|
|
|
|
যত কাণ্ড নাম নিয়ে
ডাকনামই অনেক সময় হয়ে উঠতে পারে আস্ত একটা
ব্যক্তিত্বের স্টাইল স্টেটমেন্ট। কী ভাবে? খোঁজ নিলেন অদিতি ভাদুড়ি |
সাফল্যের অব্যর্থ বাজি জেতায় তাঁর জুড়ি কেউ ছিল না। নাম বদলেও তিনি সফল। অরুণ কিংবা অরূপ কোনও নামেই তাঁর খ্যাতি হল না। লোকে তাঁকে একটি নামেই চিনল —উত্তমকুমার।
কিংবা ধরুন, প্রদোষ সি মিটার। এই নামে তাঁকে আর ক’জন মনে রাখে? ডাকনামেই আবালবৃদ্ধবনিতার কাছে তাঁর পরিচিতি। তিনি ফেলুদা।
সত্যজিৎ রায়ের গোয়েন্দা সিরিজ কি এত জনপ্রিয় হত, যদি গোয়েন্দার নাম হত শুধুই প্রদোষ? হয়তো জনপ্রিয় হত। কিন্তু ফেলুদা নামটা উচ্চারণ করে আপামর বাঙালি তাঁর সঙ্গে যে ভাবে একাত্ম বোধ করেন সেটা নিশ্চয়ই হত না। আর পরিচালক সত্যজিৎ রায়ও তো ‘মানিক’ ডাকনামেই বেশি পরিচিত ছিলেন তাঁর চেনা মহলে।
শেক্সপিয়রের সেই অমোঘ উক্তি মনে আছে নিশ্চয়ই? ‘হোয়াটস ইন আ নেম....’ পাঁতি বাংলায় ‘নামে কী বা আসে যায়...’। কিন্তু বৃহত্তর ভাবে দেখতে গেলে নামে অবশ্যই আসে যায়।
ডাকনাম যদি হয় জিমি আর টমি
পাতিপুকুরের যমজ দুই বোন রিনা আর অরুণিমা। ছোটবেলায় আদর করে ওদের দিম্মা ডাকনাম রেখেছিলেন টমি আর জিমি। জিনিয়া খেদের সঙ্গে জানাল, ওই নামে দিম্মা যখন ডাকে তখন পাশের বাড়ির লাট্টুদের কুকুরটা বেরিয়ে আসে। “সবথেকে সমস্যা হয় স্কুলে গেলে। বন্ধুরা এত খেপায়!” সিলভিয়াও সমস্বরে বলে, “দিম্মাকে বারণ করি এই নামে আর না ডাকতে। এখন তো আমরা বড় হয়েছি, না কি! প্রেস্টিজ ইস্যু হয়ে গিয়েছে একদম।”
এখনকার ছেলেমেয়েরা কিন্তু ডাকনাম নিয়ে ভীষণ সেনসেটিভ। বাবা-মা আর যাই হোক কোনও খারাপ নাম দেবেন না। এই ধরুন শহরের এক খ্যাতনামা স্কুল-পড়ুয়া ছেলের ডাকনাম বাবা-মা দিল গগন, বা পঞ্চানন। মানে, ভাবা যায় কি? ছোট্ট স্কুল-পড়ুয়া রৌদ্র বেশ রিঅ্যাক্ট করল শুনে। ভ্রু-জোড়া কুঁচকে বলল, “আমার ফ্রেন্ডদের ভাল ভাল নাম। শান্তনু, নিখিল, হর্ষিতা। কিন্তু হর্ষিতার ডাকনাম ‘চিনমিনি’। ওর মা আদর করে ডাকে। আমরা ওকে খেপাই। চিনমিনি খুব রেগে যায়।” রৌদ্রর ডাকনাম অবশ্য ‘রম্য’। |
|
হরিয়ানা হ্যারিকেন
যাঁরা দেশের-দশের হিরো, ভালবেসে তাঁদের নানা ডাকনাম দেওয়ার চল তো চলে আসছে বহু দিন আগে থেকেই। ফুটবলভক্তরা নিশ্চয়ই ‘বেকস্’ ডাকনামটার সঙ্গে সুপরিচিত! কার আবার? ওটা তো ফুটবলের সুপারস্টার ডেভিড বেকহ্যামের ডাকনাম। বা কপিলদেব নিখাঞ্জের ‘হরিয়ানা হ্যারিকেন’ ডাকনামটাও তো সর্বজনবিদিত। ভারতে হোক কী বিদেশে, ক্রিকেট নিয়ে যাঁরা একটু খোঁজখবর রাখেন, তাঁরাই জানেন এই বিখ্যাত ডাকনাম। বিরাট কোহলির ডাকনাম যেমন চিকু। ক্রিকেট ব্যাটে ঝড় তোলা এই ক্রিকেটার তাঁর ডাকনামে ঠিক যেন পাশের বাড়ির ছেলেটি। বা শিখর ধবনের কথাই ধরুন। ‘গব্বর’ ডাকনামের শিখর তো মাঠে ডাকুর মতো হাবভাবেই ছক্কা বা বাউন্ডারি হাঁকান একের পর এক। অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার মার্ক ও-র ডাকনামটাও জানেন অনেকেই। ‘অডি’। আভিজাত্যের মোড়কে মার্কের আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলার ধরনের সঙ্গে এই নামটাই হয়তো জুতসই। বড়লোকের আদুরে ‘অডি’-র মনভোলানো স্টাইলের মতোই।
টেনিসও কম যায় না কিছু। আমেরিকান টেনিস তারকা পিট সাম্প্রাসের ডাকনাম ‘পিস্তল পিট’। তামাম টেনিস অনুরাগীর দেওয়া আদরের এই ডাকনামটা পিট-এর টেনিস অ্যাটিটিউডের সঙ্গে এক্কেবারে মানানসই। স্প্যানিশ টেনিস স্টার নাদালের ভাবভঙ্গি তো এতটাই আগ্রাসী যে ওঁকে ‘ক্যানিবল’ বলেও ডাকেন ওঁর অনেক অনুরাগী।
বলিউড তারকারাই বা বাদ যান কেন! নিজের ‘জওয়ানি’ দিয়ে তো বহু জনকেই তাঁর ‘দিওয়ানি’ বানিয়ে ছেড়েছেন ভারতীয় চলচ্চিত্রের তরুণ সুপারস্টার রণবীর কপূর। আর তাঁর ডাকনামটা? সেটা অনেকেরই অজানা। ‘ডাবু’ নামের এই আদুরে ছেলেকে
আর ক’জনই বা চেনেন? কিংবা দীপিকা পাড়ুকোন? তাঁকে ‘ডিপি’ ডাকনামে চেনেন এমন মানুষের সংখ্যাও কম নয়। আর আমাদের কিং খান ‘শাহরুখ খান’-এর তো ভূরি ভূরি ডাকনাম। ‘এসআরকে’, ‘বাদশা অব বলিউড’, ‘শাহেনশাহ অব বলিউড’ নামে তাঁর ডাকনাম-মুগ্ধ অনুরাগীদের আবেগই জানিয়ে দেয় ডাকনামেই তাঁর আসল পরিচয়।
অপরাজিত অপু
বাংলা সাহিত্যে তো প্রচুর ডাকনাম! আর ডাকনামই যেন প্রকারান্তরে কিংবদন্তি এই সব চরিত্রের আসল নাম হয়ে উঠেছে। সুনন্দ রায়চৌধুরী কে? একবার কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখুন তো! অনেকেই দিতে পারবে না উত্তরটা। এই বার জিজ্ঞেস করুন তো সন্তু কে? সবাই একবাক্যে বলবে কাকাবাবুর সন্তু। সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় অমর করে গিয়েছেন এই চরিত্র দুটিকে। পটলডাঙার ভজহরি মুখোপাধ্যায়কেই বা তার ভাল নামে কে আর চেনে! টেনিদা নামেই যে তিনি ভুবনবিখ্যাত! সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এই ‘টেনি’ নামের হাস্যরসে মজিয়ে ছেড়েছিলেন আম বাঙালিকে। প্রেমেন্দ্র মিত্র-এর ঘনশ্যাম দাসও ‘ঘনাদা’ ডাকনামেই বাঙালি পাঠকের হৃদয় মাতিয়েছেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অপু’ও এমনই এক ডাকনাম। এই ডাকনামেই স্বনামধন্য হয়ে উঠেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো গুণিজনেরা। অনেকটা রাস্তা পেরিয়েও কিন্তু বাঙালি মননে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় রয়ে গিয়েছেন সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’-এর সেই ‘অপু’-ই। |
নামচরিত |
• আগে ডিকশনারি দেখে
নাম পছন্দ করা হত। এখন তো ডাকনাম বাছতে
গেলেও আস্ত অভিধান
কি ইন্টারনেট—
সবই কাজে লাগছে |
• কে বলেছে ডাকনাম ছোটই হতে হবে? পুশকিন ডাকনামটা
তো ভালই বড়। আর শুনতেও কী মিষ্টি! কী বলেন? |
• শুধু মানুষই নয়, পোষ্যদেরও কিন্তু সুন্দর ডাকনাম থাকে। কখনও শুনেছেন একটা কুকুরের ডাকনাম টিয়াপাখি? |
• শুধু বাবা-মা নয়। বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ডরা তো নিজেদের সুবিধের জন্য সাংকেতিক ডাকনাম বেছে নিচ্ছেন হামেশাই। এর পর যদি ছেলের মোবাইলে ‘পুটু’ নামটা দেখেন, চমকাবেন না একদম। |
• কলেজে পড়েছেন অথচ স্যার বা ম্যাডামের ডাকনাম দেননি এমন ছাত্রছাত্রী খুঁজলেও পাবেন না। তাই তো সিরিয়াস অঙ্কের প্রফেসরের ডাকনাম হয়ে যায় ‘গোমড়ামুখো ক্যালকুলাস’। বা খিটখিটে ইকনমিক্স প্রফেসর হয়ে যান ‘টির্যানোসরাস রেক্স’ |
|
ডাকনামেও থাকছে মননের ছোঁয়া
সাহিত্য হোক কী জীবন, একটা ভাল ডাকনাম কিন্তু একটা সুন্দর জীবনবোধ এবং মননশীলতারও পরিচয় দেয়। উচ্চমধ্যবিত্ত পরিবারের একটা মোটা ছেলের ডাকনাম ‘ঘন্টু’। সেই নাম তার ভবিষ্যৎটাকে পুরোপুরি কবরে পাঠিয়ে দিয়েছে, এমন উদাহরণও আছে, বলছিলেন মনোবিদ সঞ্জয় গর্গ। “বাচ্চাদের যখন বাবা-মা কোনও ডাকনামে ডাকেন, তখন কিন্তু সেটা ইচ্ছাকৃত ভাবে করেন না। কিন্তু ওরা যখন স্কুল-কলেজে যায়, অনেকের সঙ্গে মেলামেশা করে, তখন বোঝা যায় ক্রাইসিসটা। বড় হওয়ার পর, এমনকী বাবা-মাও যদি ওই নামে ডাকেন তা হলে বাচ্চারা অনেক সময় উত্তর না দিয়ে চুপ করে থাকে। অনেকের মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এই সব কারণে,” বললেন তিনি।
পাঁচু, বুঁচু, খেঁদিদের মনঃকষ্ট ওদের বাড়ির লোক বোঝেনি। তবে এই প্রজন্মের বাবা-মায়েরা ঠিকই জানেন যে ডাকনামটাও শুধু ডাকনাম নয়। একটা পূর্ণাঙ্গ আত্মপরিচয়ও। তাই তো এখন বাড়ি বাড়ি ঝিলিক, ঋদ্ধি, রম্য, রিয়া-র মতো ডাকনামের সংখ্যাই বেশি।
|
ডাকনাম দিয়ে যায় চেনা |
রিকি পন্টিং
পান্টার |
স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় ভেবলি |
লিওনেল মেসি
লিও লা পুলগা |
ইন্দ্রাণী হালদার
মামণি |
|
|
|
|
|
|