জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংস্থা (এন এস এস ও) পাঁচ বছর অন্তর বড় আকারের নমুনার ভিত্তিতে, অর্থাৎ তুলনায় অনেক লোককে জিজ্ঞাসাবাদ করিয়া দেশের ভোগব্যয়ের হিসাব কষিয়া থাকে। তাহার ভিত্তিতে যোজনা কমিশনের উদ্যোগে পরিমাপ করা হয়, কোথায় কত লোক দারিদ্র রেখার নীচে রহিয়াছেন। ২০০৯-১০ সালে এই হিসাব করা হইয়াছিল। স্বাভাবিক নিয়মে আবার ২০১৪-১৫ সালে হিসাব কষিবার কথা। কিন্তু ২০০৯-১০ বছরটি খরায় আক্রান্ত ছিল, সুতরাং নীতিনিয়ন্তারা মনে করিয়াছেন, ২০১১-১২ সালে একটি বিশেষ সমীক্ষা করিয়া দারিদ্রের নূতন হিসাব কষিয়া ফেলা জরুরি। সেই হিসাব প্রকাশিত হইয়াছে। এবং তাহাতে দেখা যাইতেছে, ২০০৪-০৫ সালের তুলনায় সামগ্রিক ভাবে দারিদ্র রেখার নীচে থাকা ভারতবাসীর অনুপাত ৩৭.২ শতাংশ হইতে কমিয়া দাঁড়াইয়াছে ২১.৯ শতাংশ। সাত বছরে দারিদ্র কমিবার হার গড়পড়তা বার্ষিক ২.১৮ শতাংশ। এই সাত বছর দিল্লিতে ইউ পি এ সরকার অধিষ্ঠিত। ইহার পূর্ববর্তী এক দশকে দারিদ্র কমিবার গড় বার্ষিক হার ছিল ০.৭৪ শতাংশ। সেই দশ বছরের অধিকাংশ জুড়িয়াই কেন্দ্রে এন ডি এ শাসন করিয়াছে। অনুমান করা যায়, দারিদ্র দূরীকরণের এই উন্নততর ফলাফলকে সনিয়া গাঁধী মনমোহন সিংহরা নির্বাচনী প্রচারের সমিধ হিসাবে ব্যবহার করিতে বিশেষ ভাবে তৎপর হইবেন। তাহাতে দোষের কিছু নাই ‘শাইনিং ইন্ডিয়া’ যদি এন ডি এ’র নির্বাচনী স্লোগান হইতে পারে, (দারিদ্র রেখার উপরে) ‘রাইজিং ইন্ডিয়া’ ইউ পি এ’র স্লোগান হইবে না কেন? স্লোগানে ভোট আসিবে কি না, তাহা ভিন্ন প্রশ্ন, বাজপেয়ীজি সে সত্য মর্মে মর্মে বুঝিয়াছিলেন।
এ দেশে দারিদ্র রেখার পরিমাপ চলিতেছে ১৯৬২ হইতে, কেহ যে তাহার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের উদ্যোগ করেন নাই তাহা দরিদ্রের সৌভাগ্য বলিয়াই ধরিতে হইবে। দারিদ্রের পরিমাপ হিসাবে দারিদ্র রেখা কতটা উপযুক্ত, শুরু হইতেই তাহা লইয়া বিস্তর বিতর্ক। তথ্য বা মডেল বিষয়ক বিতর্ক আছে, বিতর্ক আছে দারিদ্রের যথাযথ ভিত্তি লইয়াও। সম্প্রতি তেন্ডুলকর কমিটির মাপকাঠি লইয়া নূতন বিবাদ বহুচর্চিত। এই পরিপ্রেক্ষিতেই নূতন বিশেষজ্ঞ কমিটি নিযুক্ত হইয়াছে। আপাতত অবশ্য যোজনা কমিশন তেন্ডুলকর কমিটির মডেল অনুসারেই দারিদ্র মাপিয়াছে। তাহা এক অর্থে ভাল দরিদ্রের সংখ্যা বিশ্বাসযোগ্য হউক বা না হউক, দারিদ্রের অনুপাত তুলনীয় হইয়াছে। বিভিন্ন রাজ্যে দারিদ্রের মাত্রা কেমন ভাবে বদলাইয়াছে, তাহার একটি ধারণা এই পরিসংখ্যান হইতে মেলে। দারিদ্র রেখা আর কিছু না হোক, তীব্র অভাবের একটি ধারণা দেয়। যোজনা কমিশন প্রকাশিত পরিসংখ্যান হইতে দুইটি বিষয় লক্ষণীয়। এক, ২০০৪-০৫ হইতে ২০১০-১১ সময়পর্বে অনেক রাজ্যেই তীব্র দারিদ্রের অনুপাত অনেকটা কমিয়াছে। এই পর্বেই যেহেতু আয়বৃদ্ধির হার রীতিমত বেশি ছিল, সুতরাং ‘আয়বৃদ্ধির কোনও সুফল দরিদ্ররা পায়নি’ বলিলে হয়তো কিছুটা ভুল হইবে। দুই, বিহারের মতো ব্যাপক দারিদ্রের রাজ্যে দারিদ্র রেখার নীচে জনসংখ্যার অনুপাত অনেকটা কমিয়াছে। ইহার দুইটি তাৎপর্য। প্রথমত, আবারও, বিহারের আয়বৃদ্ধি নিষ্ফল হয় নাই; এবং দ্বিতীয়ত, দরিদ্র রাজ্যগুলি তুলনায় ভাল করিলে রাজ্যে রাজ্যে ‘দারিদ্রের বৈষম্য’ কমিতে পারে। আপাতত ইহা সংকেতমাত্র। কিন্তু এই সংকেতগুলি যথাযথ ভাবে যাচাই করা জরুরি। উন্নয়ন, অসাম্য ও দারিদ্র লইয়া এ দেশে আলোচনা কম হয়, যাহা হয় তাহারও অনেকটাই রাজনৈতিক সওয়াল-জবাব। প্রয়োজন তথ্যভিত্তিক নিষ্পক্ষ বিচারের। যোজনা কমিশনের পরিসংখ্যান সেই উদ্দেশ্য সাধনের পক্ষে যথেষ্ট নয় মোটেও। কিন্তু তাহার ভিত্তিতে অন্তত আলোচনা শুরু হইতে পারে। শোরগোল অপেক্ষা আলোচনা শ্রেয়। |