ভোটের হিংসার আঁচ এ বার লাগল মহিলা এবং ছোটদের গায়েও।
পাঁচ বছর আগে পঞ্চায়েত ভোটে হিংসার যে ছবি দেখা গিয়েছিল দক্ষিণ ২৪ পরগনার বাসন্তীতে, রবিবার ভোরে তা ফের দেখলেন সেখানকার গ্রামবাসীরা। নির্দেশখালিতে জ্বালিয়ে দেওয়া হল বহু বাড়িঘর। চালানো হল ভাঙচুর, লুঠপাট। মারধর, বোমাবাজিও বাদ যায়নি। কিন্তু এ বার সব কিছুকে ছাপিয়ে হামলাকারীরা এক মহিলার উপরে শারীরিক এবং যৌন নির্যাতন চালিয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। ঘটনার নিন্দায় মুখর হয়েছেন গ্রামবাসীরা। বোমার স্প্লিন্টারে জখম হয় এক বালিকা।
গোটা ঘটনায় অভিযোগের তির শাসক দলের কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে। নির্দেশখালিতে যাঁরা আক্রান্ত হন, বা যাঁদের ঘর-সম্পত্তি নষ্ট হয়েছে, সকলেই আরএসপি সমর্থক। তাঁদের অভিযোগ, গোসাবার তৃণমূল বিধায়ক জয়ন্ত নস্করের কয়েকশো অনুগামী ওই হামলা চালায়। জয়ন্তবাবু যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি পাল্টা হামলার অভিযোগ তুলেছেন আরএসপি-র বিরুদ্ধে। এ দিন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও অভিযোগ করেন, বাসন্তীতে সেখানকার আরএসপি বিধায়ক সুভাষ নস্করের দলবলই হামলা করেছে। সুভাষবাবুর প্রতিক্রিয়া, “আমাদের কর্মী-সমর্থকদের বাড়িতে হামলায় আমার দলবল জড়িত? এটা হয় নাকি?” |
এমনিতেই শুক্রবার ভোটের পরে ওই এলাকা থেকে সরে যায় কেন্দ্রীয় বাহিনী। বাসন্তী থানার ৪৪ জন পুলিশকর্মীকে শনিবারই পাঠিয়ে দেওয়া হয় মুর্শিদাবাদে ভোটের ডিউটিতে। প্রায় অবাধেই নির্দেশখালিতে তাণ্ডব চালায় হামলাকারীরা। প্রথম দফায় পুলিশ গিয়ে হামলাকারীদের তাণ্ডবের মুখে পড়ে। পরে পুলিশ বাহিনী, র্যাফ, কমব্যাট ফোর্স এবং দু’কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী গ্রামে ঢোকে। গ্রেফতার করা হয় এক জনকে।
প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশ জানায়, অন্তত ২৬টি বাড়ি পোড়ানো হয়েছে। ১১টি বাড়িতে ভাঙচুর-লুঠপাট হয়েছে। পুলিশ সুপার প্রবীণ ত্রিপাঠী বলেন, “ওই এলাকায় জোর তল্লাশি শুরু হয়েছে। পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। এক মহিলার উপরে নির্যাতনের কথা পুলিশেরও কানে এসেছে। তদন্ত চলছে।”
শুক্রবার ভোটের পর থেকেই শিমুলতলা, ভরতগড়, চুনাখালি-সহ বাসন্তীর নানা এলাকায় দু’পক্ষের গোলমাল লেগে ছিল। শনিবার ঝড়খালিতে দু’পক্ষের সংঘর্ষে জখম হন ২৫ জন। সেই ঘটনায় গোটা ব্লকেই চাপা উত্তেজনা ছিল। তবে, তার জেরে নির্দেশখালিতে পরিস্থিতি যে এতটা অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠবে, তা ভাবতে পারেননি কেউ।
রবিবার তখন ভোর চারটে। নির্দেশখালির বাসিন্দারা ঘুমোচ্ছিলেন। আগ্নেয়াস্ত্র, রড, লাঠি, বোমা নিয়ে কয়েকশো যুবক সেই সময় হানা দেয় গ্রামে। ঘুম থেকে আরএসপি সমর্থকদের তুলে বাইরে বের করে এনে শুরু হয় লুঠপাট, ভাঙচুর এবং বাড়িতে অগ্নিসংযোগ। বাধা দিতে গিয়ে মার খান অনেকে। চলতে থাকে বোমাবাজি। সেই সময়েই একটি বোমার স্প্লিন্টারে মাথায় আঘাত লাগে রেজিনা খাতুন নামে বছর বারোর এক বালিকার। ওই তাণ্ডবের মধ্যেই এক মহিলার উপরে শারীরিক ও যৌন নির্যাতন চালানো হয় বলে অভিযোগ। |
বাসন্তীর নির্দেশখালিতে আরএসপি সমর্থকদের পুড়ে যাওয়া বাড়ি।— নিজস্ব চিত্র |
ওই মহিলার অভিযোগ, “দরজা ভেঙে ঢুকে চার জন লুঠপাট চালায়। ছেলেমেয়েকে নিয়ে আমি ঘুমোচ্ছিলাম। ওরা আমার হাত ধরে টানে। এক জন ঘরের এক কোণে টেনে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে।” পরে ওই মহিলার স্বামী ফিরে এসে ঘটনার কথা শোনেন। তিনি বলেন, “আমি আরএসপি করি, এটাই আমার অপরাধ। সেই কারণে আমাকে না পেয়ে তৃণমূলের লোকজন স্ত্রীর উপরে নির্যাতন চালাল।” এ ব্যাপারে সন্ধ্যা পর্যন্ত অবশ্য তিনি থানায় অভিযোগ দায়ের করেননি। এ নিয়ে ওই আরএসপি সমর্থক বলেন, “বাড়িঘরের কী হবে, কিছুই বুঝতে পারছি না। অসহায় লাগছে। একটু সামলে নিয়েই সব ঘটনা পুলিশকে জানাব।’’ আতঙ্কিত অন্য গ্রামবাসীরাও। তাঁদের এক জন বলেন, “গত বার গোলমাল হয়েছিল মূলত চরাবিদ্যায়। এ বার ব্লকের নানা প্রান্তেই অশান্তি হচ্ছে। অসহায় মহিলাকে নির্যাতনে নিন্দার ভাষা নেই।” এক আরএসপি সমর্থক বলেন, “জয়ন্ত নস্করের লোকজনই হামলা চালায়।”
তাণ্ডব শুরুর প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা পরে জনাছয়েক পুলিশ গ্রামে গেলে হামলাকারীরা তাঁদের লক্ষ করে বোমা-ইট ছুড়তে থাকে। ওই পুলিশকর্মীরা ফিরে আসেন। পরে বিশাল পুলিশ বাহিনী যায়। যায় দমকলও। মহিলারা পুলিশের সামনে কান্নায় ভেঙে পড়েন। ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ত্রাণ পাঠান ক্যানিংয়ের মহকুমাশাসক শেখর সেন। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র-সহ বামফ্রন্টের একটি প্রতিনিধি আজ, সোমবার নির্দেশখালিতে যাবে বলে জেলা সিপিএম সূত্রে জানা গিয়েছে।
পাঁচ বছর আগেও পঞ্চায়েত ভোটে সন্ত্রাস দেখেছিল বাসন্তী। ভোটের দিনই সিপিএম এবং আরএসপি সমর্থকদের দফায় দফায় সংঘর্ষ ও বোমাবাজিতে তেতে ওঠে আমঝাড়া। তিন আরএসপি সমর্থক এবং এক সিপিএম সমর্থক খুন হন। পরের দিনই কুমড়োখালিতে সুভাষ নস্করের (তৎকালীন সেচমন্ত্রী) বাড়িতে অগ্নিসংযোগের অভিযোগ ওঠে সিপিএমের বিরুদ্ধে। পুড়ে মারা যান সুভাষবাবুর ভাইপোর স্ত্রী গৌরীদেবী।
সেই হিংসা যাতে ফের না দেখতে হয়, তাই এ বারে প্রার্থী দিয়েও চরাবিদ্যা এবং চুনাখালি পঞ্চায়েত থেকে মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নিয়েছিল আরএসপি। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দু’টি পঞ্চায়েতে জিতে যায় তৃণমূল। কিন্তু হিংসা বন্ধ হল না।
আরএসপি-র দাবি, নির্দেশখালিতে তাদের ৫০-৬০ জন সমর্থকের বাড়ি জ্বালানো হয়েছে। শতাধিক বাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। হাজার খানের সমর্থক গ্রামছাড়া। বিধায়ক সুভাষ নস্কর বলেন, “ভোটে জেতার জন্য ওরা গণনাকেন্দ্র দখল করার মতলব করেছে। আমরা যাতে সেখানে না যাই, সেই কারণে এই হামলা।” অভিযোগ উড়িয়ে গোসাবার তৃণমূল বিধায়ক জয়ন্তবাবু দাবি করেন, “নির্দেশখালিতে আমাদের কেউ হামলা করেনি। মহিলার উপরে নির্যাতনের অভিযোগও ফালতু। ওরাই আমাদের কার্যালয়ে হামলা করেছে। সমর্থকদের মেরেছে।”
আতঙ্কের নির্দেশখালিতে মোতায়েন করা হয়েছে পুলিশ। কিন্তু সন্ত্রাস কি থামবে? প্রশ্ন গ্রামবাসীদের। |