সুপ্রিম কোর্টের রায়, আঠারো বৎসরের নীচে বয়স হইলে অভিযুক্তকে অপ্রাপ্তবয়স্ক হিসাবেই বিচার করিতে হইবে, অর্থাৎ ‘জুভেনাইল জাস্টিস’-এর ক্ষেত্রে বয়সসীমা আঠারোর বদলে কমাইয়া ষোলো করা হইবে না। গত ডিসেম্বরে দিল্লির গণধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তদের মধ্যে এক জন অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় এবং বিশেষত, এ যাবৎ সংগৃহীত সাক্ষ্যপ্রমাণ-মতে সে-ই ওই ঘটনায় ঘৃণ্যতম অপরাধের সংঘটক বলিয়া নিন্দিতহওয়ায় দেশ জুড়িয়া দাবি উঠে, অপ্রাপ্তবয়স্ক নির্ধারণের আইন পাল্টাইতে হইবে। সেই দাবিতেই সর্বোচ্চ আদালতে যায় মামলা। মামলার রায়ে একটি বক্তব্য স্পষ্ট: কোনও বিশেষ মামলায় এক জন বিশেষ ব্যক্তি যতই বিশিষ্ট হউক, আইন প্রণয়ন কিংবা বিচারের সিদ্ধান্ত তাহার দ্বারা প্রভাবিত বা পরিচালিত হওয়া অনুচিত। আইন কিংবা বিচার তো ব্যক্তিবিশেষের জন্য নয়, সামগ্রিক সমাজের জন্য, তাই সামান্যীকরণের প্রয়োজনে বিশিষ্টকে পার হইয়া গিয়া সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিতটি মাথায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। এই প্রেক্ষিতবোধই বলিয়া দেয়, ডিসেম্বরের অপরাধে অভিযুক্ত কিশোরটির আচরণ যতই ঘৃণ্য হউক, দেশের সকল অপ্রাপ্তবয়স্কের জন্য আইন তৈরির আগে মনে রাখিতে হইবে, উল্লিখিত কিশোর সমস্ত অপ্রাপ্তবয়স্ক অপরাধীর প্রতিনিধি-স্বরূপ নয়, বরং একটি ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত। সুতরাং তাহার অপরাধের মাত্রার উপর নির্ভর করিয়া ভারতীয় কিশোরকিশোরীর সামগ্রিক মনস্তাত্ত্বিক ও পারিপার্শ্বিকের বিবেচনাসাপেক্ষে যে আইন তৈরি হইয়াছে, তাহা পরিবর্তনের কোনও যুক্তি নাই। ওই আইনের মূল কথাটি স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন বিচারকরা: অপ্রাপ্তবয়স্ক অপরাধীকে চূড়ান্ত সাজা না দিয়া বরং তাহাকে সামাজিক পুনর্বাসনের সুযোগ করিয়া দেওয়া। সেই জন্যই, আঠারো হইতে ষোলো করিয়া আরও বহু অপরাধীকে এই সংশোধন ও পুনর্বাসনের সুযোগ হইতে বঞ্চিত করা ভারতীয় দণ্ডবিধির মূল ভাবধারার বিরোধী।
সুপ্রিম কোর্টের এই রায় সংবেদনশীল ও সঙ্গত। ইহাও স্পষ্ট যে, মানুষের বয়ঃপ্রাপ্তি ও বোধবৃদ্ধির রৈখিক-চিত্র তৈরি করা অসম্ভব বলিয়া কোনও না কোনও বয়সকে বয়ঃপ্রাপ্তির সন্ধিক্ষণ হিসাবে বাছিয়া লওয়া ভিন্ন গতি নাই। কৈশোর সকলের ক্ষেত্রে এক অর্থ বহন করে না। কৈশোরের মনস্তাত্ত্বিক ও পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিও ভিন্ন হয়। এই জটিলতার সামনে তড়িঘড়ি বয়ঃপ্রাপ্তির সীমা কমাইয়া বহুসংখ্যক অপরাধীকে সাধারণ আইনের আওতায় ফেলিয়া দেওয়া কঠিন কাজ। বস্তুত, এই রায়টি বিচারকদের অনতি-ঈর্ষণীয় দায়টি দেখাইয়া দেয়, একটি অতি-নিকৃষ্ট অপরাধে যত হৃদয়াবেগই উপস্থিত হউক, শেষ পর্যন্ত সেই আবেগকে অতিক্রম করিয়া সামগ্রিক সমাজকে দেখিতে পারার দায়।
তবে অন্য দুই-একটি প্রশ্ন থাকিয়া যায়। অপরাধের ক্ষেত্রে যে কোনও একটি বয়স বাছিয়া লইতে হইলে আঠারোর পরিবর্তে কেন ষোলোকে নির্বাচন করা হইবে না, যেখানে মাত্র চার মাস আগে ভারতীয় আইনমতে ‘এজ অব কনসেন্ট’ বা সহবাস-সম্মতির অধিকার অর্জনের বয়সটি ষোলোই নির্ধারিত হইয়াছে? অধিকার অর্জনের বয়স এবং দায়িত্ব গ্রহণের বয়স আলাদা করা কি যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্য? এ ছাড়া, মনস্তাত্ত্বিক ও পারিপার্শ্বিক শর্ত বলিয়া যাহা এত কাল গ্রাহ্য ছিল, দূরসংযোগ প্রযুক্তি ও বিনোদন-প্রচারের বিস্ফোরণের যুগে আসিয়া কি তাহারও সংশোধন কাম্য নহে? একটি বৃহত্তর প্রশ্নও উঠে বইকী। সংশোধন ও পুনর্বাসনের যে যুক্তিতে বয়ঃপ্রাপ্তির যথার্থ মুহূর্ত লইয়া এত আলোচনা, তাহার কি সর্বজনীন প্রয়োগই সঙ্গত নহে? কোন হিসাবে আঠারোর মহাসন্ধিক্ষণ পার হইয়া গেলেই সংশোধনের সম্ভাবনায় ঢ্যারা পড়িয়া যায়? আর ঢ্যারা যদি না-ই পড়ে, তবে আঠারো-কে এ ভাবে মহিমান্বিত করিবার যুক্তিটিও তো দুর্বল হইয়া যায়! |