বৃষ্টিসুখের উল্লাসে
কাগজের নৌকা ভাসানোর নস্টালজিয়া। বৃষ্টিতে ভেজা রং মাখানো হ্যলোজেন আলো। বৃষ্টি যেন আমাদের চলাকে থামিয়ে দেয়। আমাদের ব্যস্ত জীবনে আকাশ কিংবা জলপিছল রাস্তা দেখতে শেখায়। ভাবছেন কী ভাবে জমবে এই বর্ষা আসর? ‘‘কলকাতাতে রেন পার্টির চল দিনদিন বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন কর্পোরেট কোম্পানি নিজেদের কর্মীদের কাজের চাপ থেকে হাল্কা করতে রেন পার্টির আয়োজন করার জন্যে আমাদের কাছে আসছেন। কেউ আবার বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা জমানোর জন্যেও রেন পার্টির ভাবনাটাকে বেছে নিচ্ছেন। নানা ধরনের ক্লায়েন্ট প্রকৃতির সঙ্গে নিজেদের মিশিয়ে দিতে এই রেন পার্টিকেই গুরুত্ব দিচ্ছেন,’’ জানালেন কলকাতার এক নামী ইভেন্ট কোম্পানির কর্ণধার অয়ন সান্যাল। কিন্তু সর্বদাই কি কোনও ইভেন্ট কোম্পানির মাধ্যমে রেন পার্টি করতে হবে? ‘‘বন্ধুরা মিলে আমাদের বাড়ির ছাদেই তো রেন পার্টি করি। আমার চিলেকোঠার ঘরটাই রেন পার্টির খাওয়া থেকে চেঞ্জিং রুম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। খুব একটা বড় কিছু আয়োজন করতে হয় না কিন্তু,’’ বললেন কলেজে সদ্য অধ্যাপনার কাজে যুক্ত হওয়া পলাশ্রী, ‘‘আমার জুলাই মাসে বিয়ে হয়েছিল। আমার ব্যাচেলর পার্টিতে আমরা রেন পার্টি করেছিলাম।’’ এইচ আর ম্যানেজার সৌপ্তিকের মতে বৃষ্টি সঙ্গে থাকলে যে কেউ, যে কোনও উৎসবেই এই পার্টি করতে পারেন।
নিজেদের মতো করে কম খরচে বর্ষামুখর মৌতাতে কেমন করে মন ভেজাবেন? কলকাতা শহরে গত দশ বছর ধরে রেন পার্টি পরিচালনা করে আসছেন নীত পল, তিনি বলছেন ‘‘রেন পার্টি কিন্তু বৃষ্টিপাগল মানুষের উৎসব। যে কেউ এটা করতে পারেন। কিন্তু কয়েকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে।” সেগুলো কী? জানাচ্ছেন তিনি।

পার্টির জন্য খোলা ছাদ বা মাঠ
পার্টির জন্যে প্রথমেই চাই একটা খোলা জায়গা। মাঠ হলে তো খুবই ভাল। বাড়ির ছাদ, হাউজিংয়ের লন, কমিউনিটির খোলা চত্বর বা যে কোনও খালি জায়গা। সেই জায়গাটাকে সাফ করে পার্টির জন্যে তৈরি করতে হবে। “অনেক ক্ষেত্রেই হোস পাইপ দিয়ে, কৃত্রিম উপায়ে রেন পার্টি করা হয়, যদি একান্তই বৃষ্টির দেখা না মেলে। কিন্তু যে ভাবেই হোক কম খরচেই এই পার্টির আয়োজন করা যায়।
বৃষ্টির আভাস পেলেই চটপট পার্টির জন্যে বন্ধুদের ডেকে তৈরি হতে হবে। তখন খুব বেশি সাজানো গোছানো ডেকরের দিকে মন গেলে চলবে না। উজ্জ্বল রঙের প্লাস্টিক চেয়ার, টেবিল, ছাতা, রেনকোট রেখে মেঘকালো আঁধারে বিজলিবাতির রঙিন আলোর ছটায় ভরিয়ে তুলতে হবে পার্টির জায়গা, যা দেখলেই মন ঝকঝকে হয়ে যাবে। মন থেকে বৃষ্টিবিষাদ মুছে ফেলাই রেন পার্টির প্রধান লক্ষ্য,” বলছেন মনোবিদ অয়ন্তিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। সবাই মিলে আনন্দ করার পাশাপাশি রেন পার্টিতে ভেজার, সতেজ হওয়ার স্নিগ্ধতা সহজেই পাওয়া যায় বলে এই রেন পার্টির চাহিদা বেড়ে চলেছে। টিপটাপ বৃষ্টি গায়ে গানের লড়াই বা মেমরি গেম খেলে দেখেছেন কখনও? “স্কুলের বন্ধু মিট-এ এ বার প্রথম আমরা রেন পার্টি করেছিলাম এক বন্ধুর বাড়ির লনে। পার্টি শুরুর প্রথম দিকে বৃষ্টির দেখা না পাওয়ায় হোস পাইপের সাহায্য নিতে হয়েছিল। পরে অবশ্য আপাদমস্তক ভিজে বৃষ্টিতে নেচেছিলাম খুব। সেদিন স্কুলের রেনিডে-র কথা মনে আসছিল বারবার,” উচ্ছ্বসিত সেক্টর ফাইভের কল সেন্টারের কর্মী সৃজিতা।

কম খরচার পার্টি ডেকর
বাড়িতে যা আছে তাই দিয়েই পার্টি সাজান। রেন পার্টির জন্যে কখনওই ব্র্যান্ডেড কিছু কেনার চেষ্টা করবেন না। রেন পার্টি নিয়ম ভাঙার, উন্মাদনার কথা বলে। সেটা খেয়াল রাখুন। বাড়িতে গাছের টব তো থাকেই। তাই দিয়ে চার দিকটা সাজিয়ে ফেলুন। “পার্টিতে তো বাচ্চারাও থাকে। সেই কথা মাথায় রেখে আমরা কিছু প্লাস্টিকের খেলনাও রাখি। বাচ্চারা চাইলে সেটা নিয়ে সময়ও কাটাতে পারে। আবার রেন ডেকর হিসেবেও এই রঙিন খেলনাগুলো খুব ভাল কাজ করে।” এ ভাবেই বাড়িতে রেন পার্টির সহজ ডেকরের ওপর গুরুত্ব দিলেন পার্টি আয়োজক নীত। বললেন, “বাড়িতে প্লাস্টিক প্লেটও থাকে। সেগুলোকেই সার্ভিং ডিশ হিসেবে ব্যবহার করুন। প্লেটের কমতি হলে বা বাসন মাজার হ্যাপা নিতে যদি না চান তবে সস্তায় ডিসপোজেবল প্লেট, গ্লাস পাওয়া যায়। সেগুলো কিনে নিন।”
নিশ্চয়ই ভাবছেন এ বার মেনুতে কী রাখলে একটা প্লেটের মধ্যেই তা হাতে হাতে ধরিয়ে দিতে পারবেন?

খানাপিনার লিস্টি
ইভেন্ট ম্যানেজারের মত হল— শুকনো খাবার রাখুন। তেলেভাজা তো থাকবেই, সঙ্গে কুরকুরে মুখরোচক খাবার দিন। বৃষ্টি পড়লেই এ সব দারুণ জমে। শুকনো খাবার হলে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে নাচতে নাচতেও খাওয়া যায়। আর যদি পেটপুরে ভোজনের বাসনা থাকে তা হলে খিচুড়ি আর মাছ ভাজা রাখুন। এক পাতেই তা ধরে যাবে। সে ক্ষেত্রে নাচের পরে এবং বিশ্রামের আগে এই খিচুড়ি বিলাসিতা করা ভাল। আর খরচ অনুযায়ী ইলিশ আহার, পার্টি প্ল্যানে রাখা যেতে পারে। নচেৎ অন্য কোনও ভাজা মাছ বা কেবল আলু ভাজা। কিন্তু প্লিজ পাত পেড়ে খাওয়ার চেষ্টা করবেন না। বৃষ্টি কিন্তু পালিয়ে যাবে। জলধারা স্নানে কি জলপানকে সরিয়ে রাখা যায়? তা বোধহয় যায় না। “রেন পার্টির ড্রিঙ্ক কাউন্টারে এমন ড্রিঙ্ক রাখা উচিত যা খানিকটা শরীর গরম করতে সাহায্য করবে,” জানাচ্ছেন অয়ন সান্যাল। সারা ক্ষণ ভেজার জন্যে উষ্ণতার এই আঁচটা খুব জরুরি। আদা, এলাচের চা, কফি তো রাখতেই হবে। তার সঙ্গে কিছু ভদকা বা রাম বা হুইস্কির রসালো মিশেল থাকাও দরকার বলে মনে করছেন অয়ন।

সিক্তবসন হবেন কী ভাবে
রেন পার্টির রং কী হবে? ডিজাইনার অগ্নিমিত্রা পল বলছেন “মেঘ আঁধারির ব্যাকড্রপে রেন পার্টির রং উজ্জ্বল নিয়ন ছাড়া আর অন্য কিছু হতে পারে না। মাথার ব্যান্ড থেকে পায়ের রাবার চটি সবেতেই যেন সেই রঙের ইশারা থাকে। র্যানডিজেন্ট লুকসের জন্যে মাথায় প্লাস্টিকের ফুলও গুঁজে দিতে পারেন।” রেন পার্টি যখন ড্রেস কোড তো থাকবেই। “মেয়েদের ক্ষেত্রে সারং, রিসর্ট ওয়্যার, সুইম ওয়্যার, হট প্যান্টস চলতে পারে। তবে দেখতে হবে সূতির কাপড় যেন ব্যবহার না করা হয়। ফ্লোরাল প্রিন্ট নিয়ন রং মজিয়ে দেবে আপনার বৃষ্টি ভেজা দিন। ছেলেদের ক্ষেত্রেও বারমুডা, শর্টস্, বাহারি রঙের টি-শার্ট চলতে পারে। বলা যায় না বৃষ্টি নিজেই হয়তো এগিয়ে আসবে আপনার কাছে।” নিজের মানিব্যাগ, মোবাইল, জল থেকে বাঁচানোর জন্যে প্লাস্টিক পাউচ সঙ্গে রাখুন। বাজারে এখন নানা রঙের মোটিফ আঁকা, স্মাইলির মুখ দেওয়া প্লাস্টিক পাউচ পাওয়া যাচ্ছে, রেন পার্টির থিমের সঙ্গে তা মানাবে চমৎকার।

জল বাঁচানো প্রসাধন
পোশাক বা অ্যাক্সেসরিজ তো হল। কিন্তু মেকআপ? “ফাউন্ডেশন, মাসকারা সব কিছুই হবে ওয়াটারপ্রুফ। ব্লাশ অন লাগালে ক্রিমি পিঙ্ক বা পিচের কোনও শেড লাগাতে হবে। কখনওই গ্লিটার, হাই মেকআপ ব্যবহার করা উচিত নয় কারণ ক্যাজুয়াল মুডই রেন পার্টির থিম,” বলছেন মেকআপ আর্টিস্ট অনিরুদ্ধ চাকলাদার। আর চোখের সাজ? “চোখে সব চেয়ে আগে ত্বকের রঙের শিমারি আইশ্যাডো ব্যবহার করুন। তার পরে কালো কাজলে চোখ ভরাট করে নিয়ন রং যেমন মিন্ট গ্রিন, ইলেকট্রিক ব্লু, গোলাপি রং সাহস অনুযায়ী মিশিয়ে দিন। এর পরে ওয়াটারপ্রুফ মাসকারা দিয়ে চোখ উজ্জ্বল করুন,” বলছেন অনিরুদ্ধ। তাঁর মতে ঠোঁটেও নিয়ন রং চলবে। ম্যাট লিপস্টিক ব্যবহার করুন, গ্লসি কখনও করবেন না। বৃষ্টির আশকারায় ঠোঁটের রং মুখে ছড়িয়ে যেতে পারে। আর চুল? অনিরুদ্ধ বলছেন,“ছোট বা মাঝারি চুল হলে খুলে রাখাই ভাল। কিন্তু যাঁদের লম্বা চুল তারা পনি করলে বা একধারে বিনুনি বাঁধলে পার্টি লুকটা অনায়াসেই ফুটে উঠবে, চুলের গুণগত মানও ঠিক থাকবে। পার্টিতে আসার সময় সঙ্গে রাখুন মেকআপ কিট, যাতে পার্টির পরে কাজল, লিপস্টিক, ট্রান্সলুসেন্ট পাউডার লাগিয়ে নিতে পারেন।”

ডিজে-র কেরামতি
বৃষ্টির ছন্দে এ বার গানের পালা। “রেন পার্টির জন্যে একজন সুররসিক ডিজে থাকা প্রয়োজন, যিনি মুড বুঝে সুর বাঁধবেন। বৃষ্টির শব্দকে গান যেন ছাপিয়ে না যায় সে দিকেও তাঁকে নজর দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে ওয়াটারপ্রুফ স্পিকার ব্যবহার করাই সব চেয়ে ভাল,” অয়নের সাবধানবাণী।
গানের মধ্যে বলিউডের সাবেকি অনুভূতির জন্যে হাল্কা চালে ‘রিমিঝিম গিরে শাওন’ দিয়ে শুরু করে নাচের ছন্দে বৃষ্টি মাখতে ‘চিকনি চামেলি’, ‘বলম পিচকারি’ দিয়ে সুর চড়িয়ে ফিউশনে মল্লার বা মেঘ-এর তারানা বাজালে মন্দ হবে না। “আরও ভাল হয় যদি নিজেরাই গেয়ে ওঠেন,” যোগ করলেন নীত।

সর্দিকাশি তফাত যাও
মেকআপ কিটের মতোই রেন পার্টির জন্যে জরুরি ফার্স্ট এড বক্স। জল থেকে হঠাৎ ঠান্ডা লাগা, অ্যালার্জির হাত থেকে বাঁচার জন্যে আগে থেকে বন্দোবস্ত করে রাখাই ভাল।
অসুখ বিসুখের ভয় ঝেড়ে ফেলতে পারলে, তবেই না রেন পার্টি! সর্দি কাশির ভয় থাকলে বৃষ্টিতে স্নান করার পর অবশ্যই কলের জলে স্নান করে নেবেন।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.