ভোটে নেই, তবু চরমেঘনাতেই মন পড়ে মহিষকুন্ডার
ভিজে গামছায় পিঠ রগড়ে নদীর ওপার থেকে আবু হাসেম হাঁক পাড়েন, “কী কর্তা, নতুন মুখ যে, ভোট দ্যাখতি আসতিছেন নাকি!” গত ক’দিনের বর্ষায় ছিপছিপে মাথাভাঙা নদী এক গলা জল নিয়ে তর তর করে বইছে। ওপারে সবুজ পাট খেতের আড়ালে মহিষকুণ্ডা গ্রাম। জেলা কুষ্ঠিয়া, বাংলাদেশ। ভারতের শেষ ভূখণ্ড, চরমেঘনার ঘাটে দাঁড়িয়ে, আমাদের ছুড়ে ছুড়ে সংলাপের মাঝে এ পাড়ের মাছরাঙা উড়ে যায় ও প্রান্তের জামরুল গাছে। দেশের সীমানা ভেঙে ও পাড়ের কৌতূহল উড়ে আসে এ পাড়ে, “আপনাগো চরমেঘনার ভোটে এ বার কী হইবে কর্তা?”
আধাসেনার অনুশাসনে দিনযাপন করা ছোট্ট ছিটমহল জুড়েও এই ঘোর শ্রাবণে এ প্রশ্নটাই মুখ্য। কী হবে?
যা-ই হোক না, তা বলে ‘ওদের’ এমন কৌতূহল কেন? পড়শি দেশের এই ঔৎসুক্যের প্রশ্নেই প্রচারের সুর বেঁধেছে হাত-হাতি-হাতুড়ি-ঘাসফুল। এক ফালি নদীর তো ব্যবধান। পড়শি দেশের একটু কৌতূহল থাকতে পারে না?
চরমেঘনার সীমারেখা। ছবি: কল্লোল প্রামাণিক।
চরমেঘনার গ্রাম সংসদের বিদায়ী সদস্য বহুজন সমাজ পার্টিব (বিএসপি) সমর বিশ্বসারে কাছে প্রশ্নটা রাখতেই আঁচানো তেলে মাছ ছাড়ার মতো ছ্যাঁক করে উঠছেন, “ওপাড়ের মাইনষের আমাগো ভোটের ফলাফল নিয়ে কামডা কি শুনি!” হাতি প্রতীকে জয়ের সুবাদে চরমেঘনা ‘আদর’ করে তাঁর নাম রেখেছে ‘সমর হাতি’। তাতে অবশ্য আপত্তি নেই। ‘অপরাধ’ শুধু পড়শি মহিষকুন্ডার গ্রামীণ মানুষের কৌতূহলে। বাড়ির উঠোনে সাবেক শৌচাগারটা পাকা করার তদারকির ফাঁকে জানিয়ে দিচ্ছেন তিনি, বিদেশী হানা রোখাই এক মাত্র লক্ষ্য তাঁদের।
ডোমকল-করিমপুর রাজ্য সড়ক থেকে সেই ‘বিদেশ’ সাকুল্যে তিন কিলোমিটার। মেঘনা বর্ডার আউটপোস্টে বিএসএফের এক প্রস্ত জেরার পরে কিলোমিটার দেড়েক হাঁটলে কাঁটাতারের সেই অমোঘ বেড়া। শীর্ণ দুই বলদ নিয়ে মাঠে যাওয়ার পথে মেঘনা গ্রামের মহিতোষ মণ্ডল বলেন, “এই যে ‘ন্যাশনাল কাঁটা’ দেখত্যাছেন তার ওপারে চরমেঘনা। যাইতে হইলে বিএসএফের কাছে ভোটার কার্ড জমা রাখতি হইব।” শুধু কার্ড নয়, বিএসএফের জিম্মায় আরও এক গুচ্ছ শর্ত মেনে চলার প্রতিশ্রতি দিয়ে বাংলাদেশের জমিতেই নদিয়ার করিমপুর-১ ব্লকের হোগলবেড়িয়া পঞ্চায়েতের চরমেঘনার ঠিকানায় প্রবেশের অনুমতি মেলে।
চরে এ বার বিএসপি প্রার্থী দীনেশ সর্দার। বাঁশ ঝাড় থেকে বাড়ির দাওয়া, পত পত করে উড়ছে বৃষ্টি ভেজা প্লাস্টিকের আর্দ্র নীল পতাকা। বিএসপি’র এমন ঘোর প্রতিপত্তির মাঝে দীনেশবাবু জানান, রাত বিরেতে নদী সাঁতরে গোয়ালের গরু খুলে নিয়ে যাওয়া, সিঁধ কেটে চুরি, মাঠের ফসল লুঠমহিষকুন্ডার ‘অত্যাচারে’ জেরবার চরমেঘনা। বিএসপি’র প্রচারের মূল প্রতিপাদ্যই তাই ‘বাংলাদেশি হানা’। গর্ব করেই জানিয়েও রাখছেন, মাস কয়েক আগে এক ‘অনুপ্রবেশকারীকে’ পিটিয়ে মারতেও কসুর করেননি তাঁরা। অপক্ক রাস্তা, বারো কিলোমিটার দূরের সবেধন শিকারপুর স্বাস্থ্যকেন্দ্র, পরিশুদ্ধ জলের আকাল, সর্বোপরি সীমান্তরক্ষীদের অনুকম্পায় দিনযাপন, এ সব নয়, চরমেঘনায় পড়শি দেশের উৎপাতকেই প্রাধান্য দিয়ে এ বার ভোট বাঁধছে বহুজন সমাজ পার্টির মতো অন্যরাও। চরের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু ‘ঘাসফুল’, ‘কাস্তে-হাতুড়ি’ আর ‘হাত’। বিএসপি’র নীলে তারা কিঞ্চিৎ ম্লান। তা হোক, তবে প্রচারে সেই হাত-হাতি-পদ্ম-কাস্তের একই রা। শাসক দলের প্রার্থী উত্তম সর্দার কিংবা কংগ্রেসের অনুপ বিশ্বাস জানান, ওপারের হানাদারদের জন্য গ্রামের সব গরু এক জায়গায়, বাঁশের ঘেরাটোপে ‘খাটাল’ করে রাখতে হয়। বাংলাদেশি হানা ঠেকিয়ে মাঠের ফসল ঘরে তোলাই দায়। সিপিএম প্রার্থী বুদ্ধদেব মাহাতোরও পুরনো কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, “এমনটা কিন্তু ছিল না জানেন। পুরনো বন্ধুত্বটাই হারিয়ে গিয়েছে।”
আর মাথাভাঙা নদীর ওপারে স্নান সেরে আবু হাসেম বলেন, “চোর-ডাকাত তো আর মহিষকুন্ডার নয়। তারা সব ভিন গাঁয়ের লোক।” এত দিনের সম্পর্কটা নিছকই চুরির দায়ে বিকিয়ে যাবে? আবু বলেন, “ঈদে আপনাগো চরের মানুষকে কিন্তু মিষ্টি পাঠাই কর্তা, মনে রাখবেন!” ভোটের চরমেঘনার মনে পড়ছে কি সে কথা?

পুরনো খবর:



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.