তাণ্ডবের চিহ্নটা খুব স্পষ্ট!
স্কুলের প্রায় প্রতিটা ক্লাসঘরের দরজা খোলা। কোনও ঘরের তালা ভাঙা হয়েছে। কোথাও ধাক্কা মেরে ভেঙে দরজার ছিটকানি বা খিল ভেঙে ফেলা হয়েছে। ক্লাসঘরগুলিতে এবং স্কুল চত্বরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে মদের বোতল। একটি বৈদ্যুতিক বাল্বও অবশিষ্ট নেই।
চতুর্থ দফা ভোটের কাজে বীরভূম জেলায় আসা হাওড়া ও কলকাতা পুলিশ বাহিনীর এহেন ‘দৌরাত্ম্যে’ বুধবার পঠনপাঠনই পুরোপুরি বন্ধ থাকল দুবরাজপুরের স্কুল সারদেশ্বরী বিদ্যামন্দির ফর গার্লসে। এ দিন উপস্থিত প্রায় ৭০০ ছাত্রীকে ক্লাস না করিয়েই বাড়ি ফিরিয়ে দেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। তাণ্ডবের শিকার হয়েছে মুরারই থানা এলাকার চাতরা গণেশলাল উচ্চ বিদ্যালয়ও। সেখানেও প্রতিটি ক্লাসঘরের দরজা খুলে, বেঞ্চ, চেয়ার ভেঙে দিয়ে গিয়েছেন ভোটের কাজে ওই স্কুলে আশ্রয় নেওয়া পুলিশকর্মীরা। শুধু তাই নয়, স্থানীয় এক শিক্ষকের কাছ থেকে চাবি নিয়ে এসে প্রধান শিক্ষকের ঘর খুলে কাগজপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেওয়া, স্কুলের দুই নৈশপ্রহরীকে মারধর করা এবং যত্রতত্র মদের বোতল ফেলে রেখে পরিবেশ নষ্ট করার অভিযোগও উঠেছে পুলিশ কর্মীদের বিরুদ্ধে। তবে সারদেশ্বরী স্কুলের মতো গোটা দিন পঠনপাঠন বন্ধ না থাকলেও টিফিনে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে ছাত্রদের।
দুই স্কুল কর্তৃপক্ষই স্থানীয় থানা ও প্রশাসনের কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ দায়ের করেছেন। জেলা পুলিশ সুপার মুরলীধর শর্মা বলেন, “অভিযোগ পেয়েছি। যত দ্রুত সম্ভব স্কুলগুলিতে স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট থানার ওসিদের নির্দেশ দেওয়া হয়ছে।” |
ক্লাসরুমে পড়ে রয়েছে মদের বোতল। —নিজস্ব চিত্র। |
জেলা পুলিশ সূত্রের খবর, দুবরাজপুরে মেয়েদের স্কুলটিতে ছিলেন হাওড়া রেল পুলিশের ১৭০ জন কর্মী। মুরাইয়ের স্কুলটিতে রাখা হয়েছিল কলকাতা পুলিশের ১৭০-১৭৫ জলের দলকে। পুলিশকর্মীরা স্কুল ছেড়ে চলে যাওয়ার পর বুধবার সকালে দুবরাজপুর রামকৃষ্ণ আশ্রম পরিচালিত মেয়েদের স্কুলে এসে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন আশ্রমের সম্পাদক স্বামী সত্যশিবানন্দ। তাঁর কথায়, “স্কুলটিকে নরকে পরিণত করে দিয়ে গিয়েছেন পুলিশকর্মীরা!” সঙ্গে সঙ্গে তিনি বিষয়টি প্রশাসনের নজরে নিয়ে আসেন। খবর পেয়ে তাড়াতাড়ি স্কুলে পৌঁছন প্রধান শিক্ষিকা সুপ্তী রায়। তিনি বলেন, “আমার স্কুলের ২৭টি ঘরের মধ্যে ওঁদের থাকার জন্য আটটি ঘর খুলে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু, শুধু অফিস ও স্টাফরুম ছাড়া প্রত্যেকটি ঘরের দরজা ভেঙে যাচ্ছেতাই কাণ্ড ঘটিয়ে গিয়েছেন ওই পুলিশকর্মীরা। বাদ যায়নি স্কুলের শৌচাগারগুলিও।” সুপ্তীদেবীর আক্ষেপ, “এর আগেও বহুবার ভোটের কাজে এসে পুলিশ এখানে ছিল। কিন্তু, এমন ঘটনা এই প্রথম। ক্লাস চালানোর পক্ষে পরিস্থিতি এতটাই প্রতিকূল ছিল যে, ছাত্রীরা এলেও তাদের ফেরত পাঠাতে আমরা বাধ্য হই।”
প্রায় একই অভিযোগ করেছেন গণেশলাল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক দোস্ত মহম্মদ। তিনি বলেন, “স্কুলের একটি অংশ কলকাতা পুলিশের কর্মীদের থাকার জন্য প্রশাসন নিয়েছিল। ভোটের কাজে এসে আইনের রক্ষকেরাই কোনও স্কুলে এ ধরনের দৌরাত্ম্য চালাতে পারেন, এমন ধারণা ছিল না! স্কুলের ছাত্ররাই কিছু মদের বোতল বাইরে ফেলেছে। বেঞ্চ-চেয়ার-টেবিল ভেঙে ঠিক কতটা ক্ষতি ওঁরা করেছেন, এখনও হিসাব করতে পারিনি।”
বীরভূম জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, “যেখানে যেখানে হাওড়া বা কলকাতা পুলিশের ফোর্স ছিল, থাকার ব্যবস্থা নিয়ে সমস্যা বা বায়নাক্কা সবচেয়ে বেশি ছিল ওঁদেরই। সেটা নিয়ে কার্যত হিমসিম খেতে হয়েছে জেলা পুলিশ-প্রশাসনকে। কেন্দ্রীয় বাহিনী নিয়ে এ ধরনের সমস্যা হয়নি।” ওই কর্তার ক্ষোভ, “ভোট শেষে মঙ্গলবার বিকেলের পর থেকেই চূড়ান্ত অভ্যবতা করেছেন হাওড়া ও কলকাতার ওই পুলিশকর্মীরা। যে থালায় খেয়েছেন, সেই থালাই ভেঙেছেন। তবু, বচসায় না জড়িয়ে ভোটের কাজ উতরানোর জন্যই চুপ থাকতে হয়েছে।” |