ভাষা কোনও দেশ বা জাতির একান্ত সম্পদ নহে। যে প্রয়োগ করে ভাষা তাহার। ইংরাজি ভাষাটি ব্রিটিশ উপনিবেশের কর্তাদের হাত ধরিয়া ভারতবর্ষে প্রবিষ্ট হইয়াছিল বটে, কিন্তু এ দেশে এই ভাষাটিকে, অনেক কাল যাবৎই, বিজাতীয় বলিবার কোনও কারণ নাই। সহজ কথায়, ইংরাজি অন্যতম ভারতীয় ভাষা। ভারতীয়দের অনেকেরই জ্ঞানের ভাষা, কাজের ভাষা এমনকী ভাবের ভাষাও। ইহাতে ভারতীয়দের ক্ষতি হয় নাই, বরং বিস্তর লাভ হইয়াছে। লাভ কেবল জ্ঞান এবং চিন্তার প্রসারে নহে, ব্যবহারিক লাভও প্রচুর। যে হেতু ইংরাজি জানিলে কাজের ও জ্ঞানের আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সুবিধা পাওয়া সম্ভব, সেই হেতু ইংরাজি-জানা ভারতীয়রা সেই সুবিধা পাইয়াছেন। ইহাতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে দেশেরই উপকার হইয়াছে। কিন্তু আজও অনেকে এই সহজ সত্য বুঝেন না, বুঝিতে চাহেন না। দেশ বলিতে যাঁহারা কেবল সীমিত ক্ষুদ্র একটি পরিসরকে বোঝেন তাঁহাদের পক্ষে দেশ ও দশের বৃহৎ ভাবনা নিতান্ত উৎপাত। অল্প লইয়া, স্বল্পে আধিপত্য কায়েম রাখিয়া সুখে থাকিবার স্বপ্ন ইহাতে আহত হইবে যে! আরও জানিতে, শিখিতে বুঝিতে হইবে যে! সুতরাং ক্ষুদ্র স্বার্থ কায়েম রাখিবার জন্য তাঁহারা জ্ঞান ও কর্মের বড় মার্গের প্রতি বিষোদ্গার করিয়া থাকেন।
সম্প্রতি বিজেপি-র সভাপতি রাজনাথ সিংহ ইংরাজি ভাষার উদ্দেশে কামান দাগিয়াছেন। যুক্তিগুলি পরিচিত। ইংরাজি ভারত-সংস্কৃতির ক্ষতি করিতেছে। সংস্কৃত ভাষার প্রতি মনোযোগহীনতার জন্যও নাকি ইংরাজি দায়ী। এই অভিযোগ ভিত্তিহীন। বস্তুত, অর্থহীন। ভারতীয় সংস্কৃতি নানা ভাষা ও জাতির সমবায়ে গড়িয়া উঠিয়াছে। এই সংস্কৃতি বিমিশ্র। কাজেই কোনও একটি ভাষাকে ভারতীয় সংস্কৃতির বিরোধী বলিবার অর্থ হয় না। আর ইংরাজি জানিলে সংস্কৃত শিক্ষা বাদ পড়িবে কেন? সংস্কৃত হালে বেশি মানুষ চর্চা করিতেছেন না, ইহার পিছনে নানা কারণাকারণ বিদ্যমান। ইংরাজিকে চাঁদমারি করিয়া কী লাভ! বিবেকানন্দ চমৎকার ইংরাজি জানিতেন, জানিতেন বলিয়াই বিলেত আমেরিকায় সংস্কৃত ভাষার জ্ঞানকে প্রয়োগ করিতে পারিয়াছিলেন। অবশ্য ইতিহাস হইতে ইতিবাচক উদাহরণ গ্রহণ করিবার মন অধিকাংশ ভারতীয় রাজনীতিকের নাই। তাঁহারা ইতিহাসকে আপন প্রয়োজনে ব্যবহার করেন, প্রায়শই বিকৃত করিয়া।
প্রসঙ্গত, দেশ, সংস্কৃতি ও সংস্কৃতের ধুয়া তুলিয়া ইংরেজি-বিরোধিতার ঘটনাটি পশ্চিমবঙ্গের মানুষদের ইংরেজি-বিরোধিতার অন্য এক অভিজ্ঞতাকে মনে করাইয়া দেয়। বাম আমলের ইংরেজি বিতাড়নের অভিজ্ঞতা। তখন অবশ্য নিক্তিটি ছিল শ্রেণিগত বামপন্থীরা নিদান দিয়াছিলেন, ইংরাজি নাকি উচ্চশ্রেণিভুক্ত বড়লোকদের ভাষা। তাঁহারা এই ভাষার সুবাদে সাম্রাজ্যবাদের দালাল। সুতরাং সর্বহারার সরকারের বুদ্ধিতে পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষার প্রাথমিক স্তরে ইংরাজি তুলিয়া দেওয়া হয়, মাধ্যমিক স্তরে ইংরাজির উপর গুরুত্ব কমাইয়া দেওয়া হইয়াছিল। ফল বিষম হইয়াছে। কয়েক প্রজন্মের বাঙালি পড়ুয়ার জ্ঞানের ভিত্তি কাঁচা থাকিয়া গিয়াছে, সাম্রাজ্যের একটি পাথরও খসিয়া পড়ে নাই। ভারতবর্ষ বহু ভাষার দেশ বলিয়া ভারতীয়রা স্বাভাবিক ভাবেই একাধিক ভাষায় কাজ চালাইয়া থাকেন। এই স্বাভাবিক অভ্যাসটির সুফল গ্রহণ করা উচিত। ইংরাজিকে না হটাইয়া ভারতীয় ভাষা হিসাবে তাহা ভাল করিয়া শিখিলেই বরং সব দিক হইতে লাভ। তাহাতেই দেশের উন্নতি। |