|
|
|
|
দিনে ৪৮ ঘণ্টা হলে ভাল হত
সদ্য নোঙর ফেলা ‘শিপ অব থিসিয়াস’য়ের উপস্থাপক কিরণ রাও নিজেকে লাইটহাউজ বলে মনে করেন না।
তবু ইন্ডি ছবি প্রচারের দুনিয়ায় তিনিই ‘কিরণ’। আমির খান-এর সহধর্মিণীর সঙ্গে আড্ডায় প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত |
বলিউডের অন্যান্য ‘স্টার ওয়াইফ’দের থেকে তিনি একেবারেই আলাদা। যখন অন্য অনেকেই ইন্টিরিয়র ডিজাইনিং নিয়ে ব্যস্ত, আমির খান পত্নী কিরণ রাও একেবারেই স্বতন্ত্র। পরিচালনা করে ফেলেছেন ‘ধোবি ঘাট’। খসড়া করেছিলেন গওহর জানকে নিয়ে একটি বায়োপিকের স্ক্রিপ্ট। তবে তার আগে আবার অন্য এক পরিচালকের ফিল্মের উপস্থাপনার দায়িত্বে তিনি। ছবিটি আনন্দ গাঁধীর ‘শিপ অব থিসিয়াস’। তা দেখে এতই মুগ্ধ কিরণ যে, ছবিটির প্রচারে অসুস্থ ছেলেকে এক বেলার জন্য ন্যানির কাছে রেখে কলকাতায় এসেছিলেন।
স্টার পরিচালক স্বামীর সঙ্গে তাঁর কোনও প্রতিযোগিতা নেই। তবে বিয়ের প্রায় আট বছর পরেও তিনি এটা বলতে দ্বিধা করেন না যে, ছোটবেলায় মোটেই আমিরের ফ্যান ছিলেন না। কলকাতার লরেটো হাউজ-এ পড়তেন কিরণ। “মনে আছে কলকাতায় থাকাকালীন ভিডিয়ো ক্যাসেটে সিনেমা দেখতাম। ‘কেয়ামত সে কেয়ামত তক’ দেখেছি। জুহি চাওলার চরিত্রটা বেশ ভাল লেগেছিল। এমনকী সলমন খানের ‘ম্যায়নে পেয়ার কিয়া’ দেখেছিলাম বহু বার। তবে আমার বেডরুমের দেওয়ালে আমির-সলমনের পোস্টার লাগাতাম না!”
তাই বলে কি আর কোনও পোস্টারও ছিল না নাকি? আলবাত ছিল। ‘ডায়ার স্ট্রেইটস’ সিনেমার পোস্টার। আর টেনিস তারকা বরিস বেকারের ছবি। উনিই তো ছিলেন কিরণের ছোটবেলার ‘ক্রাশ’! যদিও আমির তা শুনে কী বলেছিলেন জানা নেই। তবে কিরণকে চিনলে এটা খুব একটা অস্বাভাবিক লাগে না।
কারণ? গ্ল্যামার জগতের মধ্যে থাকলেও, কিরণ এ সবের থেকে আলাদা। ডিজাইনার জামাকাপড় নিয়ে বাড়াবাড়ি নেই। চুল বেশ কোঁকড়া। মাথার পিছন দিকের চুল ছোট করে কাটা আর সামনের দিকটা একটু লম্বা। “প্লেনে ঘুমিয়ে আসতে গিয়ে চুলটা কেমন চেপে গিয়েছে,” বললেও ছবি তোলার আগে চুল সেট করে নেওয়ার কোনও তাগিদ নেই।
পার্ক স্ট্রিটের এক পাঁচতারা হোটেলের জানালার সামনে দাঁড়াতেই ছোটবেলার স্মৃতি ভেসে ওঠে। কিছু দিন ক্লাসিকাল গান শেখা। তার পর ছেড়ে দিয়ে ক্যালকাটা স্কুল অব মিউজিকে ভর্তি হওয়া। কিছু সময়ের জন্য ওড়িশি শেখা। টেনিস, হকি খেলা। এমনকী স্কুলের সাঁতার টিমের সদস্যও ছিলেন তিনি। আর সদ্য বন্ধ হয়ে যাওয়া মিউজিক ওয়ার্ল্ডে গান শোনা? “না, ওটা তখনও খোলেনি,” বলেই জানালা থেকে সরে গিয়ে সোজা খাটে বাবু হয়ে বসলেন কিরণ। স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস হত না যে সেলিব্রিটি জীবনের জৌলুসের আঁচ এত দিনেও তাঁকে স্পর্শ করেনি। একজন দেহরক্ষী বাদে আর কোনও ‘বাহুল্য’ নেই তাঁর জীবনে। |
কিরণ রাও এবং আনন্দ গাঁধী। ছবি: কৌশিক সরকার |
তারকার জীবনযাত্রা তাঁকে না পালটালেও, মাতৃত্ব তাঁকে পালটেছে। “আজাদের সবে দেড় বছর বয়েস। এখন মাম্মা-পাপা বলতে শিখেছে। ওর সব চেয়ে পছন্দ কী জানেন? ছাতা! সারা দিন একটা ছাতা খোলে আর বন্ধ করে। ওকে নিয়েই সারাটা দিন কেটে যায়। মনে হয় দিনটা চব্বিশ ঘণ্টার থেকে বেশি হলে মন্দ হত না,” বলেন কিরণ।
পুঁচকে আজাদের নামের শেষে ‘খান’ পদবির সঙ্গে কিরণ তাঁর ‘রাও’ পদবিটাও যোগ করেছেন। ছেলের নাম তাই আজাদ রাও খান। এখানেও তিনি অন্যান্য তারকা স্ত্রীদের থেকে আলাদা। “বুঝি না কেন ‘লিনিয়েজ’ আর ‘ফ্যামিলি লাইন’ শুধুমাত্র একজন পিতাই তাঁর সন্তানকে দিতে পারেন। মায়ের অবদানও কম নয়। পদবির আসল অর্থটা কী? ওটা তো এক ব্যক্তিকে সামাজিক ও আইনি পরিচয় দেয়। অনেকেই পদবি বাদ দিয়ে শুধু নিজের নামটাকেই ব্যবহার করেন। সেটা আমার মন্দ লাগে না। কিন্তু আইনের বেশ কিছু সমস্যা থাকার জন্য আমাদের দেশে হয়তো সেটা সব ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। তবে ভাবতে ভাল লাগে যে আমার নামের কিছুটা আজাদ বহন করছে!”
এই অন্য পথে চলার মানসিকতা নিয়ে আমিরের মতো সুপারস্টারের সহধর্মিণী হয়ে থাকতে অসুবিধা হয়নি? যেখানে ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মানুষের বিরামহীন কৌতূহল? স্বীকার করেন যে প্রথম প্রথম বেশ ঘাবড়ে যেতেন। তবে এখন অনেকটা ধাতস্থ। “তবে মিডিয়ার এই গ্ল্যামার নিয়ে উন্মাদনা হয়তো অনেকের কাছেই ক্লান্তিকর। অনেকেই আছেন যাঁরা কয়েক পাতা উলটে পালটে পড়েন। তার পর অন্য মিডিয়াম থেকে নিজেদের পছন্দের ইনফরমেশনটা খুঁজে নেন,” বললেন কিরণ।
নিজে খবরের কাগজ পড়েন? “হ্যাঁ, অনলাইন অনেক কিছু পড়ি। হেডলাইনগুলো দেখি রোজ সকালে। মিডিয়ার কাজ হল সব ধরনের জিনিসকে এনকারেজ করা। তবে অনেক সময় মিডিয়া একপেশে হয়ে যায়। শুধুমাত্র রেভেনিউ, রেভেনিউ, আর রেভেনিউ। কিন্তু তার জন্য মিডিয়াতে দেশের কালচারকে কোনও জায়গা দেওয়া হবে না? কেন ধরে নেওয়া হয় যে অন্য রকমের কিছু লিখলে সেটার কোনও পাঠক বা দর্শক থাকবে না?”
আর এটা ভেবেই হয়তো তিনি আনন্দের পাশে আজ দাঁড়িয়ে। হিন্দি সিরিয়াল লিখিয়ে আজ ভারতের অন্যতম চর্চিত ছবি পরিচালক। বানিয়েছেন এমন একটা ছবি যাতে এক অসুস্থ সন্ন্যাসীর চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে নীরজ কবিকে ১৭ কেজি ওজন কমাতে হয়। যার আরও এক অভিনেত্রী মিশরের আইদা ‘এল কাসেফ’ ছবির প্রচারে এ দেশে আসতে পারেননি কারণ তিনি এ মুহূর্তে নিজের দেশের এক বৈপ্লবিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত।
আর আনন্দ? আমির-কিরণকে পাশে পেয়েও তিনি অবলীলাক্রমে বলতে পারেন যে! ‘থ্রি ইডিয়টস’ দেখেননি। বিষয়টা মনে করিয়ে দেওয়াতে কিরণের মুখে একগাল হাসি। “আনন্দের সঙ্গে মিশে বুঝেছি যে, ও ওই রকমই। ব্রাইট। বুদ্ধিদীপ্ত প্রশ্ন করে! মাথায় আইডিয়া গিজগিজ করছে। দর্শন থেকে সংস্কৃতি— সব নিয়েই আলোচনা করতে পারি,” বলেন কিরণ।
এ দিকে আমির নিজেও আনন্দের ছবি দেখে মুগ্ধ। বলেছেন, “‘শিপ অব থিসিয়াস’ ইজ আ জেম অব আ ফিল্ম, ওয়ান অব দ্য ফাইনেস্ট আই হ্যাভ সিন কাম আউট অব ইন্ডিয়ান সিনেমা... দ্য ডিরেক্টর ইজ ফুললি ইন কম্যান্ড অব দিজ শিপ!” আরও বলেছেন যে, ছবিটা দৃশ্যত বাকরুদ্ধ করে দেওয়ার মতো, তুখড় অভিনয়, অসাধারণ সঙ্গীত আর সাউন্ড ডিজাইন সমৃদ্ধ। |
নির্মল আনন্দ |
যদি ভাবেন ‘শিপ অব থিসিয়াস’ একটা খুব সিরিয়াস ছবি,
তা হলে ছবির এই সংলাপগুলো পড়ে দেখুন:
|
• চার্বাক: হোয়াট কাইন্ড অব অ্যান ই-মেল অ্যাটেনস্ সাইবার এনলাইটেনমেন্ট?
মৈত্রেয়ী: হোয়াট কাইন্ড?
চার্বাক: দ্য ওয়ান, দ্যাট কামস উইথ নো অ্যাটাচমেন্টস।
• চার্বাক: আই অলওয়েজ নিউ সাধু ছুপ কর পিতে হ্যায়। বাট লিভার সিরোসিস ইজ গোয়িং টু গিভ ইউ অ্যাওয়ে। |
|
তবে দেশে তো আনন্দের মতো আরও অনেক প্রতিভাবান পরিচালক আছেন যাঁরা অন্য ধরনের সিনেমা করতে চাইছেন। গ্ল্যামার দুনিয়ার চাপে কি তাঁরা হারিয়ে যাবেন? “একটা সময় কলকাতাতে অন্য ধরনের ছবি দেখানোর একটা চল ছিল। ব্লকবাস্টার ছবি দেখাতে হবে বলে তো নন্দন তৈরি হয়নি। আমাদের দেশে স্পেশ্যালিটি সিনেমা হলের খুব দরকার। আর প্রয়োজন ‘আর্ট হাউস চেনস্’,” বলেন তিনি।
আর চলচ্চিত্র উৎসবগুলো? “এক সময় ওগুলোই অন্য ধরনের ছবিকে সাহায্য করত। দর্শকের রুচি তৈরি করত। হয়তো টরেন্ট ডাউনলোডের জেরে ফেস্টিভ্যালগুলোর প্রয়োজনীয়তা কমে গিয়েছে। তবু ফিল্ম ক্লাবগুলো মরে যাবে না। আজকের দিনে ইনডিপেন্ডেন্ট সিনেমা তৈরির জন্য প্রয়োজন ‘লিগাল অনলাইন ডিস্ট্রিবিউশন’। দরকার এমন একটা পরিবেশের যেখানে দর্শক তাঁর ইচ্ছেমতো সিনেমা দেখার সুযোগটা পাবে। ব্লকবাস্টার ছবির নিশ্চয়ই প্রয়োজনীয়তাটা রয়েছে। ছবি হিট করলে ইন্ডাস্ট্রির ভাল। কিন্তু তার মানে এটা নয় যে, ওই ছবিগুলোর জন্য অন্য সব বিসর্জন দিতে হবে।”
নিজের কলকাতা-ভিত্তিক ছবির কী হল? “ভেবেছিলাম গওহর জানকে (১৮৭৩-১৯৩০) নিয়ে বায়োপিক বানাব। গওহরের সময়টা আমার রোমাঞ্চকর লাগত। ভাবিনি কী ভাষায় বানাব। গওহর কী ভাষায় কথা বলতেন? ওঁর বাবা তো ছিলেন আর্মেনিয়ান। ওঁর জন্ম হয়েছিল আজমগড়ে।”
জানেন কি কলকাতাতে গওহরকে নিয়ে বাংলা নাটক হয়েছে? “এক সময় নাটকের পোকা ছিলাম। ওয়ার্ডেন আর দারোয়ানকে ম্যানেজ করে বিনা পয়সায় নাটক দেখতাম। না, গওহরকে নিয়ে নাটক হয়েছে জানতাম না,” বলেন তিনি। আর এটা কি শুনেছেন যে, টালিগঞ্জেও ইতিমধ্যে গওহরকে নিয়ে একটা ছবি বানানোর কথা চলছে? “তাই নাকি? তবে এতে কিছু এসে যাবে না। বিভিন্ন মানুষ তো বিভিন্ন ভাবে বায়োপিক বানাবেন। তাই অন্য কেউ কিছু বানালে আমি সেটা বরং দেখতেই চাইব,” পরিষ্কার জানান তিনি।
কথা বলতে বলতে সকাল গড়িয়ে দুপুর। সাক্ষাৎকারের ইতি টানার আগে বললেন, “ইচ্ছে আছে পুজোর সময় একবার আজাদকে নিয়ে কলকাতায় আসার। আর একটু বড় হলে কলকাতার খাবারগুলো আজাদকে টেস্ট করাব।” পুনশ্চ: শুক্রবার ‘শিপ অব থিসিয়াস’ মুক্তি পাওয়ার পরে কিরণ আর আনন্দ দেখতে গিয়েছিলেন মুম্বইয়ের থিয়েটারে। স্ক্রিনিংয়ে ‘মুন্নাভাই’য়ের পরিচালক রাজকুমার হিরানি বলেছেন, “এখন মনে হয় যে ধরনের ছবি আমরা বানাচ্ছি, সেগুলো এর তুলনায় কতটা ক্ষুদ্র!” এ রকম ভূয়সী প্রশংসা শুনে আনন্দ মিটি মিটি হাসেন। আর কিরণ? কয়েক মাস হল ছবিটিকে মাতৃস্নেহে লালন করেছেন যিনি? অনেকটা হয়তো এক ‘সারোগেট’ মায়ের মতো? যদিও আনন্দের এই মেটাফরটি পছন্দ নয়, তবে তিনিও কিরণের অবদানে আপ্লুত। বলছেন, “কিরণ সত্যিকারের আমার ছবির পার্টনার। দু’টো ফোন করেই দায়িত্ব শেষ করেননি তিনি। সব রকমের সাহায্য করেছেন। আর ছবির এই প্রতিক্রিয়া দেখে আমাকে বলেছেন ‘এমনটা তো হওয়ারই ছিল!’”
প্রথমেই বলেছিলাম না, কিরণ অন্যান্য ‘স্টার ওয়াইফ’দের থেকে আলাদা? |
|
|
|
|
|