অবশেষে রাজ্য নির্বাচন কমিশনকে মুখ্যসচিব পত্রযোগে জানাইয়াছেন যে, অনুব্রত মণ্ডলের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা লওয়া হইবে। বীরভূমের তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি অনুব্রতবাবু যে ভাষায় এবং ভঙ্গিতে বক্তৃতা দিয়াছিলেন, তাহা যে ‘প্ররোচনামূলক’, সেই সত্য বুঝিতে সরকারের এতটা সময় লাগিল কেন, সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য কোনও পুরস্কার নাই এ রাজ্যে সরকারি আচরণের কার্যকারণসূত্রটি কোথায় কী ভাবে বাঁধা থাকে, তাহা অ-বিজ্ঞজনেও বিলক্ষণ জানেন। একই ধরনের ব্যবস্থা কেন যে কোনও প্ররোচনামূলক আচরণের ক্ষেত্রেই লওয়া হইবে না, শ্রদ্ধেয় সাংসদ তাপস পালই বা কেন ছাড় পাইবেন, তাহার উত্তরও বাতাসে ভাসিতেছে। শাসক দলের বিভিন্ন নেতা, জনপ্রতিনিধি, সাংসদ গত দুই বছরে নানা উপলক্ষে এমন অনেক কথা বলিয়াছেন, এমন নানা আচরণ করিয়াছেন, যাহা স্বাভাবিক সৌজন্য বা সভ্যতার ন্যূনতম শর্তও পূরণ করে না। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দলীয় নেতৃত্ব বা সরকারি কর্তৃত্ব শাস্তি দূরস্থান তিরস্কারের আয়োজনও করে নাই। এই চূড়ান্ত এবং ধারাবাহিক প্রশ্রয় পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির পঙ্কিল ধারাটিকে আরও পঙ্কিল করিয়াছে। সেই অধঃপতনের নিত্য নূতন নমুনা দেখিতে দেখিতে এবং শুনিতে শুনিতে রাজ্যবাসী সম্ভবত সংশোধনের সমস্ত আশা ছাড়িয়া দিয়াছেন।
ধারাটি যে বর্তমান জমানাতেই প্রথম পঙ্কিল হইয়াছে, তাহা বলা চলে না। ভদ্রতাবোধ লইয়া বাঙালির যত গর্বই থাকুক, পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে অশালীনতার ব্যাধি প্রাচীন। এক কালে কংগ্রেস নেতা অতুল্য ঘোষের শারীরিক সমস্যা লইয়া বামপন্থীরা যে ধরনের প্রচার করিতেন বা ইন্দিরা গাঁধী ও সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়কে লইয়া মহানগরের দেওয়ালে দেওয়ালে যে চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন করিতেন, অনুব্রত মণ্ডল, তাপস পাল বা জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকরা এখনও তাহার ধারে-কাছে পৌঁছাইতে পারেন নাই। বামপন্থীরা যে সাম্প্রতিক কালে উন্নততর হইয়াছেন, এমনটাও বলিবার উপায় তাঁহারা রাখেন নাই শাসক শিবিরের অনিল বসু হইতে বিরোধী পক্ষের আনিসুর রহমান আজও সৃষ্টিশীল। কিন্তু পূর্ববর্তী শাসকরা গালিগালাজ করিতেন বলিয়া বর্তমান শাসকদেরও গালিগালাজ করিতে হইবে, ইহাকে সম্ভবত ‘পরিবর্তন’ বলে না।
দেখা যাইতেছে, অশোভন উক্তি এবং অশালীন আচরণের বর্তমান শাসকরা উত্তরোত্তর পূর্বসূরিদের অতিক্রম করিতেছেন। বিশেষত, তৃণমূল কংগ্রেসের বিভিন্ন বক্তা দলীয় কর্মীদের যে ভাবে সরাসরি বিরোধীদের উপর আক্রমণে উৎসাহিত করিতেছেন, তাহা কেবল লজ্জাকর নয়, ভয়ঙ্কর। আক্ষেপের কথা ইহাই যে, স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী এই অশালীনতাকে কঠোর ভাষায় তিরস্কার না করিয়া এবং তাঁহাদের শাস্তি না দিয়া বরং নিজেও মাঝে মাঝেই এমন ভাবে বিরোধীদের উদ্দেশে তোপ দাগিতেছেন যাহা পরোক্ষে এই অনাচারকে প্রশ্রয় দেয়। নির্বাচনী প্রচারে, বিশেষত পঞ্চায়েত স্তরের ভোটসভায় শালীনতার সীমা লঙ্ঘনের ঐতিহ্য পুরাতন, কার্যত সর্বভারতীয়। কিন্তু প্রশাসনের আচরণে যেমন, নেতাদের ভাষা ব্যবহারেও তেমনই একটি সামগ্রিক বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের যে পরিবেশ পশ্চিমবঙ্গে অধুনা তৈয়ারি হইয়াছে, তাহা কঠোর হস্তে প্রতিরোধ না করিলে রাজ্যের সংকট ক্রমশই বাড়িবে। একটি অ-সভ্যতার সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসাবে ইতিহাসে তাঁহার নাম লেখা থাকিবে, মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই তাহা চান না। |