প্রবন্ধ ১...
একটু বেশি ভাত চাইলেও পাবেন না
সছে খাদ্য সুরক্ষা বিল। লোকসভায় বিতর্কের মধ্যে দিয়ে পাশ হয়ে নয়, বাঁকা পথে— অর্ডিনান্স করে। রাষ্ট্রপতি বিলটিতে সই করেছেন। কংগ্রেস বলছে, গরিব মানুষের জন্য এমন উপকারী বিল আগে কখনও আসেনি। বিরোধীরা বলছে, এ সবই রাজনৈতিক চাল। এতে গরিব মানুষের উপকার হওয়ার বদলে অপকারই হবে। সরকারি হিসেব অনুযায়ী, বিলটি বাস্তবে প্রয়োগ করতে গেলে বাড়তি খরচ হবে পঞ্চাশ হাজার থেকে এক লক্ষ কোটি টাকা। অর্থনীতির ওপর এই বিপুল পরিমাণ খরচের একটা বড় প্রভাব তো থাকবেই। প্রশ্ন হল, এই প্রভাবের ফলে মানুষের, বিশেষ করে গরিব মানুষের, ভাল হবে, না খারাপ?
জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা বিল ভারতীয়দের তিন ভাগে ভাগ করে নিচ্ছে। প্রথম ভাগে রয়েছেন সমাজের দরিদ্রতম মানুষ, যাঁদের জন্য বিলে সব থেকে বেশি সুবিধে দেবার কথা বলা হয়েছে। বিল অনুযায়ী, এই শ্রেণির মানুষ রেশনের দোকান থেকে তিন টাকা কেজি দরে চাল, দু’টাকা কেজি দরে গম এবং এক টাকা কেজি দরে জোয়ার বাজরা ইত্যাদি নিম্নস্তর মানের শস্য মাসে মাথাপিছু মোট সাত কেজি কিংবা পরিবারপিছু পঁয়ত্রিশ কেজি কিনতে পারবেন। এর পরে রয়েছে আর একটি স্তরের মানুষ, রেশনের দোকান থেকে যাঁদের বরাদ্দ হবে মাসে মাথাপিছু তিন কেজি খাদ্যশস্য। যে মূল্যে সরকার কৃষকদের কাছ থেকে শস্য সংগ্রহ করেছেন, তার অর্ধেক দামে এই দ্বিতীয় স্তরের মানুষ তাঁদের বরাদ্দ খাদ্যশস্য রেশনের দোকান থেকে কিনতে পারবেন। এই দুই শ্রেণির বাইরে যাঁরা রয়ে গেলেন, খাদ্য সুরক্ষা বিল তাঁদের সমাজের উপরতলার মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করছে। এঁরা রেশন ব্যবস্থা থেকে কোনও সুবিধেই পাবেন না। সুরক্ষা বিল বলছে, গ্রামে মোট জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশ এবং শহরে ৫০ শতাংশ মানুষ খাদ্য সুরক্ষার আওতায় আসবেন। এর মধ্যে ৪৬ শতাংশ গ্রামের মানুষ এবং ২৮ শতাংশ শহরের মানুষ দরিদ্রতম হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রেশন ব্যবস্থা থেকে সবচেয়ে বেশি সুবিধে পাবেন। এ ছাড়াও বিলে গর্ভবতী এবং স্তনদায়িনী মায়েদের জন্য, শিশুদের জন্য এবং অতি-দরিদ্র, গৃহহীন ও নিরন্নদের জন্য বিশেষ খাদ্য-জোগানের কথা বলা হয়েছে।
বলতেই পারেন, এ তো অতি চমৎকার প্রস্তাব। গরিব মানুষ, নিরন্ন মানুষ, এমনকী তুলনামূলক ভাবে অসচ্ছল মানুষ দু’বেলা দু’মুঠো খেতে পাবেন, তার থেকে ভাল আর কী হতে পারে? কিন্তু ভাল করে ভেবে দেখলে বোঝা যাবে, বিল পাশ করা এবং তাকে কাজে করে দেখানোর মধ্যে অনেক ফারাক আছে।
সংশয়গুলো এক এক করে বলি। প্রথম সংশয়, এই যে গরিব মানুষদের শস্তায় চাল-গম দেবার কথা বলা হচ্ছে, তার জন্য যথেষ্ট খাদ্যশস্য আমাদের দেশে উৎপন্ন হবে তো? রেশনের দোকান থেকে কম দামে চাল-গম পাওয়া গেলে ক্রেতার হাতে কিছু টাকা বেঁচে যাবে। সেই বাড়তি টাকা দিয়ে গরিব ক্রেতাটি কি খানিকটা বাড়তি খাদ্যশস্য কিনবেন না?
হাতে বাড়তি টাকা এলে গরিব মানুষ ‘প্লাস্টিকের চিরুনি, শ্যাম্পুর খুদে প্যাকেট, টিপের পাতা কিনছেন’ (‘নিরাপত্তা আর গরিবের পক্ষে নিরাপদ নয়’ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধায় ও স্বাতী ভট্টাচার্য, আ.বা.প, ১৮.৭.২০১৩), এমন নজির প্রচুর। এবং এর ফলে প্রয়োজনীয় পুষ্টির যে অভাব ঘটছে, এটা ঠিক। কিন্তু হাতে বাড়তি টাকা এলে যে কিছু মানুষ সেই বাড়তি টাকার একটা অংশ বাড়তি খাদ্যশস্য কিনতে খরচ করেন, এটাও ঠিক। চিত্র-১ এবং চিত্র-২ যথাক্রমে গ্রাম ও শহর সম্পর্কিত। এনএসএসও-র সাম্প্রতিকতম (২০০৯-১০) নমুনার ভিত্তিতে ছবি দু’টি আঁকা হয়েছে। মাথাপিছু মাসিক খরচের ওপর ভিত্তি করে এনএসএসও গ্রাম ও শহরের ভোক্তাদের দশটি মোটামুটি সমান ভাগে ভাগ করেছে। এক-একটি ভাগ এক-একটি শ্রেণি, তাদের নম্বর দেওয়া হচ্ছে ১ থেকে ১০, মাসিক খরচের দিক থেকে নিম্নতম ১ নম্বর, উচ্চতম ১০ নম্বর। এক-একটি শ্রেণিতে পড়ছে মোটামুটি দশ শতাংশ করে মানুষ (ছবিতে পর পর দুটি শ্রেণিকে এক সঙ্গে দেখানো হয়েছে)। গ্রামের মানুষদের ক্ষেত্রে যত উচ্চতর শ্রেণিতে যাচ্ছি, মোটের ওপর তত বাড়ছে মাথাপিছু ভোগ। যেমন গ্রামে নিম্নতম শ্রেণির মাথাপিছু খাদ্যপণ্যের ভোগ মাসে সাড়ে দশ কেজির কম, উচ্চতম শ্রেণির ভোগ ১২ কেজির উপর। শহরের ক্ষেত্রে কিন্তু তেমন কোনও নিয়ম খাটছে না। শহরে একেবারে নিম্নতম শ্রেণির ক্ষেত্রে আয় বাড়লে খাদ্যশস্যের ভোগ খানিকটা বাড়ছে বটে, কিন্তু উচ্চতর শ্রেণির ক্ষেত্রে তেমন নির্দিষ্ট কিছু ঘটছে না। আর ৬ নম্বর শ্রেণি অর্থাৎ ৬০ শতাংশের উপরের মানুষদের থেকে খাদ্যশস্যের ভোগ উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে যাচ্ছে। গ্রামের তুলনায় শহরের গরিবদের কাছে শস্তার চিরুণি-সাবান-মোবাইলের হাতছানি অনেক বেশি; তাই তাদের খাদ্যশস্যের চাহিদাও এলোমেলো। আর শহরের অবস্থাপন্নরা ভাত-রুটির বদলে সব্জি, ফল, মাছ-মাংস খাচ্ছেন।
কিন্তু এ সবের থেকে এটা বোঝা যাচ্ছে যে, শহরে না হোক, অন্তত গ্রামে মানুষের হাতে বাড়তি টাকা এলে খাদ্যশস্যের চাহিদা বাড়বেই। অর্থাৎ, রেশনে শস্তায় চাল-গম দিলে গ্রামের মানুষের হাতে যে বাড়তি টাকাটা আসবে, তার খানিকটা দিয়ে তাঁরা খোলা বাজারে আরও খাদ্যশস্য কিনতে চাইবেন। খাদ্যশস্যের সার্বিক চাহিদার ওপর এর প্রভাব উড়িয়ে দেওয়া যায় না— ভারতের প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষ এখনও গ্রামে বাস করেন। সমস্যা হল, চাহিদা বাড়লেও খাদ্যশস্য উৎপাদন রাতারাতি বাড়ানো অসম্ভব। বর্তমান অবস্থায়, যেখানে বিদেশি মুদ্রার প্রচণ্ড অভাব, সেখানে আমদানি করেও চাহিদা-জোগানের বৈষম্য মেটানো সম্ভব নয়। অতএব চাহিদার তুলনায় জোগানের ঘাটতি মেটানোর একমাত্র উপায় খাদ্যশস্যের মূল্যবৃদ্ধি।
এই মূল্যবৃদ্ধির আঁচ যে শুধুমাত্র অবস্থাপন্নদের ওপর পড়বে তা নয়, দরিদ্রতমরাও এর কবল থেকে বাঁচতে পারবেন না। লক্ষণীয় যে, গ্রামের দরিদ্রতম শ্রেণিকেও তাদের মাসিক ভোগের একটা অংশ খোলাবাজারে কিনতে হচ্ছে। গ্রামের দরিদ্রতম শ্রেণি নতুন ব্যবস্থায় রেশনে খাদ্যশস্য পাচ্ছেন মাসে মাথাপিছু ৭ কেজি আর চিত্র ১-এ দেখতে পাচ্ছি, প্রতি মাসে মাথাপিছু তাঁদের চাহিদা ১০ কেজির উপর। এই বাড়তি অংশটা তাঁদের বাজার থেকে কিনতে হচ্ছে। এ ছাড়া হাতে বেশি টাকা আসার ফলে তাঁরা যদি আরও কিছুটা চাল-গম কেনেন, সেটাও বাজার থেকেই কিনতে হবে। ফলে বাজারে খাদ্যশস্যের দাম বাড়বে। দাম বাড়লে, যাঁরা ভর্তুকি পাচ্ছেন না, তাঁদের সরাসরি ক্ষতি। কিন্তু যেহেতু ভর্তুকি না-পাওয়া শ্রেণিটি অবস্থাপন্ন এবং যেহেতু খাদ্যশস্যকে অনায়াসে অতি প্রয়োজনীয় বলা চলে, তাই ধরে নেওয়া যায়, দাম বাড়া সত্ত্বেও এই অবস্থাপন্ন শ্রেণি তাঁদের খাদ্যশস্যের চাহিদা খুব একটা কমাবেন না। ফলে উৎপাদন না বাড়লে খোলাবাজার থেকে গরিবরাও খুব বেশি বাড়তি খাদ্যশস্য কিনতে পারবেন না, মাঝখান থেকে শুধু চাল-গমের দাম বেড়ে যাবে। যেমন, একশো দিনের কাজ চালু হওয়ার পর গরিব মানুষদের হাতে টাকা আসার ফলে খাদ্যশস্যের দাম বেড়েছিল।
সরকারের এই বিপুল পরিমাণ ভর্তুকি থেকে তা হলে কে লাভবান হবেন? কিছু টাকা হয়তো কৃষির বাইরে খরচ হবে, এবং তার ফলে ছোট-বড় কিছু কিছু শিল্পের লাভ হতেই পারে। কিন্তু বাকি অংশ দিয়ে গরিব মানুষ বাড়তি খাদ্যশস্য কেনার চেষ্টা করবেন, যার পরিমাণ খুব কম নয়। এই টাকাটা শেষ পর্যন্ত চলে যাবে কৃষিপণ্যের বড় বড় ব্যবসাদার ও মজুতদারের হাতে।
কিন্তু আরও আগের প্রশ্ন, ভর্তুকির কতটা গরিব মানুষদের হাতে পৌঁছবে? সকলেই জানেন, বণ্টন ব্যবস্থা না বদলাতে পারলে রেশনে ভর্তুকি দিয়ে লাভ নেই। সুরক্ষা বিলে অবশ্য সরকারি বণ্টন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের কথা বলা আছে। কিন্তু কী ভাবে সেই পরিবর্তন আসবে, পরিবর্তন আসতে কতদিন সময় লাগবে, এ সব কাজের কথা কিছুই বলা নেই। বণ্টন ব্যবস্থা বদলানোর আগেই সুরক্ষা বিল চালু করার অর্থ কিছু অসাধু লোককে পুকুর চুরির বন্দোবস্ত করে দেওয়া। এখানে আর একটা কথা আছে। আমাদের বণ্টন ব্যবস্থার দোষে বহু গরিব মানুষের রেশন কার্ড নেই। খোলাবাজারে চাল-গমের দাম বাড়লে এঁরা কিন্তু একেবারে মারা পড়ে যাবেন।
খাদ্য সুরক্ষা বিলের ব্যাপারে আমরা দুটো সহজ কথা বলতে চাইছি।
, উৎপাদন না বাড়িয়ে শুধুমাত্র টাকায় ভর্তুকি দিয়ে গরিব মানুষের খাদ্য-সুরক্ষা নিশ্চিত করা যায় না।
, আগে বণ্টন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন না ঘটলে রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে গরিব মানুষের কাছে খাদ্য-সুরক্ষা পৌঁছে দেওয়া কার্যত অসম্ভব।

কলকাতার ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউটে অর্থনীতির শিক্ষক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.