|
|
|
|
বলিউড এখন প্রাপ্তবয়স্ক
পদ্মশ্রী পাওয়া ক্রীড়াবিদের যৌন জীবন থেকে শুরু করে দেশের গুপ্তচরদের
না-বলা কাহিনি—
মেনস্ট্রিম বলিউডের লেন্সে আজকাল এ সবও ধরা পড়ছে। লিখছেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত |
ফারহান আখতার আর রেবেকা ব্রিডস্।
নাকি বলা উচিত মিলখা সিংহ আর স্টেলা?
রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরার ‘ভাগ মিলখা ভাগ’-এর মেলবোর্ন সিকোয়েন্স ভারতীয় চলচ্চিত্র ইতিহাসে এক নতুন দৃষ্টান্ত তৈরি করল। যে মিলখা কোনও দিন প্লেনেই চাপেননি, ইংরেজি ভাষায় (তাও আবার অস্ট্রেলিয়ান উচ্চারণে) দখল প্রায় নেই বললেই চলে— সেই মিলখা হঠাৎ এক অন্য পরিবেশে। পার্টি করছেন। বিয়ার খাচ্ছেন। প্রেম করছেন।
এটুকু পর্যন্ত তাও ঠিক ছিল।
কিন্তু হিন্দি ছবি। তাও আবার পদ্মশ্রী পাওয়া ক্রীড়াবিদ নিয়ে। সেখানে কিনা দেখানো হবে মিলখার প্রি-ম্যারিটাল সেক্স লাইফ? রুপোলি বিচে মিলখার গা বেয়ে বেয়ে উঠছেন স্টেলা। উষ্ণ চুম্বন। স্টেলার শরীরের ভাঁজে ভাঁজে যৌন আকর্ষণের নেশা।
শুধু কি তাই? মালগাড়ি থেকে মিলখার কয়লা চুরি করা পর্যন্ত দেখানো হয়েছে সিনেমাতে।
ব্যক্তিগত জীবনে এমন ঘটনা ঘটলেও সিনেমার পর্দায় এ সব তুলে ধরার নজির বলিউডে নেই।
কেন?
আসলে এ পথে হাঁটতে দেশের পরিচালকেরা যে অভ্যস্ত নন।
আমাদের দেশে বায়োপিক কম হয়নি। সেখানে মদ্যপ হিসেবে কাউকে দেখানো হলেও তাঁদের যৌন জীবন লেন্সের আড়ালেই থেকে যায়।
ও পথে হাঁটলেই যদি জনতা রে-রে করে তেড়ে আসে?
দেশের হিরো। তাঁরা তো ভারতীয় সিনেমার স্ক্রিনে সব সময় ‘অ্যাসেক্সুয়াল’। আমাদের আইকনরাও যে রক্তমাংসের মানুষ, তাঁদেরও যে প্যাশন থাকতে পারে, ভুল-ভ্রান্তি হতে পারে— এ সব বইয়ের পাতায় লেখা যায়। কিন্তু সিনেমার পরদায় তা ব্রাত্যই থেকেছে। কখনও সেন্সর বোর্ডের আটকে দেওয়ার ভয়। কখনও বা ফ্যানেদের সেন্টিমেন্টে আঘাত করার রিস্ক।
‘সেফ’ খেলে বক্স অফিস আর রক্ষণশীল সমাজের পাহারাদার— এই দুইকে যদি খুশি রাখা যায়, তা হলে ক্ষতি কীসের?
শুধু ‘ভাগ মিলখা ভাগ’ নয়। |
‘ভাগ মিলখা ভাগ’য়ে ফারহান আখতার এবং রেবেকা ব্রিডস |
সদ্য মুক্তি পেয়েছে নিখিল আডবাণীর ‘ডি-ডে’।
বলিউডে ‘র’-এজেন্ট বা আইএসআই-য়ের নাম নিয়ে আগেও সিনেমা হয়েছে। ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের ‘নিশ’ ছবি, ডকুড্রামা বা শর্টফিল্মের কথা হচ্ছে না এখানে। এমনকী ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’ বা ‘আ ওয়েডনেসডে’র ঘরানায় বানানো ছবিও নয়।
কথা হচ্ছে একেবারে হার্ডকোর বলিউড ছবির। ঠিক যেমনটা ছিল ‘এক থা টাইগার’। যেখানে ‘মাশাল্লাহ’ ‘মাশাল্লাহ’-র তালে তালে ‘র’ এজেন্ট ক্যাটরিনা আর সলমন বেলি ডান্স করেন। তবে বাস্তবের গুপ্তচরদের জীবনটা সে ছবিতে বলিউডের মোড়কের আড়ালেই হারিয়ে গিয়েছিল।
‘ডি-ডে’তে বেলি ডান্স নেই। এখানে বিয়েবাড়ির দৃশ্যে মিকা সিংহের ‘দমাদ্দম মস্ত কলন্দর’য়ের মতো গান আছে। অর্জুন রামপাল আর শ্রুতি হাসনের অন্তরঙ্গ দৃশ্য রয়েছে। আর যেটা রয়েছে তা হল বেশ কিছু বিতর্কিত তথ্য। গুপ্তচরদের বাস্তব জীবন থেকে ধার করে। ভারত-পাকিস্তানের দ্বন্দ্বে কী ভাবে এরা প্রতিনিয়ত ব্যবহৃত হয়ে থাকেন। কেন এই সব এজেন্টের কাজ ফুরিয়ে গেলে তাঁদের সঙ্গে কেউ সম্পর্ক রাখতে চায় না? এমনকী যে দেশ তাঁদের পাঠায়, সে দেশও চায় এঁদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হোক!
দাউদের নাম হয়তো উল্লেখ করা হয়নি ছবিতে। সিনেমাতে ঋষি কপূর অভিনীত এই ডনের নাম গোল্ডম্যান। যাঁর ছেলের বিয়ে হচ্ছে এক ক্রিকেটারের মেয়ের সঙ্গে (বাস্তব জীবনে দাউদের মেয়ে মারুখ ইব্রাহিমের সঙ্গে পাকিস্তানি ক্রিকেটার জাভেদ মিঁয়াদাদের ছেলে জুনেদ মিঁয়াদাদের বিয়ে হয়েছে)।
আর এই গোল্ডম্যানের মুখেই সিনেমার শেষে একটা লম্বা ডায়লগ। কেউ কেউ হয়তো এটাকে ‘অতিরঞ্জিত দেশাত্মবোধ’ বলেও মনে করতে পারেন। জনপ্রিয় টেলিভিশন চ্যানেলের অ্যাঙ্কররা (বরখা দত্ত, রাজদীপ সরদেশাই আর অর্ণব গোস্বামী) কী ভাবে খলনায়কদের গতিবিধি নিয়ে প্রাইম টাইমে কাটাছেঁড়া করেন, কেন আজমল কসাবকে দেরি করে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে— এ সব উঠে এসেছে সেই সংলাপে। আর ব্যঙ্গাত্মক ভাবে তুলে ধরা হয়েছে আর একটা ট্রেন্ডের কথা। ‘বিগ বস’য়ের বাড়িতে দেশের সব বিতর্কিত চরিত্রদের অবারিত দ্বার!
‘এসকেপিস্ট’ বলিউড এ ধরনের ছবি করে না। বাস্তব জীবনের চরিত্রদের নাম ব্যবহার করে বিতর্কিত প্রশ্ন করার রেওয়াজ প্রায় নেই বললেই চলে।
ছবিতে অতিনাটকীয় কিছু মুহূর্ত থাকলেও, নিখিলের সাহসের তারিফ করেছেন অনেকেই। মেনস্ট্রিম বলিউড ছবিতে এ সব বিষয় উঠে আসে না। যদি সেন্সর বোর্ডে এ নিয়ে সমস্যা হয়। ছবিতে দেখানো আইএসআই-য়ের কিছু বিতর্কিত গতিবিধি নিয়ে যদি পাকিস্তান থেকে প্রতিবাদ করা হয়? যদি সে ছবি পাকিস্তানে চলতে না দেওয়া হয়? যদি কেউ প্রশ্ন তোলে কী করে আমাদের দেশের সেন্সর বোর্ড এমন একটা সংলাপকে পাস করিয়ে দেয়, যেখানে সরকারের কসাব-নীতিকে নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে?
তা হলে কি মানতে হবে যে বলিউড আস্তে আস্তে পরিণত হচ্ছে? বিকিনির দড়ি বেয়ে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার একঘেয়ে রাস্তা ছেড়ে এখন কি অন্য রাস্তায় হাঁটছে বাণিজ্যিক হিন্দি ছবি? যেখানে এন্টারটেনমেন্টের খামতি নেই। কিন্তু তার পাশাপাশি আছে কিছু অস্বস্তিকর প্রশ্ন, যা দর্শককে হল ছেড়ে বেরিয়ে আসার পরেও ভাবতে বাধ্য করবে?
হলিউডের বায়োপিকগুলোতে কিন্তু আইকনদের দোষত্রুটি উঠে আসে। দেখানো হয় যে ‘হিরোজ অলসো হ্যাভ ফিট অব ক্লে’। এতে সেই কিংবদন্তি মানুষদের ইমেজের কোনও ক্ষতি হয় না। বরং সিনেমা দেখে আরও ভাল বোঝা যায় যে প্রতিকূলতাকে জয় করলেই তো হিরো হওয়া সম্ভব। |
‘ডি-ডে’তে ঋষি কপূর
|
‘‘আমার ছবিতে ঋষি কপূর কসাবকে নিয়ে যা বলেছেন, ট্রেনে, বাসে,
লোকে তা নিয়েই
আলোচনা করে।
তা হলে
সিনেমাতে এ সব থাকবে না কেন? সেন্সর বোর্ডকে
পুরো নম্বর
দেওয়া উচিত বলিউডে এ সব ব্যাপার দেখানোর ছাড়পত্র দেওয়ার জন্য’’ —নিখিল আডবাণী |
|
বলিউড যখন বদলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তখন কিছু পরিচালক মেনস্ট্রিম ফরম্যাটে অন্য রকম কাজ করতে চাইছেন। তাঁদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন কিছু সাহসী প্রযোজক। “আমার বোন আর ওর বেস্ট ফ্রেন্ড ‘ডি-ডে’র প্রযোজনা করেছে। স্ক্রিপ্টের যেখানে পাকিস্তানে বাচ্চাটিকে ও ভাবে বিষ দেওয়া হয়, তা নিয়ে কিন্তু কোনও আপত্তি করেনি। বা এটাও বলেনি যে ‘র’ এজেন্টদের মধ্যে কত রকমের রাজনীতি হয় সেটাও দেখানো উচিত হবে না,” বলছেন নিখিল। সিনেমাতে একটা সেকশনে দেখানো হয়েছিল কী ভাবে ‘র’ চিফের বাড়িতে ইচ্ছে করে ইনকাম ট্যাক্স রেড করানো হয়। মন্ত্রক তাঁর থেকে কোনও তথ্য পায়নি বলেই তাঁকে এই ঝামেলায় ফেলা হয়। ছবির দৈর্ঘ্যের কথা মাথায় রেখে এই সিনগুলো বাদ পড়েছে। তবে নিখিল সিনেমার ডিভিডি-তে এগুলো রাখবেন বলে জানান।
কসাব প্রসঙ্গ নিয়ে বিতর্কিত প্রশ্ন রাখায়ও সেন্সর বোর্ড নাকি কোনও ঝামেলাই করেনি। “আরে ট্রেনে, বাসে, লোকে তো এ সব নিয়েই আলোচনা করে। তা হলে সিনেমাতে এ সব থাকবে না কেন? সেন্সর বোর্ডকে পুরো নম্বর দেওয়া উচিত বলিউডে এ সব ব্যাপার দেখানোর ছাড়পত্র দেওয়ার জন্য,” নিখিল বলেন।
গত বছর মুক্তি পেয়েছিল ‘ওহ্ মাই গড’ বলে একটি ছবি। নিখিল আরও জানান, “আমাদের দেশে ধার্মিক গুরুদের নিয়ে প্রশ্ন করাই যায় না। ইটস আ হোলি কাউ। সেখানে মিঠুন চক্রবর্তী, অক্ষয়কুমারের মতো তারকাদের দিয়ে এ ধরনের মেনস্ট্রিম ছবি করা! সেটাও তো একটা পরিণত পদক্ষেপ।”
কিছু মাস আগে মুক্তি পেয়েছিল সঞ্জয় গুপ্তার ‘শু্যটআউট অ্যাট ওয়াডালা’। সিনেমায় সানি লিওনের উত্তেজক আইটেম নাম্বার থাকলেও ছবির মুখ্য চরিত্র ছিলেন মান্য সুরবে। অভিনয়ে জন আব্রাহাম। মুম্বই পুলিশের প্রথম রেজিস্টার্ড এনকাউন্টারে নিহত ডন ছিলেন মান্য।
চিত্রনাট্যকার রজত অরোরা (যিনি ‘দ্য ডার্টি পিকচার’ থেকে শুরু করে ‘ওয়ান্স আপন আ টাইম ইন মুম্বই’য়ের স্ক্রিপ্ট লিখেছেন) আশাবাদী। বলছেন, “‘ভাগ মিলখা ভাগ’য়ের ওই দৃশ্য নিশ্চয়ই বলিউডের বায়োপিকের তুলনায় বেশ বোল্ড। আশা করব এটা যেন পরিণত ছবি করার ক্ষেত্রে অন্যদের আরও সাহস দেয়,” রজত বলছেন।
সামনের অক্টোবর থেকে রজত লিখছেন মহম্মদ আজাহারউদ্দিনকে নিয়ে একটি বায়োপিক। প্রযোজক একতা কপূর। আশা করা যেতে পারে যে সেখানেও একতা-স্টাইল বলিউডি ছবির এক্তিয়ারের মধ্যেও হয়তো একটা পরিণত দৃষ্টিভঙ্গির ছাপ থাকবে। উঠে আসবে কিছু বিতর্কিত বিষয়ও। তা সে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের কলঙ্ক হোক বা সঙ্গীতা বিজলানির সঙ্গে প্রেম। ইমেজ গেল- গেল ভয়কে তুড়ি মেরে বাণিজ্যিক হিন্দি ছবির পরিণত কাহিনি শোনার জন্য দর্শক প্রস্তুত।
বদলে যাওয়া বলিউড শুনছে কি? |
|
|
|
|
|