বর্ষার যাতায়াত দুর্ভোগের কারণে কারখানা থেকে দুটি শ্রমিক বস্তিতে যাওয়ার একটি পাকা রাস্তা চেয়েছিলেন শ্রমিকরা। বাগান কর্তৃপক্ষ সেই রাস্তার কাজও শুরুও করে। যদিও ১৪ বছর ধরে, রাস্তা থমকে ১ কিলোমিটারে। বাকি ২ কিলোমিটার হয়নি। শ্রমিকরা জানালেন, ১৯৯৮-এ শুরু হয় রাস্তার কাজ। সে বছরই চা বাগানে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা শুরু হয়। এর পরেই বাগানের কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেয়, বাকি রাস্তার কাজ করবে গ্রাম পঞ্চায়েত।
চা বাগানে জলের ব্যবস্থা করতে কোম্পানি অফিসে দল বেঁধে দরবার করেছিলেন ডান-বাম সব সংগঠনেরই চা শ্রমিকরা। কোম্পানি অফিস থেকে জানানো হয় সংশ্লিষ্ট গ্রাম পঞ্চায়েতের পক্ষ থেকেই জলের ব্যবস্থা করা হবে। দল বেঁধে ফের সকলে গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসে। সেখান থেকে জানানো হয়, চা বাগানের মালিকের ছাড়পত্র চাই। মালিকের তরফে ছাড়পত্র দেওয়ার আগে জানতে চাওয়া হয় নানা তথ্য। তা নিয়ে ফাইল চালাচালি চলছেই।
ঘটনা দুটি জলপাইগুড়ি জেলার করলা ভ্যালি ও শিকারপুর বাগানের। প্রায় একই অবস্থা ডুয়ার্সের শতাধিক চা বাগানের। পঞ্চায়েতের আওতায় গিয়ে নানা কার্ড পাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। কিন্তু, পানীয় জল, রাস্তা, বিদ্যুৎ পরিষেবার ব্যবস্থা নিয়ে অনেক জায়গায় ঠেলাঠেলি চরমে উঠেছে। অথচ চা বাগান পঞ্চায়েতের আওতায় আসার আগে ওই সব কাজ করতে হত বাগান কর্তৃপক্ষকে। তা করার ব্যাপারে দায়বদ্ধ ছিলেন তাঁরা। এখন দু-তরফের চাপানউতোরে অনেক পরিষেবা পেতে হয়রানি যেন বেড়ে গিয়েছে।
বাগানের শ্রমিক পরিবারের লোক প্রার্থী হলেও পরিস্থিতি পাল্টাবে বলে অনেকেই আশা করেন না। যেমন, করলা ভ্যালি চা বাগানের শ্রমিক তথা আদিবাসী নেতা রাজু সাহানি বলেন, “শ্রমিক লাইন থেকে এক মহিলাকে ভোটে দাঁড় করিয়েছি। উনিই জিতবেন। কোম্পানি আর পঞ্চায়েতের ঠেলাঠেলি কি বন্ধ হবে?” শিকারপুর বাগানের সুপারভাইজার পুষণা ওঁরাও বলেন, “কখনও মনে হয় পঞ্চায়েত হয়ে ভাল হয়েছে। বিপিএল কার্ড, নানা সুবিধা পাচ্ছি। জল, বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাট সারানো নিয়ে পঞ্চায়েত-মালিকের টালবাহানায় মনে হয় আগেই ভাল ছিলাম। বাগান ম্যানেজার আর পঞ্চায়েত প্রধানের ঠেলাঠেলি কবে দূর হবে!”
রাজ্যে ১৯৭৮-এ ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালুর দু’দশক পরে, ১৯৯৮-এ চা বাগানকে এর আওতায় আনা হয়। শ্রমআইন অনুযায়ী বাগানের শ্রমিকদের জন্য জল, স্বাস্থ্য পরিষেবা, বিদ্যুৎ, শ্রমিকদের থাকার বাড়ি-ঘর, বাগানের ভেতর চলাচলের রাস্তা তৈরির দায়িত্ব ছিল মালিকপক্ষের ওপরে। পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় আওতায় আসার পরে একই পরিষেবা পাওয়ার জন্য দুটি কর্তৃপক্ষ তৈরি হয়। প্রবীণ বামপন্থী চা শ্রমিক নেতা চিত্ত দে-র কথায়, “আগে বাগান কতৃর্পক্ষ মৌলিক পরিষেবাগুলি দিতে আইনত দায়বদ্ধ ছিল। এখন অনেকে পরিষেবা না দিয়ে পঞ্চায়েত করবে বলে দায় সারছেন। গ্রাম পঞ্চায়েতও বাগানের নানা পরিষেবা দিতে বাগান কর্তৃপক্ষ দায়বদ্ধ বলে জানিয়ে গ্রামে যেখানে ভোট বেশি সেখানে সুবিধে পাইয়ে দিচ্ছে। দুই কর্তৃপক্ষের দায়িত্বের ধূসর জায়গা তৈরি হয়েছে।”
বাগানে পঞ্চায়েত পরিষেবা চালুর পরে ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পে উপকৃত হওয়ার কথা জানিয়েছেন কালচিনি থেকে জলপাইগুড়ি সদর, সব এলাকার বাগান শ্রমিকরাই। গ্রাম পঞ্চায়েতের থেকে নানা চা বাগানে প্রকল্পে নিকাশি ব্যবস্থা তৈরি করা, কুঁয়ো খোঁড়া সহ অন্য কাজ চলছে। চা বাগানের শ্রমিক পরিবারের সদস্য যাঁরা চা বাগানের কর্মী নন, তাঁদেরও উপাজর্নের ব্যবস্থা হয়েছে বলে শ্রমিকরা জানিয়েছেন।
আর একটি সমস্যা আছে বাগানে। ফরওয়ার্ড ব্লকের জলপাইগুড়ি জেলা সম্পাদক প্রবাল রাহা বলেন, “অনেক সময়েই বাগানে তৈরি রাস্তা বা জলের একটি প্রকল্পকেই কুমির-ছানার মতো এক বার পঞ্চায়েতে বরাদ্দ দেখানো হয়, পরে বাগান অফিসের ম্যানেজারের খাতাতেও তা বরাদ্দ করা হয়। এই দুর্নীতিও চা শ্রমিকদের বঞ্চিত হওয়ার একটি অন্যতম বড় কারণ।” বীরপাড়া-মাদারিহাট পঞ্চায়েত সমিতির বিদায়ী সভাপতি আরএসপি-র বিকাশ দাস বলেন, “চা বাগানে ইন্দিরা আবাসের ঘর অথবা শিশু বিকাশ কেন্দ্র তৈরি করার কাজে সম্মতি পাইনি।” যদিও চা বাগান মালিক সংগঠন ডিবিআইটিএ-র সচিব প্রবীর ভট্টাচার্য, আইটিপিএ-র সচিব অমিতাংশু চক্রবর্তী দাবি করেন, “কোনও কাজ ছাড়পত্রের জন্য আটকে থাকার কথা নয়। চা বাগান কর্তৃপক্ষ শংসাপত্র দিয়ে দিচ্ছেন। অনেক সময়ে পঞ্চায়েত সমিতি কাজ না করতে পেরে বাগান মালিকের ঘাড়ে দোষ চাপায়।”
জেলা পরিষদের বিদায়ী সভাপতি দীপ্তি দত্ত বলেন, “সব পক্ষকে বৈঠকে অনেক ক্ষেত্রে কাজ হয়েছে, আবার অনেক ক্ষেত্রে কোনও ফল মেলেনি।”
অন্তহীন ঠেলাঠেলি নজর এড়ায়নি চা বাগানের নতুন প্রজন্মের। গয়েরকাটা বাগানের কলেজ পড়ুয়া নওনিত কুজুর, নাংডালার প্রফুল্ল লাকড়া, তাসাটির মনিতা ওরাওঁ বলেন, “ভোট হয়তো দেব। পঞ্চায়েত চালু করে কতটা লাভ হল সেই প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে। চা বাগানের পঞ্চায়েত সদস্যরা যাতে কাজ করতে পারেন, তেমন আইন হওয়া দরকার।” |