তাদের আমলে দারিদ্র কমছে যোজনা কমিশনের তথ্যে বলিয়ান হয়ে সাফল্যের এই দাবি নিয়ে ময়দানে নেমেছে কংগ্রেস। আর সেই দাবিকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে তুমুল রাজনৈতিক দড়ি টানাটানি। এক দিকে কংগ্রেস তথা মনমোহন সিংহের সরকার। অন্য দিকে, বিজেপির নেতৃত্বে সব বিরোধী দল।
লোকসভা ভোটের এক বছরও বাকি নেই। ঠিক এই সময় যোজনা কমিশনের তথ্য প্রকাশ করে মনমোহন সরকার দাবি তুলেছে, ইউপিএ-জমানার প্রথম সাত বছরে দারিদ্র হার কমার গতি তার আগের ১১ বছরের থেকে তিন গুণ বেশি ছিল। মনমোহন-জমানার শুরুতে ২০০৪-’০৫ সালে দারিদ্রসীমার নীচে থাকা মানুষের সংখ্যা ছিল জনসংখ্যার ৩৭.২%। ২০১১-’১২ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২১.৯%-এ। আর যোজনা কমিশনের এই পরিসংখ্যান নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে বিজেপি থেকে বাম। এমনকী, এনসিপি-র মতো শরিক দলও কংগ্রেসের সঙ্গে একমত নয়। দেশে দারিদ্র কমেছে এ কথা অর্থনীতিবিদদের একটা বড় অংশও মানতে নারাজ।
যোজনা কমিশনের এই পরিসংখ্যান দেখিয়ে কংগ্রেস তথা মনমোহন-সরকার রাজনৈতিক কৃতিত্ব নিতে চেয়েছিল। দেশের অর্থনীতি ধুঁকছে। মনমোহনের অর্থনৈতিক দর্শন নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। তখন এই তথ্য দেখিয়ে অন্তত কংগ্রেস তথা ইউপিএ দাবি করতে চেয়েছিল, অন্তত দারিদ্র কমানোর ক্ষেত্রে মনমোহন-সরকার সফল। কিন্তু উল্টো দিকে পাল্টা প্রশ্নেরও অভাব নেই। বিজেপি-র প্রধান অভিযোগ, দারিদ্রসীমার নীচে থাকা মানুষের সংখ্যা কম দেখিয়ে সরকার আসলে গরিবদের সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করতে চাইছে। কারণ যোজনা কমিশনের এই পরিসংখ্যানের ভিত্তিতেই খাদ্য সুরক্ষা থেকে শুরু করে ইন্দিরা আবাস যোজনার মতো প্রকল্পের সুবিধা পাবেন গরিব মানুষরা। জেডি (ইউ) নেতা শরদ যাদবের মতো অনেকেই পাল্টা প্রশ্ন তুলেছেন, যদি মাত্র ২১.৯% দারিদ্রসীমার নীচে থাকেন, তা হলে মনমোহন-সরকার ঘটা করে ৬৭% মানুষের জন্য খাদ্য সুরক্ষা বিল আনছে কেন? বিরোধীদের অভিযোগ, সরকার এক রকম পরিসংখ্যান দেখিয়ে গরিবি হঠানোর কৃতিত্ব নিতে চাইছে। খাদ্য সুরক্ষা আইনের পক্ষে আর এক রকম পরিসংখ্যান যুক্তি হিসেবে খাড়া করছে। বর্তমান মূল্যবৃদ্ধির চড়া হার, জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান খরচের সঙ্গে এই পরিসংখ্যানের সম্পর্ক নেই। পুরোটাই রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির কৌশল।
কৌশল তা-ই হলেও যোজনা কমিশনের তথ্য কার্যত ব্যুমেরাং হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘটা করে সাফল্যের কথা জানাতে আজ যোজনা কমিশনের পরিসংখ্যান হাতে নিয়ে কংগ্রেসের সদর দফতরে সাংবাদিক সম্মেলন করতে বসেছিলেন দলের মুখপাত্র রাজ বব্বর। কিন্তু একের পর এক প্রশ্ন ওঠে, আলু যদি ৪৫ টাকা কেজি আর টোম্যাটো যদি ৬০ টাকা কেজি হয়, তা হলে দিনে ২৮ টাকা রোজগার করে কী ভাবে এক জন পেট চালাবেন? কারণ, যোজনা কমিশনের সমীক্ষা বলছে, দৈনিক কারও মাথা পিছু খরচ গ্রামে ২৭.২০ টাকা এবং শহরে ৩৩.৩৩ টাকার বেশি হলেই তিনি আর দারিদ্রসীমার নীচে নন। যা গত মার্চে ছিল যথাক্রমে ২৬ টাকা ও ৩২ টাকা। এ নিয়ে প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যান রাজ বব্বর। শাকসব্জির বাজারদর হয়তো তাঁরও জানা ছিল না। ফলে রাজ বব্বরের মতো পোড় খাওয়া অভিনেতাও অস্বস্তি লুকোতে পারেননি। কৃতিত্ব নেওয়ার সাংবাদিক সম্মেলন তাই ব্যুমেরাং হয়ে ওঠে।
কংগ্রেসের অনেক নেতা ঘরোয়া আলোচনায় মানছেন, দেশে যে দারিদ্র কমছে, তা মানুষকে বোঝানো শক্ত। এ সব বুঝিয়ে রাজনৈতিক কৃতিত্ব আদায় করাটাও মুশকিল। আবার বিজেপির সমস্যা হল, সরকারি এই সমীক্ষা বলছে, ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাতের মতো বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলিই দারিদ্রের হারের হিসেবে পিছিয়ে রয়েছে। এমনকী, রাজস্থানও গুজরাতের থেকে এগিয়ে। যোজনা কমিশনের হিসেবে, ছত্তীসগঢ়ের ৩৯%, মধ্যপ্রদেশের ৩১%, গুজরাতের ১৬%-র বেশি মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে রয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের গ্রামের জনসংখ্যার ২২.৫২% মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে। শহরে এই হার ১৪.৬৬%। সব মিলিয়ে রাজ্যের জনসংখ্যার ১৯.৮৮% বা ১ কোটি ৮৪ লক্ষ মানুষ দারিদ্রসীমার নীচে।
ভোটের বছরে দারিদ্রের হার নিয়ে যোজনা কমিশনের এই অকাল সমীক্ষা নিয়েও সংশয় তৈরি হয়েছে। মনমোহন সিংহের অঙ্গুলিহেলনে মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়া এই পরিসংখ্যান তৈরি করেছেন কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারণ, দারিদ্র নিয়ে প্রতি পাঁচ বছর অন্তত সমীক্ষা হয়। ২০০৯-’১০ সালেই সমীক্ষা হয়েছে। তা হলে এখন আবার কেন? যোজনা কমিশনের যুক্তি হল, ওই বছর মারাত্মক খরা হয়েছিল। কাজেই সমীক্ষায় ঠিকঠাক তথ্য উঠে আসেনি। তাই ২০১১-’১২ সালে ফের সমীক্ষা হয়।
আর একটি বিষয় হল, গত বছর মার্চে যোজনা কমিশন সুরেশ তেন্ডুলকর কমিটির সূত্র মেনে যে দারিদ্র সীমারেখা তৈরি করে (গ্রামে মাথাপিছু দৈনিক খরচ ২৬ টাকা ও শহরে ৩২ টাকা), তা নিয়ে দেশ জুড়ে বিতর্ক হয়। তখন প্রধানমন্ত্রীর আর্থিক উপদেষ্টা পরিষদের প্রধান সি রঙ্গরাজনের নেতৃত্বে কমিটি তৈরি করে নতুন দারিদ্রসীমা তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু এখন যোজনা কমিশন যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তা পুরনো কমিটির সূত্র মেনেই। অনেক অর্থনীতিবিদই মনে করেন, তেন্ডুলকর কমিটি দেশে দারিদ্রের সমস্যা অনেকটাই লঘু করে দেখেছিল। তাই দারিদ্রসীমা এত নীচে নেমে এসেছে। আর তার ফলে বহু মানুষই সরকারি খাতায় দারিদ্রসীমার উপরে বলে বিবেচিত হচ্ছেন। সর্বোপরি, এই সমীক্ষায় শেষ অর্থ বছরের তথ্য নেই। ২০১২-’১৩ সালে আর্থিক বৃদ্ধির হার ৫%-এ নেমেছে। তাই সরকারি সূত্র মানলেও ওই বছরে দারিদ্র কমার হার অনেক কম হতো। যে যুক্তি মানছে যোজনা কমিশনও।
বিজেপি মুখপাত্র প্রকাশ জাভড়েকরের অভিযোগ, “সরকার আসলে দারিদ্রসীমার সংজ্ঞা বদলে দিয়ে দেখাতে চাইছে, অনেক মানুষ গরিব থেকে ধনী হয়ে উঠেছে। কংগ্রেস নেতাদের চ্যালেঞ্জ করছি, কী ভাবে ৩৪ টাকায় কেউ পেট চালাতে পারেন, তা প্রমাণ করে দেখান।” বামেরা বলছেন, ইউপিএ সরকার আসলে অর্জুন সেনগুপ্ত কমিটির রিপোর্ট ভুলিয়ে দিতে চাইছে। ওই কমিটি বলেছিল, দারিদ্রসীমার নীচে থাকা মানুষের সংখ্যা ৭০ শতাংশ। পলিটব্যুরো নেত্রী বৃন্দা কারাটের বক্তব্য, “পরিসংখ্যান দিয়ে পেট ভরে না। বাস্তবের সঙ্গে এই তথ্যের
জমিন-আসমানের ফারাক।” কংগ্রেস মুখপাত্র রাজ বব্বর যুক্তি দেওয়ার
চেষ্টা করেছেন, “সরকার তো হতদরিদ্রদের জন্য খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্য সব কিছুরই দায়িত্ব নিচ্ছে। মুম্বইয়ে এখনও ১২ টাকায় ডাল-ভাত খাওয়া যায়। আর শহরে শাকসব্জির দাম বেশি হতে পারে। গ্রামের মানুষ তো নিজের বাগানের সব্জিই পেয়ে যান।” শহরের অন্দরমহলেই যে কংগ্রেসের এই যুক্তি নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে, তা-ও আজ স্পষ্ট হয়ে
গিয়েছে। এনসিপি নেতা তথা কেন্দ্রীয় ভারী শিল্পমন্ত্রী প্রফুল্ল পটেল বলেন, “আমরা এই পরিসংখ্যানের সঙ্গে একমত নই। দারিদ্রসীমার এই সংজ্ঞাটাই ভুল। যোজনা কমিশনের উচিত, মূল্যবৃদ্ধির হার এবং জীবনযাত্রার খরচকে মাথায় রেখে দারিদ্রসীমার নতুন সংজ্ঞা তৈরি করা।”
|