প্রবল বৃষ্টিও ঢাকতে পারছিল না তীব্র পোড়া গন্ধটা।
পর-পর বাড়িগুলো পুড়ে ছাই। কোথাও একটি দেওয়াল খাড়া রয়েছে। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে চেলাকাঠ, ভাঙা আলমারি, কলসির টুকরো, ঝলসানো ধান-গোলা।
ভোট-পরবর্তী হিংসার জেরে বাসন্তীর নির্দেশখালি গ্রামের এটাই চেহারা। যেখানে যৌন নির্যাতনের হাত থেকেও রেহাই পাননি মহিলারা। রাজনৈতিক অশান্তি দেখতে অভ্যস্ত এ তল্লাট সন্ত্রাসের এই চেহারা দেখে রীতিমতো কাঁপছে।
রবিবার ভোর থেকে প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা ধরে অবাধে সশস্ত্র তৃণমূল কর্মী-সমর্থকেরা ওই তাণ্ডব চালায় বলে অভিযোগ গ্রামবাসীদের। যাঁদের বেশির ভাগই আরএসপি সমর্থক। তাঁদের দাবি, ৫০-৬০ জনের দলে অন্তত ২০ জন মহিলাও ছিল। সকলে ম্যাটাডরে আসে। লুঠপাটের জিনিস নিয়ে মহিলারা চলে যায়। সেই তাণ্ডবের ২৪ ঘণ্টা পরে, সোমবার দুপুরেও প্রবল বৃষ্টির মধ্যেই পোড়া গন্ধটা বাতাসে থেকে যাচ্ছিল।
ধ্বংসস্তূপের মধ্যে একটা বাটি খুঁজছিলেন রাধারানি মাইতি। জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁর বাড়ি। কোলের ছেলেটাকে প্রশাসনের থেকে ত্রাণে পাওয়া মুড়ি দেওয়ার জন্য বাটি খুঁজে না পেয়ে বলে ফেললেন, “দু’দিন না খেয়ে রয়েছি। ছোট ছেলেটাকে কীসে মুড়ি দিই বলুন তো! কোনও বাসনপত্র নেই। সব লুঠ করেছে।” |
সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের কাছে পেয়ে রাধারানির প্রতিবেশী ছিদাম মাইতির বৃদ্ধা মা কবিতাদেবী প্রায় টেনে নিয়ে গেলেন বাড়িতে। পোড়া বাড়ির এক দিকের মাটি খোঁড়া রয়েছে। বৃদ্ধার আতঙ্ক, “আমার সামনে এই কবর খোঁড়া হচ্ছিল। ছেলেকে খুন করে মাথাটা কোন দিকে রাখবে, সে আলোচনা চলছিল। বৌমাকে বেঁধে রাখা হয়। চার বছরের নাতনিকে ওরা লাথি মেরে ফেলে দিল। মেয়েটা জ্ঞান হারিয়ে দেড় ঘণ্টা পড়েছিল।” বাসন্তী পঞ্চায়েত সমিতির বিদায়ী আরএসপি সদস্য আরজেদ নস্করেরও বাড়ি ধূলিসাৎ হয়েছে। তাঁর দাবি, “গত লোকসভা ভোটের আগে মেরে কোমর ভেঙে দিয়েছিল তৃণমূল। এ বার ওরা বাঁ পা-টাও ভেঙে দিল। ব্যথায় ডাক্তারের কাছেও যেতে পারছি না।”
বাসন্তী হাইওয়ে লিঙ্ক রোডের দু’ধারে ছড়িয়ে নির্দেশখালি গ্রাম। সব মিলিয়ে প্রায় ২৫০ পরিবারের বাস। অন্তত ১৫০ পরিবার হামলার শিকার। জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রায় ৫২টি বাড়ি। হামলার সময়ে এক দুষ্কৃতী এক মহিলাকে ধর্ষণ করে বলে বাসন্তী থানায় অভিযোগ দায়ের হয়েছে রবিবার রাতে। গ্রামবাসীদের দাবি, হামলকারীরা অন্তত ২৫-৩০ জন মহিলার উপরে যৌন নির্যাতন চালায়। ভয়ে থানায় যেতে সাহস পাচ্ছেন না তাঁরা। গ্রামবাসীদের অভিযোগ, হামলার সময়ে বারে বারে থানায় সাহায্য চাওয়া হয়। কেউ আসেনি।
রবিবার বেলা ১১টা নাগাদ পুলিশ গ্রামে ঢোকে বলে বাসিন্দাদের দাবি। বিকেলে ঢোকে র্যাফ, কমব্যাট ফোর্স এবং কেন্দ্রীয় বাহিনী। যদিও সোমবার দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত গ্রামে কেন্দ্রীয় বাহিনীকে দেখা যায়নি। কয়েকটি গাড়িতে গুটিকয়েক পুলিশকর্মী রাস্তায় ছিলেন। মাঝেমধ্যে গাড়ি থামিয়ে তাঁরা আরোহীদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। কর্তব্যরত এক পুলিশকর্মী অবশ্য জানান, সকালে গ্রামে কেন্দ্রীয় বাহিনী ছিল। পরে তারা অন্যত্র টহল দিতে যায়। জেলা পুলিশের এক কর্তার বক্তব্য, “কেন্দ্রীয় বাহিনীকে বিশ্রামের জন্য বাসন্তীর সুন্দরবন হাইস্কুলে পাঠানো হয়েছে। ফের তারা গ্রামে টহল দেবে। গোলমালের ঘটনায় এক জনকে ধরা হয়েছে। বাকি অভিযুক্তেরা পলাতক।”
কিন্তু কেন এই হামলা?
আরএসপি-র অভিযোগ, ভোটের দিন গ্রামের দু’টি বুথে এক তৃণমূল কর্মী ছাপ্পা ভোট দেওয়ার চেষ্টা করায় তাকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। সেই রাগে রাতে ওই তৃণমূল সমর্থক হুমকি দেয়। পরে গোসাবার তৃণমূল বিধায়ক জয়ন্ত নস্করের নেতৃত্বে তাঁর দলবল হামলা চালায়। ঘটনার সময়ে গ্রামের কিছু দূরে একটি গাড়ি থেকে জয়ন্তবাবু তাণ্ডবের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন বলে অভিযোগ আরএসপি-র। অভিযোগ মিথ্যা এবং অপপ্রচার চালানো হচ্ছে দাবি করে জয়ন্তবাবু বলেন, “আরএসপি-র গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জন্যই ওই ঘটনা। ওরা এখন বড় মুখ করে আমাদের দিকে তোপ দাগছে।”
এ দিন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রের নেতৃত্বে ক্ষিতি গোস্বামী, সুভাষ নস্কর, সুজন চক্রবর্তী-সহ বামফ্রন্টের একটি প্রতিনিধি দল নির্দেশখালিতে যান। সূর্যবাবু বলেন, “কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করেও এখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হল। পুলিশকে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় করে এখানে পরিকল্পিত ভাবে পাশবিক অত্যাচার হয়েছে। রাজ্যপাল ও মানবাধিকার কমিশনকে বিষয়টি জানাব। লোকসভা ও বিধানসভাতেও তুলব।” ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের জন্য আগামী বৃহস্পতি ও শুক্রবার বাসন্তী-গোসাবায় দলের পক্ষ থেকে গণ-চাঁদা সংগ্রহের পরিকল্পনা করা হয়েছে বলে জানান সিপিএম নেতা কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়।
আতঙ্কে ইতিমধ্যেই বহু বাসিন্দা গ্রাম ছেড়েছেন। সব হারিয়ে অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন নির্দেশখালি প্রাথমিক স্কুলে। সম্বল শুধু ত্রাণের মুড়ি।
|