খুব জোর আওয়াজ করে মেশিনটা চলছে। ৫৫ বছরের গোপাল মিস্ত্রী মেশিন অপারেটর। গোপালের ছোট নাতিটার কয়েক দিন হল জ্বর। ফ্যাক্টরিতে আসার আগে দেখে এসেছিলেন খিঁচুনি শুরু হয়েছে। পারিশ্রমিক হারাবেন বলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফ্যাক্টরিতে আসতে হয়েছে। কিন্তু কাজে মন বসছে না।
যে মেশিনটা গত ৩০ বছর ধরে তিনি চালাচ্ছেন, হঠাৎই তার মধ্যে হাতটা ঢুকে গেল তাঁর। গোপাল আর্তনাদ করে উঠলেন। কিন্তু মেশিনের বিকট শব্দে কানে গেল না কারও। এক সময় আটকে গেল ওঁর গোটা শরীরটা। মেশিনটা ঘটাং করে বন্ধ হয়ে গেল। তখনই পাশের মেশিন অপারেটর জানতে পারলেন কিছু একটা ঘটেছে। তিনি দেখলেন গোপালের নিথর দেহ আটকে রয়েছে মেশিনের মধ্যে। কারখানা-কর্তৃপক্ষ রিপোর্টে জানালেন অন্যমনস্ক হয়ে কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটিয়েছেন গোপাল।
|
গলগল করে কালো ধোঁয়া ঢুকছে ছোট টিনের খুপরিতে। বাসের চালকের কেবিন। গরম কালে ইঞ্জিন গরম হয়ে যায়। এক দণ্ড বসে থাকা যায় না। কিন্তু এখানেই দিনের দশ-বারো ঘণ্টা বসে থাকতে হত আবদুলকে। সব সময়ে প্রচণ্ড জোরে কাঁপতে থাকে নড়বড়ে কলকবজার স্টিয়ারিং, গিয়ার। বাস স্টার্ট দেওয়ার পর থেকে কাঁপতে থাকে ছোট্ট এক চিলতে বসার জায়গাও। |
আবদুল ছিলেন বাসচালক। শারীরিক কারণে মাত্র ৪৫ বছর বয়সেই অবসর নিতে বাধ্য হয়েছেন। সারা দিন ঘরে বসে খুকখুক করে কাশেন। মাঝেমধ্যে কালো কফ উগরে দেন। তাঁর হাত-পা’ও কোনও কারণ ছাড়াই কাঁপে। আবদুল বলেন, ‘সংসারের একটু খুশির জন্য দিনের পর দিন ওভারটাইম করেছি। ঠিকমত খাওয়াটাই জোটেনি। তখনও বুঝতে পারিনি এ ভাবে পঙ্গু করে দেবে। আমার সঙ্গে যারা বাস চালাত, তাদের অনেকেরই শরীরের এই হাল।’
আবদুল একটা প্রেসক্রিপশন এবং বুকের এক্স-রে রিপোর্ট বের করে দেন। শ্বাসযন্ত্রের দু’পাশে জমেছে কালো ময়লা। ফুসফুসে অক্সিজেন পৌঁছনোর পরিমাণ দিনকে দিন কমেছে। ভাঙা রাস্তা দিয়ে ভাঙা কলকবজার বাস চালাতে গিয়ে স্নায়ুর উপরে চাপ পড়েছে অতিরিক্ত। ফলে হাত-পা কাঁপে। বাকি জীবন এ ভাবেই কাটাতে হতে পারে বলে আশঙ্কা চিকিৎসকের। আবদুলও জানেন। আক্ষেপ করছিলেন, ‘এ ভাবে আর বাঁচতে চাই না’।
|
একটা সরকারি সংস্থায় ২৫ বছর কাজ করছেন মালবিকা সান্যাল। একটু মোটাসোটা চেহারা। বছর পঞ্চাশের মালবিকা চিন্তিত পিঠ, কোমর আর হাঁটুর ব্যথা নিয়ে। প্রথমে ভেবেছিলেন বাত। নানা পরীক্ষানিরীক্ষা হল। পেন কিলার, কবিরাজি তেল মালিশও চলল। কিন্তু ব্যথা কমল না। অফিস থেকে মাসখানেক ছুটি নিয়ে বাড়ি বসে থাকলে কিংবা বেড়াতে গেলে ব্যথাটা অনেক কম থাকে। কয়েক দিন অফিস করলেই ফের মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে।
মালবিকা সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানলেন, তাঁদের অনেকেরই একই সমস্যা রয়েছে। পিঠ, কোমর আর হাঁটুর এক্স-রে করালেন মালবিকা। জানা গেল, মেরুদণ্ডের নির্দিষ্ট অংশে অত্যধিক চাপ পড়ার জন্য সেখানকার স্নায়ুগুলি কমজোরি হয়ে পড়েছে। আশপাশের পেশিতে রক্ত সঞ্চালনও ঠিকমত হচ্ছে না। অফিসের যে চেয়ারে বসে দীর্ঘ দিন কাজ করেছেন মালবিকা, সেটাই তার যাবতীয় কারণ— জানালেন এক শারীরতত্ত্ববিদ।
|
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরবিদ্যা বিভাগের প্রধান দেবাশিস সেন জানালেন, ‘এখানে বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতে ন্যূনতম সুরক্ষা ব্যবস্থাও মানা হয় না। একটা মানুষকে এত শব্দের মধ্যে কাজ করানোটাই অবৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার পরিচয়। এত শব্দ গোপালদের মানসিক ভাবে ১০০ শতাংশ পটু হতে দেয় না। আমরা গরিব দেশ। তাই সব সময় মেশিন থেকে উৎপন্ন শব্দ বন্ধ করা যায় না। অন্য কোনও বিপদসংকেত থাকা জরুরি। তা লাল আলো হতে পারত। সাইরেন কিংবা বিপদঘণ্টি কাজে লাগত না। কারণ, সেই শব্দ কারও কানেই পৌঁছত না।’
একই ভাবে বাসের চালকের কেবিনটিতে কালো ধোঁয়া না ঢুকলে, কলকবজা অটুট থাকলে আবদুলকে ৪৫ বছরে বেকার হতে হত না। আর মালবিকার চেয়ারের নকশা মালবিকার শরীরের নকশার সঙ্গে মেলেনি।
|
বিজ্ঞানের যে শাখা কর্মী, কর্মক্ষেত্রের পরিবেশ এবং কর্মী ও যন্ত্রের মধ্যে সমন্বয় সাধন করে তাকে বলে আর্গোনমিক্স বা মানব-প্রযুক্তি বিদ্যা। ৬০ বছর আগে প্রেসিডেন্সি কলেজে এই শাখার গবেষণা ও পঠনপাঠন শুরু হয়েছিল। এশিয়ায় সব থেকে আগে।
দেবাশিসবাবুর আক্ষেপ, ‘কলকাতায় এই বিষয়টির সঠিক লালনপালনই হল না। অথচ মুম্বই, বেঙ্গালুরু, চেন্নাই, আমদাবাদ— আর্গোনমিক্সের হাত ধরে এগিয়ে গিয়েছে অনেকটাই। এশিয়ায় সবচেয়ে আগে বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু করেও আমরা সব থেকে পিছিয়ে।’
একুশ শতকের বিজ্ঞান গবেষণা বা পঠনপাঠন পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, জীবনবিজ্ঞান বা রাশিবিজ্ঞানকে পৃথক করে দেখে না। এটা মাল্টিডিসিপ্লিনারি সাবজেক্টের যুগ। আর্গোনমিক্স খুব সম্ভবত প্রথম মাল্টিডিসিপ্লিনারি বিষয়, যা নিয়ে গবেষণার সূত্রপাত সেই পঞ্চাশের দশকে।
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে জীবন বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখাকে মিলিয়ে এখন বায়োলজিকাল সায়েন্স নামে নতুন এক বিভাগের জন্ম হয়েছে। সেখানে আর্গোনমিক্সের বিশেষ গুরুত্ব থাকা প্রয়োজন ছিল বলে মনে করেন এই প্রতিষ্ঠানের বেশ কয়েক জন প্রাক্তনী। তাঁরা অনেকেই এখন আর্গোনমিস্ট হিসেবে এ দেশের নানা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। মুম্বই এবং গুয়াহাটি আইআইটি কিংবা আমদাবাদের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডিজাইন বিভিন্ন পণ্যের যে নকশা তৈরি করছে তাতে প্রেসিডেন্সি এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্গোনমিক্স বিভাগের প্রাক্তনীদের মাথা কাজ করছে। ভেল, স্টিল অথরিটি অব ইন্ডিয়া, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অকুপেশনাল হেলথ, প্রতিরক্ষা দফতরের অন্তর্গত গবেষণা সংস্থায় আর্গোনমিস্টরা নিজেদের ভাবনার বিকাশ ঘটাচ্ছেন।
দেশে-বিদেশে বিকাশ ঘটছে আর্গোনমিক্সের। কিন্তু আঁতুড়ঘর প্রেসিডেন্সিতেই অপুষ্টির শিকার আর্গোনমিক্স, নিজেই এখানে ধুঁকছে। |