ভোট দিয়েই স্বামী খুনের ‘বদলা’ নিলেন সুচিত্রা ঘোষ।
৯ জুলাই খুন হয়েছিলেন স্বামী। ভোট দেবেন কি না, সে নিয়ে দোলাচলে ছিলেন। শেষে ভোটের আগের রাতে সুচিত্রদেবী সিদ্ধান্ত নেন, ভোট দেবেন, তাতেই বদলা নেওয়া হবে স্বামীকে খুনের।
সেই সকালে চাপড়ার হাতিশালা গ্রামে বাড়ির সামনে বোমার আঘাতে খুন হয়েছিলেন তৃণমূলকর্মী মিঠু ঘোষ (৩৭)। আর এই নির্মম হত্যাকান্ডের সাক্ষী ছিলেন বিরাশি বছরের বৃদ্ধ বাবা ভূপতি ঘোষ আর মেয়ে রমা। ঘটনার পরদিন তড়িঘড়ি মিঠুবাবুর বাড়ি ছুটে এসেছিলেন তৃণমূল নেতা মুকুল রায়। পরিবারের পাশে থাকার পাশাপাশি মুকুলবাবু দোষীদের কঠোর শাস্তির প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেলেও সুচিত্রাদেবীর মনের ক্ষতটা দগদগেই থেকে গিয়েছিল। সেদিন স্বামীর রক্তাক্ত মৃতদেহটিকে জড়িয়ে ধরে বারবার লুটিয়ে পড়ছিলেন তিনি। সোমবার ভোটের দিন আটপৌরে ওই মহিলার চোয়াল কিন্তু অনেকটাই শক্ত। অন্যবারের মতোই এবারেও চার জায়ের সঙ্গে তিনি পৌঁছে গিয়েছিলেন হাতিশালা হাই স্কুলের ভোট গ্রহন কেন্দ্রে। ব্যালট পেপারটা হাতে নেওয়ার পর গলার কাছে একটা দলা পাকানো কান্না যেন বারবার ধাক্কা দিচ্ছিল। তার পরেও দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলে নিয়ে নির্দিষ্ট প্রতীকেই ছাপ্পা মারেন সুচিত্রা। কিন্তু তারপরে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেননি। পা দুটো কাঁপছিল। সমস্ত শরীরটা যেন অবশ হয়ে আসছিল তাঁর। সকাল থেকে কেঁদে কেঁদে শুকিয়ে গিয়েছে চোখের জল। দুই চোখে শুকিয়ে যাওয়া জলের রেখাটা তখনও স্পষ্ট। বাড়ির দাওয়ায় বসে ছোট মেয়েকে আঁকড়ে ধরে সুচিত্রা তাই অনায়াসেই বলে দেন, “ভীষণ কান্না পাচ্ছিল। বারবার মানুষটার মুখটা মনে পড়ছিল। নির্বিবাদী মানুষটা সকাল সকাল ভোটটা দিয়ে আসতেন। গণ্ডগোল এড়াতে। সেই মানুষটা আজ নেই। অথচ আমি ভোট দিয়ে এলাম।”
ভোটের রাজনীতি কেড়ে নিয়েছে জলজ্যান্ত মানুষটাকে। এই গোটা পরিবারটা যেন অভিমানী হয়ে উঠেছিল ভোটের বিরুদ্ধেই। ভোট দেবেন কিনা তা নিয়েই দোলাচলে পড়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। রবিবার রাতে কি করবেন তা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনায় বসেন নিহত মিঠুবাবুর পরিবারের লোকজন। সেখানেই প্রথম সুচিত্রাদেবী বলে ওঠেন, “ভোটটা দিতেই হবে।’’ কেন? সুচিত্রাদেবী বলেন, “আমার স্বামীকে কেড়ে নিয়েছে ওরা। তার বদলা নেব না? কিন্তু আমি তো খুন করতে পারব না। তাই ভোটটা দিয়েই বদলা নিলাম।’’ আত্মীয়স্বজন মিলিয়ে তাঁদের মোট ৬৪টি ভোট। তার মধ্যে ১৩টি শুধু মিঠুবাবুর পরিবারেই। ঘটনার দিন থেকেই ভয়ে আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে তাঁর দুই ভাইপো। এক দাদা সামরিক বাহিনীর কর্মী। ভোট দিতে আসতে পারেননি। বাকি তিন ভাই, পাঁচ বউ, বৃদ্ধ বাবা এদিন ভোট দিয়েছেন। ভোট দিয়ে ফিরে সদ্য বিধবা বৌমার পাশেই বসেছিলেন বৃদ্ধ বিভূতিবাবু। চোখের সামনে ছেলেকে খুন হতে দেখে কাঁদতেও যেন ভুলে গিয়েছেন তিনি। বলেন, “ছেলের মৃত্যুর প্রতিবাদ তো করতেই হবে। তাই এই বৃদ্ধ বয়সে ভোট দিয়েই সেটা করলাম। রবিবার রাতে বোমার শব্দে কেঁপে উঠেছিল গোটা গ্রাম। কেঁপে উঠেছিলেন সন্তানহারা বৃদ্ধ ভূপতিবাবুও। তিনি বলেন, “আমার ছেলেকে খেয়েও সিপিএমের যেন খিদে মেটেনি। নাহলে এর পরেও কি ওরা বোমা মারতে পারত!’’ উঠোনের এক দিকে মিঠুবাবর ছোট্ট টালির ঘর। ঘটনার পর থেকে সেটা বন্ধ। আতঙ্কে সে ঘরে আর কেউ থাকেন না। বন্ধ ঘরের এক দিকে ছড়িয়ে আছে সদ্য কাটা বিচালি আর গ্যামা ঘাস। চৌকির মলিন চাদরের উপরে পুরু ধুলো। বুথমুখো গোটা গ্রামের এই ঘরটাই শুধু বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছিল যে মানুষটা নেই। |