দায় কার, অধীর-ফিরহাদ তরজা |
এক্সপ্রেসে দুষ্কৃতীর থাবা এড়াতে ঝাঁপ তরুণীর |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
দ্রুত গতিতে বেলুড় স্টেশন পার হচ্ছে হাওড়ামুখী দিল্লি জনতা এক্সপ্রেস।
মহিলা কামরার আপৎকালীন জানলা থেকে দেহের অনেকটা বার করে ‘বাঁচাও, বাঁচাও’ বলে চিৎকার করছেন বছর পঁচিশের এক তরুণী।
স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রীরা কিছু বোঝার আগেই চলন্ত ট্রেন থেকে ঝাঁপ দিলেন ওই তরুণী।
এলাকার লোকজন এবং যাত্রীরা ক্ষতবিক্ষত তরুণীকে উদ্ধার করে নিয়ে যান হাসপাতালে। বেলুড় স্টেশন এলাকার বাসিন্দা সঞ্জয় মাঝি, মন্টু বাগ, অমিয় দত্তেরা বলেন, “ট্রেনটি স্টেশন পেরোনোর সময়েই দেখা যাচ্ছিল, একটি কামরার জানলা থেকে এক মহিলা হাত নেড়ে কী যেন বলছেন! দ্রুত ট্রেন চলে যেতেই দেখি, তিনি রেললাইনের পাশে পড়ে আছেন।” গুরুতর আহত ওই তরুণী চিকিৎসকদের জানান, ফাঁকা মহিলা কামরায় এক যুবক তাঁকে জাপটে ধরে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করছিল। তার হাত থেকে বাঁচতেই সাহায্য চাইছিলেন তিনি। তাঁর আর কিছু মনে নেই। প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশ জানায়, আপৎকালীন জানলায় লোহার গরাদ থাকে না। ধস্তাধস্তির মধ্যেই সেই জানলা দিয়ে ঝাঁপ দেন ওই তরুণী। |
হাসপাতালে সেই আহত তরুণী।— নিজস্ব চিত্র |
ঘটনাটি ঘটেছে রবিবার বিকেল সাড়ে ৪টেয়। হাসপাতালে ওই তরুণী জানান, তিনি কলকাতার একটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার কর্মী। বাড়ি আসানসোলের লোয়ার চেলিডাঙায়। এ দিন বেলা ১টা নাগাদ তিনি আসানসোল থেকে ওই ট্রেনের মহিলা কামরায় ওঠেন। ব্যান্ডেলে অন্যেরা নেমে যান। কামরায় একা হয়ে যাওয়ায় তিনি ভয় পাচ্ছিলেন। তরুণী জানান, ব্যান্ডেলের পরের একটি স্টেশন থেকে লুঙ্গি-শার্ট পরা এক যুবক ওই কামরায় উঠেই জানলা বন্ধ করতে শুরু করে।
ওই তরুণী বলেন, “জানলা বন্ধ করতে দেখে প্রতিবাদ করি। যুবকটি পাশে এসে বসে। শাসাতে থাকে। হাত থেকে মোবাইলটি কেড়ে নেয়। জাপটে ধরে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে।” তিনি চিৎকার শুরু করেন। তাঁর কথায়, “নিজেকে বাঁচাতে আপৎকালীন জানলা খুলে শরীরের অনেকটা বার করে চেঁচাতে থাকি। তার পরে আর কিছু মনে নেই।”
অবিলম্বে ওই ঘটনার তদন্তের জন্য ডিজি নপরাজিত মুখোপাধ্যায়কে নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ফোনে তরুণীর বাবা ও দাদাকে জানান, তাঁদের মেয়ের চিকিৎসার দায়িত্ব নেবে রাজ্য। রাতেই তরুণীকে বেলুড় স্টেট জেনারেল হাসপাতাল থেকে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়।
পুলিশ জানায়, তরুণীর মাথায় চারটি সেলাই দিতে হয়েছে। দু’টো হাতই ভীষণ জখম হয়েছে বলে জানান চিকিৎসকেরা। হাওড়ার রেল পুলিশ সুপার মিলনকান্ত দাস বলেন, “তরুণীর আতঙ্ক কাটেনি। তাই তাঁর সঙ্গে বিশদ ভাবে কথা বলা যায়নি। তবে তদন্তে জানা গিয়েছে, তিনি জানলা দিয়ে ঝাঁপ দিয়েছিলেন।” তরুণীর ব্যাগটি ওই কামরাতেই পায় পুলিশ। কিছু খোয়া যায়নি। অর্থাৎ আক্রমণকারীর চুরির মতলব ছিল না বলেই মনে করছে পুলিশ। তবে তরুণীর মোবাইল উধাও। পুলিশের ধারণা, যুবকই সেটি নিয়েছে।
খবর পেয়ে বিকেলেই বাড়ি থেকে রওনা হন তরুণীর বাবা। কলকাতার গাঙ্গুলিবাগানে ভাড়াবাড়িতে থাকেন তরুণী। ওই বাড়ির মালিক জানান, ‘চিকেন পক্স’ হওয়ায় বাড়ি চলে গিয়েছিলেন তরুণী। সোমবার তাঁর কাজে যোগ দেওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু এক্সপ্রেসের মহিলা কামরায় নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না কেন?
জিআরপি-কর্তারা জানান, বেশির ভাগ পুলিশ ভোটের কাজে ব্যস্ত। তাই এখন অনেক ট্রেনেই যথেষ্ট পুলিশ নেই। তারই সুযোগ নিয়েছে দুষ্কৃতী।
ওই ঘটনার দায় নিয়ে রেল ও রাজ্য সরকারের মধ্যে চাপান-উতোর শুরু হয়েছে। রাজ্যের পুর-নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম রেলের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে বলেন, “রেলে নিরাপত্তা বলে কিছুই নেই। আরপিএফ নিরাপত্তা দিচ্ছে শুধু রেলমন্ত্রীকেই!” কামদুনি কাণ্ডের পরে সেখানকার বাসিন্দাদের রাষ্ট্রপতির কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী। ফিরহাদ বলেন, “একটা ঘটনা নিয়ে যাঁরা রাষ্ট্রপতির কাছে গিয়েছিলেন, তাঁরা কি এঁকেও রাষ্ট্রপতির কাছে নিয়ে যাবেন? কংগ্রেসকে জবাব দিতে হবে। অধীরকে দায় স্বীকার করতে হবে।”
রেলকে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান অধীরবাবু। ফিরহাদের খোঁচার উত্তরে তিনি বলেন, “রেলে যাত্রী-নিরাপত্তার দায় রাজ্যের। আরপিএফ শুধু রেলের সম্পত্তি পাহারা দেয়। দুঃখ হয়, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং ওঁদের দলের অনেকেই রেলমন্ত্রী ছিলেন। তবু তাঁরা এই আইন জানেন না!” তাঁর কটাক্ষ, রাজ্যের পুলিশের উপরে মুখ্যমন্ত্রীরই যে কোনও ভরসা নেই, তাঁর নিরাপত্তায় আরপিএফ দেওয়ার ঘটনাতেই সেটা স্পষ্ট।
|