কংগ্রেস আমলে পুরস্কার ছিল একটি। পেতেন বড়জোর তিন জন। বাম জমানায় পুরস্কার বাড়ল। প্রাপকের সংখ্যাও বেড়ে হল জনা পঁচিশ। এখন বছরে অন্তত ২০০ জনকে বিভিন্ন পুরস্কার দিচ্ছে তৃণমূল সরকার।
তথ্য-সংস্কৃতি দফতর সূত্রের খবর, রাজ্যের প্রাচীনতম সরকারি খেতাব হল রবীন্দ্র পুরস্কার। পঞ্চাশের দশকে যার শুরু হয়েছিল বিধানচন্দ্র রায়ের সরকারের হাত ধরে। রবীন্দ্র পুরস্কার একসঙ্গে তিন জনের বেশি পাননি কোনও দিন। বাম আমলেও মোটামুটি এই ধারাই অনুসৃত হয়েছিল। তবে রবীন্দ্র পুরস্কারের পাশাপাশি আরও বেশ কিছু পুরস্কার চালু করেছিল বাম সরকার। বঙ্কিম-লালন-নজরুল-বিদ্যাসাগর-অবনীন্দ্র পুরস্কার-সহ মোট পুরস্কারের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় পঁচিশে। কিন্তু তৃণমূল আমল থেকে সরকারি পুরস্কারের রীতিমতো বিস্ফোরণ দেখা গেল বলে মানছেন সরকারি কর্তারাই। বুধবার তো একা উত্তমকুমারের নামেই ৫০ জন পুরস্কার পেলেন। সারা জীবনের অবদানের জন্য পাঁচ জন, মহানায়ক পুরস্কার দু’জন, বিশেষ পুরস্কার দু’জন এবং এ ছাড়া বিভিন্ন ক্যাটিগরিতে নবীন-প্রবীণ মিলিয়ে আরও ৪১ জন পুরস্কার পেয়েছেন।
এ ছাড়াও সারা বছর ধরে রয়েছে বঙ্গভূষণ, বঙ্গবিভূষণ, সঙ্গীতসম্মান, মহাসঙ্গীতসম্মান, কৃষকরত্ন, বিডিওরত্ন, চিকিৎসা-সম্মানের মতো আরও অনেক খেতাব বিতরণ। প্রাপকের তালিকা লম্বা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ছে খরচের বহরও। বিধান রায়ের আমলে পুরস্কার বাবদ সরকারের খরচ ছিল কয়েক হাজার টাকা। বাম আমলে কয়েক লক্ষ। এখন সেটাই দাঁড়িয়েছে কয়েক কোটিতে।
দু’বছর আগে বাম আমলে তথ্য-সংস্কৃতি দফতরের বাজেট ছিল ৪০ কোটি। চলতি আর্থিক বছরে সেটা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে পুরস্কার বাবদ খরচ বরাদ্দ হয়েছে তিন কোটি। এ দিন উত্তমকুমার পুরস্কারের মোট অর্থমূল্য ছিল ৫৭ লক্ষ টাকা। নজরুল মঞ্চের
ওই অনুষ্ঠানের মঞ্চসজ্জা থেকে আনুষঙ্গিক অন্যান্য ব্যয় ছিল আরও অন্তত ৫০ লক্ষ। |
খেতাবনামা |
• কংগ্রেস আমল ছিল রবীন্দ্র পুরস্কার প্রাপক সর্বোচ্চ ৩
• বামফ্রন্ট আমল জুড়লো বঙ্কিম, লালন, সুধী প্রধান, ভানু ভক্ত, নজরুল,
বিদ্যাসাগর, দীনবন্ধু, আলাউদ্দিন, অবনীন্দ্র, উপেন্দ্রকিশোর পুরস্কার প্রাপক সর্বোচ্চ ২৫
• তৃণমূল আমল জুড়লো বঙ্গভূষণ, বঙ্গবিভূষণ, সঙ্গীত-সম্মান, মহাসঙ্গীত-সম্মান,
চিকিৎসা-সম্মান, কৃষকরত্ন, বিডিওরত্ন-সহ নানাবিধ পুরস্কার প্রাপক অন্তত ২০০ |
|
পুরস্কারের এই ছড়াছড়ি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিরোধীরা। তাঁদের অভিযোগ, যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কথায় কথায় সরকারি কোষাগারের হাড়ির হাল নিয়ে সরব হন, তিনিই পুরস্কারের নামে এত টাকা ওড়াচ্ছেন কোন যুক্তিতে। পাশাপাশি, এই পুরস্কার-সংস্কৃতির পিছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে বলেও তাঁদের দাবি। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সরকারের তথ্য-সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী সৌমেন্দ্রনাথ (অঞ্জন) বেরা যেমন বললেন, ‘‘আমাদের আমলে বছরে সর্বোচ্চ ২৫ জন সম্মান পেতেন। খরচও হতো সামান্যই। কিন্তু এখন এ সব আসলে কোনও পুরস্কার দেওয়া নয়। মূল লক্ষ্য হচ্ছে, কিছু পাইয়ে দিয়ে একটি অনুগত শ্রেণি তৈরি করা।”
মমতা-ঘনিষ্ঠ শিল্পী, শুভাপ্রসন্নর পাল্টা অভিযোগ, পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি শুরু করেছেন বামেরাই। “বাম আমলে শুধু পুরস্কার প্রাপকের রাজনৈতিক ঝোঁকই দেখা হত না। তার পূর্বপুরুষেরাও বামপন্থী কি না, তাই দেখে তবে পুরস্কার দেওয়া হত।” বরং শুভাপ্রসন্নর দাবি, মমতার আমলে আমরা-ওরা করা হয়নি। এ দিনের অনুষ্ঠান থেকেই উদাহরণ নিয়ে তিনি বলেন, “মমতা তো সবার জন্যই দরজা খুলে দিয়েছে। এই চিন্ময় রায়, কিছু দিন আগে অবধি মমতার বিরুদ্ধে কুৎসা করেছেন। মমতাশঙ্কর, পরিবর্তনের ব্যানারে ছবি ছাপায় আপত্তি করেছেন। তাঁদেরও তো দেখলাম পুরস্কার নিতে।”
বামেদের দাবি, তাঁদের সময়ে বিভিন্ন সরকারি কমিটিই পুরস্কার প্রাপকদের তালিকা তৈরি করত। প্রশাসন তাতে নাক গলাত না। ইদানীং সবই মুখ্যমন্ত্রীর অঙ্গুলিহেলনে হচ্ছে বলে তাঁদের অভিযোগ। অঞ্জনবাবু বলেন, “আমাদের সময়ে পুরস্কার-প্রাপকদের সরকার নির্বাচন করত না। বিভিন্ন অ্যাকাডেমি, পর্ষদ বা সংস্থার বিশেষজ্ঞরা প্রাপক ঠিক করতেন। এখন তো এক জনের ইচ্ছে-অনিচ্ছের উপরে পুরস্কার কে পাবেন, তা ঠিক হচ্ছে।”
তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন, আগে ১১-১২টি পুরস্কারের জন্য ২০-২৫ জনকে বাছাই করা হতো। এখন তার উপরে আরও পাঁচ-সাতটি নতুন পুরস্কার চালু হয়েছে। কিন্তু পুরস্কার প্রাপকের সংখ্যা নির্দিষ্ট করা হয়নি। ফলে, এক-একটি পুরস্কারের জন্য ৪০-৫০ জনকেও বাছাই করা হচ্ছে। যিনি মাস কয়েক আগে বঙ্গভূষণ পেয়েছেন, তিনিই ফের উত্তমকুমার পুরস্কার পাচ্ছেন। সরকারি এক কর্তার কথায়, “এত বেশি সংখ্যক পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে যে, নতুন লোক খুঁজে বার করতে নাভিশ্বাস উঠছে।”
|