এই বাড়ি পরিচিত ‘মহানায়কের বাড়ি’ নামেই। হাওড়ার জগৎবল্লভপুরের গোহালপোতা গ্রামে তিনতলা পাকা বাড়িটি সংস্কারের অভাবে বেশ জীর্ণ হয়ে পড়েছে। সামনের উঠোন শুনশান। এই বাড়ির বাসিন্দারা বর্তমানে কলকাতায় থাকেন। কিন্তু আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগেও এই বাড়ির চেহারা ছিল আলাদা। বছরের অধিকাংশ সময় সিনেমার অভিনেতা, অভিনেত্রীদের ভিড়ে গমগম করত পুরো চত্বর। আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতেন অবশ্যই উত্তমকুমার।
গোহালপোতার সঙ্গে জড়িত চণ্ডীমাতা ফিল্মস-এর নাম। এই গ্রামেরই বাসিন্দা সত্যনারায়ণ খান পারিবারিক তেলকলের ব্যবসা ছেড়ে নাম লিখিয়েছিলেন সিনেমা শিল্পে। গড়ে তুলেছিলেন সিনেমা প্রদর্শন এবং প্রযোজনা সংস্থা চণ্ডীমাতা ফিল্মস। তাঁর সংস্থা প্রয়োজিত বা পরিবেশিত অধিকাংশ ছবির আউটডোর শ্যুটিংয়ের জন্য সত্যনারায়ণবাবু বেছে নিয়েছিলেন নিজের গ্রাম গোহালপোতাকেই। সেই সুবাদে গোহালপোতায় বার বার এসেছিলেন মহানায়ক।
|
‘সন্ন্যাসী রাজা’ ছবিতে উত্তমকুমার। —ফাইল চিত্র। |
কলকাতা থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গোহালপোতাকে তখন গণ্ডগ্রামই বলা যেত। কিন্তু গ্রামের মানুষের সহজ-সরল ব্যবহার, বাংলার অন্যান্য গ্রামের মতো এখানকার চিরাচরিত আটচালা, বিশাল বটগাছের ছায়া সবই মুগ্ধ করেছিল মহানায়ককে। তিনি প্রথম এই গ্রামে এসেছিলেন ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’ ছবিতে কাজের সূত্রে। শেষবার তিনি এসেছিলেন সাতের দশকের শেষে সুখেন দাসের ‘প্রতিশোধ’ ছবির শ্যুটিং করতে। এর মাঝে কুড়ি বছর ধরে টানা যাতায়াত করেছেন বনপলাশির পদাবলি, সন্ন্যাসী রাজা, অপরিচিত, হার মানা হার, ধন্যি মেয়ের মত অন্তত ৩০টি ছবির শ্যুটিং-এর সূত্রে। এইসব ছবির নানা দৃশ্যে নিজেদের গ্রামকে দেখতে পেয়ে গর্বিত হন গোহালপোতার বাসিন্দারা।
মহানায়ক যখন প্রথম প্রথম আসতেন তখন সত্যনারায়ণবাবুর দোতলা পুরনো পাকা বাড়িতেই থাকতেন। পরবর্তীকালে যখন তিনি মহানায়কে পরিণত হলেন তখন শুধুমাত্র তাঁর জন্যই তিনতলা বিলাসবহুল নতুন বাড়ি তৈরি করেছিলেন সত্যনারায়ণবাবু। তখনকার দিনে এই বাড়িতে কলকাতার প্রথম শ্রেণীর হোটেলের মানে স্বাচ্ছ্যন্দের ব্যবস্থা করেছিলেন তিনি। এখনও তার কিছু কিছু নিদর্শন পাওয়া যাবে বাড়িটিতে গেলে।
শ্যুটিং ছাড়াও এই বাড়িতে এসে বহুবার থেকেছেন উত্তমকুমার। ১৯৮০ সালের ২৪ জুলাই চিরবিদায় নিয়েছেন মহানায়ক। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে গোহালপোতার মানুষের কাছে স্মৃতি হয়ে থেকে গিয়েছে ‘ধন্যি মেয়ে’ ছবির খেলার মাঠ ‘হাড়ভাঙা’, ‘বনপলাশীর পদাবলি’ ছবির সেই স্নানের ঘাট, ‘সন্ন্যাসী রাজা’ ছবির সেই পাকুড় গাছতলা, ‘হার মানা হার’ ছবির কানা নদীর বাঁধ।
|
সত্যনারায়ণ খানের সেই স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি। —নিজস্ব চিত্র। |
উত্তমকুমার এবং অন্য চিত্রতারকাদের শ্যুটিং দেখার স্মৃতি আজও ভেসে ওঠে প্রবীণ গ্রামবাসীদের মনে। গ্রামের এক প্রবীণ বাসিন্দা অমর চক্রবর্তী বলেন, “তখন আমার শ্যুটিং দেখার খুব ঝোঁক ছিল। অভিনেতাদের সঙ্গে কথা বলতাম আর তাসও খেলতাম আমরা। তবে উত্তমকুমার একটু অন্যভাবে থাকতেন, সবার সঙ্গে খুব একটা মিশতেন না।” গোহালপোতার পাশেই পাতিহালের বাসিন্দা দেবাশিষ ঘোষ বলেন, “আমার তখন ১০ অথবা ১১ বছর। মায়ের সঙ্গে ‘বনপলাশীর পদাবলি’র শ্যুটিং দেখতে যেতাম। একদিন শ্যুটিং সেরে যখন উত্তমবাবু গাড়িতে বসেছিলেন, তখন গাড়ির কাছে এগিয়ে গিয়ে কথা বলেছিলাম তাঁর সঙ্গে। সেই দিনটার কথা ভুলব না।”
সত্যনারায়ণবাবুর পুত্রবধূ মৃদুলা দেবীর উপরে ছিল এই বাড়িতে মহানায়ক এলে তাঁর আতিথেয়তায় যাতে কোনও ত্রুটি না-হয় তা দেখা। তিনি বলেন, “১৯৭০ সালে আমার বৌভাতের দিনে প্রথম উত্তমকুমারকে দেখি। এ ছাড়াও এসেছিলেন সন্ধ্যা রায়-সহ অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী।” তিনি আরও বললেন, “বনপলাশির পদাবলীর শ্যুটিং হয়েছিল আমার বাপের বাড়ি বোড়লে। আমার বাবার অনুরোধে সুটিং করতে এসে বাপের বাড়িতে ইউনিটের লোকজনকে নিয়ে পাত পেড়ে খেয়েছিলেন।” এমন বহু স্মৃতি ছড়িয়ে রয়েছে গ্রামবাসীদের মনেও।
তিনতলা বাড়িটি বর্তমানে জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে রয়েছে। বহুদিন বন্ধ হয়ে গিয়েছে শ্যুটিং। গ্রামে নেই কোনও চিত্রতারকার আনাগোনা। বাড়িটি উত্তমকুমারের স্মৃতি হিসাবে থেকে গিয়েছে গ্রামবাসীদের মনে। জগৎবল্লভপুরের বিধায়ক আবু কাশেম মোল্লা অবশ্য বললেন, “উত্তমকুমারের স্মৃতি বিজড়িত ওই বাড়িটি এবং গোহালপোতা গ্রামকে কেন্দ্র করে পর্যটন কেন্দ্র গড়ার চেষ্টা করব।” |