সম্পাদকীয় ১...
স্থাপত্য নামক শিল্প
জাতি হিসাবে বাঙালির যতই শিল্প-সংস্কৃতির ধ্বজা উড়াইবার খ্যাতি থাকুক, বাঙালি মুখ্যমন্ত্রীদের অধিকাংশই কিন্তু শিল্প বা সংস্কৃতির বড় একটা ধার ধারেন নাই। বিধানচন্দ্র রায় হইতে জ্যোতি বসু, কাহারও মধ্যে এই ব্যুৎপত্তির চিহ্ন কোনও কালে দেখা যায় নাই। বরং জ্যোতি বসুর পরবর্তী দুই মুখ্যমন্ত্রী সেই দিক দিয়া ব্যতিক্রমী। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁহাদের মত ও পথ, প্রকৃতি ও পদ্ধতির বিস্তর প্রভেদ সত্ত্বেও, কিছু সংস্কৃতিমনস্কতার পরিচয় দিয়া থাকেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবশ্য তাঁহাদের দুই জনেরই উৎসাহ বাড়াবাড়ির মাত্রা স্পর্শ করে। তবে সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে রাইটার্স বিল্ডিং-এর যে সংস্কার প্রস্তাবিত হইয়াছে, তাহাকে স্বাগত। যে অতি-ভিড়াক্রান্ত পরিকল্পনারহিত বিশালাকার ভবনটিতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য নিয়ামকরা প্রাত্যহিক ভিত্তিতে তাঁহাদের প্রশাসন-ভার চালাইয়া থাকেন, তাহার আপাদমস্তক সংস্কার একটি বহু-প্রতীক্ষিত কাজ। মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই মনে রাখিতেছেন যে, আড়াই শত বৎসরের কাছাকাছি বয়সের প্রশাসনিক কেন্দ্রের সংস্কার কেবল সৌন্দর্যায়নের মধ্যেই সীমিত থাকিতে পারে না, কেবল উপর-উপর পুনর্বিন্যাসই ইহার জন্য যথেষ্ট হইতে পারে না। রাইটার্স বিল্ডিং-এর সত্যকারের সংস্কার করিতে হইলে ঐতিহাসিক ভবনটির অভ্যন্তরীণ নকশাও প্রয়োজনে ভাঙিয়া-চুরিয়া গড়িয়া লইতে হইবে। ঘিঞ্জি পরিসরে উপর্যুপরি মন্ত্রক-বিভাগগুলি না সাজাইয়া, দেওয়াল ভাঙিয়া, কক্ষবিভাজিকা সরাইয়া, নূতন কক্ষ নির্মাণ করিয়া, অলিন্দ ও গবাক্ষ বাড়াইয়া সামগ্রিক পুনর্নির্মাণ করিতে হইবে। কাজটি কঠিন। আরও কঠিন এই জন্যই যে, অভ্যন্তরীণ পুনর্নির্মাণ ঘটাইতে হইবে বাহিরের ঐতিহ্যবাহী চেহারাটি বজায় রাখিয়া, ১৭৭৭ সালের ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের দৃষ্টিনন্দনকারী দৃষ্টান্তটিকে যথাসাধ্য বাঁচাইয়া।
অর্থাৎ এই কাজে প্রয়োজন হইবে যোগ্য স্থাপত্যশিল্পীদের। এই কাজের যোগ্য ব্যক্তিদের খুঁজিয়া পাওয়া পশ্চিমবঙ্গে বেশ দুরূহ। ঐতিহাসিক ভাবেই দেখা গিয়াছে, বাঙালি ‘শিল্প’চেতনার ব্যাপ্ত পরিসরটিতে স্থাপত্যের কোনও গুরুত্বপূর্ণ স্থান কোনও কালে নাই। বাঙালি স্থপতিমাত্রেই কাজ চালাইবার লক্ষ্যটুকুই জানেন। এত সামান্য তাঁহাদের কল্পনা কিংবা পরিকল্পনার দৌড়, যে অনেক সময় সেই ‘কাজ চালানো’র কাজটিও হইয়া উঠে না। অন্যান্য দেশে স্থাপত্যবিদ্যা একটি স্বাধীন সৃজনমূলক বিদ্যা বলিয়া বিবেচিত হইলেও বাঙালি ‘সৃজন’ বাদ দিয়া স্থাপত্যের প্রযুক্তিটুকুই বোঝে, স্থাপত্য বিদ্যাচর্চায় কেবল ইঞ্জিনিয়ারদেরই (পরীক্ষার মাপকাঠিতে তুলনায় নীচের দিকের ইঞ্জিনিয়ারদের) স্থান দেয়! কল্পনার স্থান লয় কৃৎকৌশল। সৃষ্টির স্থান লয় নির্মাণ। তাই স্থাপত্য এখানে শিল্প নহে, নেহাত দ্বিতীয় শ্রেণির প্রায়োগিক বিদ্যা মাত্র।
সুতরাং, অকস্মাৎ ঔপনিবেশিক কলিকাতার শাসনকেন্দ্র রাইটার্স বিল্ডিং-এর পুরাতন নকশা টানিয়া বাহির করিবার প্রয়াস শুনিতে যতই ব্যতিক্রমী হউক, কী ভাবে এই কাজটি কল্পিত ও পরিকল্পিত হইতেছে, ইহার উপরেই সাফল্য নির্ভর করিতেছে। শাসনকার্য সুষ্ঠু ভাবে চালাইবার জন্য শাসনকেন্দ্রটির চেহারা পাল্টাইবার প্রয়োজন নিশ্চয়ই রহিয়াছে, তবে একটি ঐতিহ্যমণ্ডিত ভবনের মধ্যে তাহা করিতে হইলে স্থাপত্য-পরিকল্পনায় অবশ্যই ঐতিহ্যের সহিত আধুনিকতার মিশেল বানাইতে হইবে। এই মিশেলটি রচনার জন্য অঙ্কের সঙ্গে শিল্পবোধও লাগে। যে শিল্প রহিয়াছে লুতিয়েনস্-এর দিল্লিতে। যে শিল্প আছে ইউরোপের শহরগুলির স্থাপত্যে। শ্রেষ্ঠ মানটিতে পৌঁছাইতে না পারিলেও শ্রেষ্ঠত্বের মানদণ্ডটি মাথায় রাখা প্রয়োজন। যথার্থ নগর-বিন্যাসের কাজে নামিতে হইলে কৃৎকৌশলের পরিবর্তে শিল্পের দিকে উৎসারিত হওয়া প্রয়োজন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.