মেয়ের নাম রেখেছি অনন্যচেতা।
শুধুই অনন্যচেতা। পদবি বর্জিত।
পদবিতে লেগে থাকে ধর্মের অনুষঙ্গ। তাই মেয়ের নামের শেষে কোনও পদবি ঝুলে থাকুক, পছন্দ নয় আমাদের। ওর জন্ম-শংসাপত্রেও লেখা, ‘অনন্যচেতা’। আমরা বিশ্বাস করি, ধর্মের উর্ধ্বে উঠতে পেরেছি বলেই ভিন্ ধর্মের হয়েও সামাজিক বন্ধনে বাঁধা পড়েছি। পারিবারিক যে পরিমণ্ডলে আমরা বড় হয়েছি, সেখানে ধর্মের স্থান ছিল না। আমাদের শিক্ষা-রুচি-সংস্কৃতিতে ধর্ম থাবা বসাতে পারেনি। কিন্তু আমাদের জীবনচর্যার বাইরেও রয়েছে একটা জীবন। সেই জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখলাম মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করতে গিয়ে! মেয়ের নামের শেষে পদবি না থাকায় বহু অপ্রিয় প্রশ্নের মুখে পড়তে হয়েছে আমাদের। ভর্তির ফর্মে ধর্ম উল্লেখের জায়গায় ‘মনুষ্যত্ব’ লেখা নিয়েও শুনতে হয়েছে হাজারও প্রশ্ন।
অনন্যচেতা ওরফে পেখমের জন্ম ও বেড়ে ওঠা মালদহে। ওর বয়স এখন ৪ বছর ১১ মাস। ওকে নার্সারিতে ভর্তির জন্য আমরা কলকাতার নামী কয়েকটি স্কুলে ফর্ম জমা দিই। স্কুল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ডাকও আসে। সেখানে গিয়েই শুনতে হয় প্রশ্নবাণ
১) মেয়ের নামের শেষে পদবি লেখেন না কেন?,
২) ধর্মের জায়গায় কেন মনুষ্যত্ব লিখেছেন?
কলকাতার একটি নামী স্কুলের বাড়তি সংযোজন
১) মৃত্যুর পরে কোন মতে মৃতদেহের সৎকার হবে?,
২) আপনাদের কোন মতে বিয়ে হয়েছিল?
আমাদের জবাব ছিল, “পদবিতে ধর্মের অনুষঙ্গ থাকে। তাই পদবি বর্জিত রাখাটাই শ্রেয় মনে করেছি।” আমরা আরও জানাই, মৃত্যুর পরে দেহদানের অঙ্গীকার করেছি। আর আমাদের বিয়ে হয়েছিল ‘বিশেষ বিবাহ’ আইনে। পদবি বর্জিত নাম নিয়ে মেয়ে প্রশ্ন করলে বলি, “পদবি বহন করার ক্ষেত্রে আমরা তোমাকে স্বাধীনতা দিয়েছে। আমাদের এই সুযোগ ছিল না। আমাদের উপরে পদবি চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল।” |
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো জায়গায় এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া অনভিপ্রেত। তবু তার আগাম মানসিক প্রস্তুতি আমাদের ছিলই। তাই প্রশ্নগুলি আমাদের মনে কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি। শুধু ভাবনা ছিল, মেয়ের ভর্তির ক্ষেত্রে বিষয়টি প্রভাব ফেলবে কিনা। শেষমেশ কলকাতার নামী স্কুলগুলির একটিতেও সুযোগ পায়নি অনন্যচেতা। ওকে ভর্তি করেছি কসবা এলাকার একটি কিন্ডার গার্টেনে। কোনও স্কুল কর্তৃপক্ষই আমাদের বলেননি, পদবিহীন বা ধর্মহীন কোনও ছাত্রীকে ভর্তির ক্ষেত্রে অসুবিধে রয়েছে। তবে আমাদের ধারণা, পদবিহীন নাম আর ফর্মে নির্দিষ্ট ধর্মের উল্লেখ না থাকাতেই মেয়ে ওই স্কুলগুলিতে ভর্তি হতে পারেনি। ধরাবাঁধা প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর না পেয়েই স্কুল কর্তৃপক্ষ ওর নাম তালিকা থেকে বাদ দিয়েছেন। আর এই বিষয়টাই মন থেকে মেনে নিতে পারছি না।
আমি, শওকত কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী। বাড়িভাড়া দিয়ে, সংসার খরচ চালিয়ে যে সব স্কুলের খরচ চালাতে পারব, সেখান থেকেই মেয়ের জন্য ফর্ম তুলে জমা দিয়েছিলাম। সঙ্গে আয়ের শংসাপত্রও জমা দিতে হয়েছিল। যখন দেখি, আমাদের মতো পরিবারের সন্তানরা স্কুলে ভর্তি হতে পারল, আর আমার মেয়ে পারল না, তখন সব ভাবনা এলোমেলো হয়ে যায়!
খুব কাছের মানুষজন আপস করার পরামর্শ দিচ্ছেন। তাঁদের অনেকে পদবি ব্যবহার ও ধর্ম উল্লেখের কথাও বলে। আড়ালে আমাদের ‘আঁতেল’ বলেও বিদ্রুপ করা হয়। বাঁধা গতের বাইরে ভাবতে পারেন না বলেই হয়তো ওঁরা ওই মন্তব্য করেন। হয়তো মেয়ের ভাল চান বলেই পরামর্শ দেন, “তোরা যা বিশ্বাস করিস ঠিক আছে। কিন্তু পদবি আর ধর্ম উল্লেখ করলে যদি মেয়ে স্কুলে ভর্তি হয়, তাহলে আপত্তি কোথায়?” আমরা কিন্তু এই যুক্তি মন থেকে মানতে পারি না।
খুব কাছের মানুষের কাছ থেকে ওই সব কথা শুনে কখনও কখনও ভীষণ একা লাগে। মনে হয়কেউ কোত্থাও নেই। লড়াইটা একান্তই আমাদের ‘একার লড়াই’। বন্ধু যে একমদমই পাইনি, তা নয়। তবে আমাদের সিদ্ধান্তের সঙ্গে যাঁরা সহমত পোষণ করেন, তাঁদের সংখ্যা নেহাতই নগণ্য। হাতে গোনা ওই কয়েক জনের দিকে তাকিয়ে অবশ্য ভরসা পাই। সিদ্ধান্ত নিয়েছি, আমরা কোনও আপস করব না। এত সহজে যদি কুঁকড়ে যাই, তাহলে তো লড়াই থেকে সরে যেতে হয়! হাল ছাড়তে চাই না। দেখি না শেষ পর্যন্ত কী হয়! |