তৃণমূলের বিক্ষুব্ধেরাই ভরসা সিপিএমের
সবুজ নানুরে শুধুই একপেশে ভোট
বিশাল কাট আউটটা এখন যেতে আসতেই চোখে পড়ে। হাতজোড় করে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কত হবে? মেরে কেটে ৫০০ মিটার! বীরভূমের কীর্ণাহার চৌরাস্তার মোড়ে লাগানো সেই কাট আউট, আর দেশের বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের দেশের বাড়ির মাঝের দূরত্ব। রাষ্ট্রপতির বাড়ি মিরাটি যাওয়ার পথ দলীয় নির্বাচনী প্রচার ব্যানারে এ ভাবেই ছেয়ে ফেলেছে তৃণমূলের নানুর ব্লক কমিটি। পথে দেখা মিলতে এলাকার প্রবীণ বাসিন্দা, প্রণব-ঘনিষ্ঠ রবি চট্টোরাজ বলেই ফেললেন, “এই প্রচারেরও ওদের কোনও প্রয়োজনই ছিল না। সব ক’টা সিট তো ভোটের আগেই দখল করে ছেড়েছে!”
কীর্ণাহার এলাকার পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতির কোনও আসনেই এ বার ভোট হচ্ছে না। রাষ্ট্রপতির দেশের বাড়ির এলাকায় বিরোধীরা কেউই প্রার্থী দিতে পারেননি। এলাকার মানুষ কেবল মাত্র জেলা পরিষদের আসনটিতে ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন! যেখানে প্রার্থী মাত্র দু’জন। সিপিএম-তৃণমূলের এই সম্মুখসমরে নেই কংগ্রেস, বিজেপি। শুধু কি কীর্ণাহার? গোটা নানুরেরই তো এক চেহারা। হাতে গোনা কয়েকটি পঞ্চায়েতের আসনে ভোট হচ্ছে। বাকি সব শাসক দলের দখলে এসেছে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। নিন্দুকেরা অবশ্য বলছেন, অনুব্রত মণ্ডলের ‘পরামর্শ’ মেনে তৃণমূলের কর্মীরা সন্ত্রাস করেই বিরোধীদের মনোনয়ন জমা করতে দেয়নি। ফলে পঞ্চায়েতগুলি শাসক দলের দখলে চলে এসেছে সহজেই। কীর্ণাহারে দলের ক্যাম্প ছেড়ে মিরাটির দিকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে এলাকার তৃণমূল বিধায়ক গদাধর হাজরা কিন্তু বলে গেলেন, “এ বার অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোট হচ্ছে।”
ভোটের লাইনে থুপসড়াবাসী।
ভোট হলেও নানুরে এখন সিপিএম, ফরওয়ার্ড ব্লক, কংগ্রেস বা বিজেপি প্রার্থীদের দূরবীন দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাম-ডান নয়, এলাকার মানুষ এখন অন্য লড়াইয়ের সাক্ষী। তৃণমূলের সঙ্গে তৃণমূলের লড়াই। ‘প্রকৃত’ তৃণমূলের সঙ্গে ঝোপ বুঝে কোপ মারা তৃণমূলের লড়াই। যে ভোট-যুদ্ধের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে দলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল-গোষ্ঠী। আরেক প্রান্তে নানুরের তৃণমূল বিধায়ক গদাধর হাজরা, কেতুগ্রামের তৃণমূল বিধায়ক শেখ শাহনওয়াজ-গোষ্ঠীর লোকজন। যে ক’টি আসনে ভোট হচ্ছে, সেখানে লড়াই এই দুই গোষ্ঠীর প্রার্থীদেরই মধ্যে।
গত পঞ্চায়েত ভোটে নানুরের ১১টির মধ্যে ১০টি পঞ্চায়েতই ছিল বামফ্রন্টের হাতে। একমাত্র চণ্ডীদাস-নানুর পঞ্চায়েত ছিল তৃণমূলের। লোকসভা ও বিধানসভা ভোটের পরে ব্যাপক পালা বদল ঘটে। ফরওয়ার্ড ব্লক, আরএসপি, সিপিআই, সিপিএম-এর বহু সদস্য তৃণমূলে চলে আসেন। অনাস্থা এনে সব ক’টি পঞ্চায়েতই কার্যত তৃণমূলই দখলে নেয়। সে দিক থেকে দেখলে এই পঞ্চায়েত ভোটে নানুরে বামেদের হারানোর কিছুই নেই। এখন লড়াই শুধু তৃণমূল আর প্রতীক না পাওয়া তৃণমূলে।
ফব-র দাপুটে নেতা রানা সিংহ বিধানসভা ভোটের পরে অনুব্রত মণ্ডলের হাত ধরে তৃণমূলে ভিড়ে যান। তারপর থেকেই নানুরে তৃণমূলের একটা বড় অংশই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন জেলা সভাপতির বিরুদ্ধে। নানুরের তৃণমূল দু’টি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। এক দিকে অনুব্রত-গোষ্ঠী, যাঁদের সঙ্গে রানা সিংহ আছেন। অন্য দিকে, গদাধর হাজরা, কেতুগ্রামের বিধায়ক শেখ শাহনওয়াজ, তাঁর ভাই কাজল শেখ মিলে অন্য গোষ্ঠী। নানুরে দ্বিতীয় গোষ্ঠীই প্রভাবশালী। সেখানকার অধিকাংশ গ্রাম পঞ্চায়েত ও পঞ্চায়েত সমিতি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় গদাধর-গোষ্ঠীর দখলেই এসেছে। ফলে ভোট হতো বাকি থাকা কয়েকটি পঞ্চায়েত আসন ও একটি জেলা পরিষদ আসনের নির্বাচন, দু’পক্ষের কাছেই সম্মানরক্ষার জোর লড়াই হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সকালে দাসকল গ্রামে উৎসবের মেজাজেই ভোট হচ্ছিল। গ্রামটি রানা সিংহের দৌলতে এতদিন ফরওয়ার্ড ব্লকের দখলে ছিল। আজ কোনও বুথেই সিপিএমের এজেন্ট নেই। একদা বামেদের দুর্গ এখন সবুজে ছয়লাপ। দেখা হতেই রানা-বিরোধীদের অন্যতম গ্রামেরই তৃণমূল নেতা সুব্রত সরকার কোনও রকম রাখঢাক রেখেই না রেখেই বললেন, “রানা সিংহ দুর্নীতিগ্রস্ত ও সুবিধাভোগী মানুষ। আমরা যাঁরা গ্রামের উন্নতি চাই, তাঁরা রানা সিংহের বিরোধী। রানা সিংহকে অনুব্রত মণ্ডল আশ্রয় দেওয়ায়, আমরা তাঁরও বিরোধী।” যদিও তাঁর দাবি, তাঁরা প্রার্থী না দিলেও জেলা পরিষদের আসনটিতে অনুব্রত-গোষ্ঠীর প্রার্থী সুব্রত ভট্টাচার্যের হয়েই এলাকায় ভোট করছেন। নানুরের হাওয়া যদিও অন্য কথা বলছে। অনুব্রত-গোষ্ঠীর নালিশ, ওই আসনটিতে গদাধর-গোষ্ঠী প্রকারন্তরে সিপিএমের হয়েই ভোট করছে।
দাসকল গ্রামের ঠিক উল্টো চিত্র দাসকল গ্রাম-কড়েয়া ১ নম্বর পঞ্চায়েতের জুগুটিয়া গ্রামে। পরিবর্তনের পরেও লাল পতাকায় ছেয়ে আছে গ্রাম। তবে ঠিকই জৌলুসটা আর আগের মতো নেই। গ্রামের পুকুরের ধারে গাছের তলায় গুটি কয়েক সিপিএম কর্মী ভোটার তালিকা নিয়ে বসে ছিলেন। সেখানেই এলাকার সিপিএম শাখা সম্পাদক সঞ্জয় হাজরা স্বীকার করে নিয়ে বললেন, “গত বিধানসভা ভোটেও আমরা এই একই জায়গায় ক্যাম্প করেছি। কত হইচই হয়েছে। খাওয়া-দাওয়া হয়েছে। এখন আর সে দিন নেই।” অতীত নিয়ে সিপিএম কর্মীরা হতাশ হলেও আশ্চর্যজনক ভাবে জেতার ব্যাপারে তাঁদের আত্মবিশ্বাসী দেখা গেল। সিপিএম কর্মী সত্যনারায়ণ মাঝি বলেন, “এই পঞ্চায়েতের ১০টি আসনের সব ক’টি বুথেই আমরা লিড পাব। কারণ, রানা সিংহ।” তৃণমূলের বিক্ষুব্ধদের জোরেই এখন জেতার কথা ভাবছে পরিবর্তিত নানুরের সিপিএম!
মালিকানা বদল হওয়ার পরে নানুরের নিহত সিপিএম বিধায়ক আনন্দ দাসের বাড়ি।
থুপসড়া পঞ্চায়েতের রামকৃষ্ণপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট দিতে দেখা গেল হারুন শেখ ও জাহানা বিবিকে। তাঁরা রাজা শেখের বাবা-মা। রাজা ২০০০ সালের ২৭ জুলাই সুচপুরে খুন হওয়া ১১ জন খেতমজুরের (তৃণমূল সমর্থক বলে দাবি) এক জন। থুপসড়া পঞ্চায়েতের ২১টির মধ্যে ১৬টি আসনে ভোট হচ্ছে। তবে সেখানেও লড়াই অনুব্রত-গোষ্ঠী বনাম গদাধর-গোষ্ঠীর। যদিও ৩২ জন প্রার্থীর মধ্যে মাত্র ১২ জনই তৃণমূলের প্রতীক পেয়েছেন। ভোট হচ্ছে থুপসড়া পঞ্চায়েত সমিতির তিনটি আসনেও। যার একটিতে গদাধর-গোষ্ঠী প্রার্থী করেছে বিউটি বেগমকে। তিনি এলাকার দাপুটে তৃণমূল নেতা প্রয়াত সোনা চৌধুরীর স্ত্রী। আর একটি মাত্র আসনে ভোট হচ্ছে চণ্ডীদাস-নানুর পঞ্চায়েতে। সেখানেও লড়াই তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর মধ্যেই। তবে কোনও ভোট হচ্ছে না সুচপুরে। সেখানেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছে শাসক দলই।
এমন একপেশে ভোট-যুদ্ধের দিনে একমাত্র চমকটা ছিল সন্ধ্যায় সাকুলিপুর গ্রামে। সেখানেই নানুরের খুন হওয়া সিপিএম বিধায়ক আনন্দ দাসের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা পাকা দোতলা বাড়ি। আনন্দ দাসের স্ত্রী মেয়েকে নিয়ে এখন বোলপুরে থাকেন। ‘পরিত্যক্ত’ সে বাড়িটিতে এতদিন কেবল ঘুঘুই চড়ত। আজ, মালিক বদলে নতুন রং লেগেছে সেই পুরনো বাড়িতে। বদল দেখা গেল, সাদা বাড়ির অদূরেই থাকা নানুর জোনাল কমিটির অফিসেও। দিল্লিতে রাজ্যের অর্থমন্ত্রীর হেনস্থার প্রতিবাদের পরে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল সেই পার্টি অফিস। আজও তালাবন্ধ সেই অফিস। তবে অফিসের পুড়ে যাওয়া কাঠের দরজা কবে যেন বদলেছে লোহার দরজায়।

ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.