিতেছেন। সোনার উপর আমদানি শুল্ক বাড়িয়াছে, অ-শুল্ক বাধানিষেধ আরোপিত হইয়াছে। সম্প্রতি রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ঘোষণা করিল, অতঃপর যত সোনা আমদানি হইবে, তাহার ২০ শতাংশ গহনা রফতানিকারকদের ব্যবহারের জন্য বিক্রয় করিতে হইবে। বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলি কেবলমাত্র গহনা প্রস্তুতকারকদের নিকট সোনা বিক্রয় করিতে পারিবে। সব মিলাইয়া দেশের বাজারে সোনার দাম বাড়িবে বলিয়াই অনুমান। তাহাতে চাহিদা খানিক কমিবে। কমাই বিধেয়। স্বর্ণবিলাসে প্রশ্রয় দিতে অর্থনীতিকে বিপন্ন করিয়া ফেলা কাজের কথা নহে।
গত চার বৎসর যাবৎ দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের প্রায় তিন শতাংশের সমমূল্য সোনা দেশের বাজারে বিক্রয় হইয়াছে। এত সোনা যায় কোথায়? গন্তব্য এক নহে, অনেক। যখন অর্থনীতির স্বাস্থ্যভঙ্গ ঘটে, তখন কোনও বিনিয়োগই আর লাভজনক থাকে না। মানুষ অভিজ্ঞতায় জানেন, সোনার দাম কমে না। ফলে, বাজারে ঝড় উঠিলে মানুষ সোনায় আশ্রয় নেয় সঞ্চিত অর্থ সোনায় জমা রাখে। দ্বিতীয়ত, যেহেতু টাকা অপেক্ষা সোনা লুকাইয়া রাখা সহজ, কালো টাকার লেনদেনে সোনার ভূমিকা ক্রমেই বাড়িতেছে। ভারতীয় অর্থনীতি যতই বদলাক, কালো টাকার মাহাত্ম্য হ্রাস পায় নাই, ফলে সোনারও বিকল্প ব্যবহারের পথ প্রশস্ত হইয়াছে। তৃতীয়ত, সোনা আর্থিক নিরাপত্তার নামান্তর। সোনা বন্ধক রাখিয়া ঋণ পাওয়া অতি সহজ। ফলে, মানুষ বিপদের সহায় হিসাবে সোনা ধরিয়া রাখিতেছেন। অস্যার্থ, সোনার বহুমুখী ব্যবহার ঠেকাইতে হইলে শুধুমাত্র শুল্ক বাড়াইলেই চলিবে না, বিকল্পের ব্যবস্থা করিতে হইবে। অর্থনীতির স্বাস্থ্য ফিরিলে অন্য বিনিয়োগগুলি যখন ফের লাভজনক হইয়া উঠিবে, তখন সোনার প্রতি আকর্ষণ খানিক কমিবে বইকী। স্বাস্থ্যোদ্ধারের কাজটিতে অর্থমন্ত্রী মন দিতে পারেন। আরও জরুরি, আর্থিক বাজারকে আরও গভীর করিতে হইবে যাহাতে মানুষের হাতে বিবিধ আর্থিক আয়ুধ তুলিয়া দেওয়া যায়। সহজলভ্য ঋণ যেমন একটি আয়ুধ, তেমনই বিমাও একটি। অর্থাৎ, মানুষ যে যে প্রয়োজনে সোনা ধরিয়া রাখিতে চাহেন, সেই প্রয়োজনগুলি বিকল্প পথে মিটাইয়া দিতে হইবে। অর্থমন্ত্রী উদ্যোগ করুন। কাজটি সহজ নহে, কিন্তু অতি জরুরি। |