জয়নগরের বাপুলির চক স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা জং ধরা নলকূপটার গায়ে শনিবারও লেগে ছিল রক্তের দাগ। শুক্রবার এখানেই কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে লুটিয়ে পড়েছিল বছর বত্রিশের অমল হালদার। যে গ্রামের ঘটনা, সেখানকার মানুষের অভিযোগ, ধীরে ভোট পড়া নিয়ে গোলমালের জেরে পুলিশ লাঠি চালাতেই সকলে এলোপাথাড়ি পালাতে শুরু করে। অমলও ছিলেন সেই দলে। তখনই এক জওয়ানের রাইফেলের গুলি এসে বেঁধে ওই যুবকের মাথায়। কিছু ক্ষণের মধ্যেই মৃত্যু হয় অমলের।
যে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে অমলের মৃত্যু হয় বলে অভিযোগ, সেই কেন্দ্রীয় শিল্প রক্ষী বাহিনীর (সিআইএসএফ) প্রাথমিক রিপোর্টে অবশ্য গোটা ঘটনার দায় গ্রামবাসীদের উপরেই চাপানো হয়েছে। তাদের পাঠানো যে রিপোর্ট শনিবার মহাকরণে পৌঁছেছে, তাতে বলা হয়েছে, স্থানীয় পুলিশের ডাক পেয়ে সিআইএসএফ জওয়ানদের ছ’জনের একটি দল স্কুলের সামনে গেলে উত্তেজিত জনতা তাদের গাড়ি ঘিরে ধরে। জওয়ানেরা তাদের সরে যেতে বললেও জনতা উল্টে লাঠিসোটা নিয়ে বাহিনীর উপরে চড়াও হয়। এর পরেও জওয়ানরা সংযতই ছিলেন। রিপোর্টে বলা হয়েছে, আচমকাই জনতার মধ্যে থেকে এক জন বাহিনীর এক সদস্যের অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। তখনই জনতাকে ছত্রভঙ্গ করতে শূন্যে তিন রাউন্ড গুলি চালায় সিআইএসএফ। তাতেও পরিস্থিতি শান্ত না হওয়ায় আরও এক রাউন্ড গুলি চালানো হয় বলে দাবি করা হয়েছে রিপোর্টে। রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “তাদের বিস্তারিত তদন্ত করতে বলেছি। ইতিমধ্যে ময়না তদন্তের রিপোর্টও পেয়ে যাব।”
সিআইএসএফের বিস্তারিত রিপোর্ট পাওয়ার আগেই অবশ্য ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের তদন্ত শুরু করেছে রাজ্য সরকার। দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলাশাসক নারায়ণস্বরূপ নিগম এ দিন বলেন, “মনে হয়, জনতা জওয়ানদের গাড়ি ঘিরে ফেলায় তারা ভয় পেয়ে যায়। সেই কারণে কারও অনুমতি ছাড়াই গুলি চালিয়ে দেয় তারা।” নিগম জানান, তদন্তে সব দিকই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। জেলা পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, ঘটনার পরে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ওই জওয়ানরাও কবুল করেছেন যে, আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাতেই তাঁরা গুলি চালিয়েছেন।
ঠিক কী ঘটেছিল শুক্রবার? |
জয়নগর-২ ব্লকের মায়াহাউড়ি পঞ্চায়েতের বাপুলির চক স্কুলে যাঁদের ভোট পড়েছিল, সেই ভোটারদের একাংশ বলেছেন, সকাল থেকেই খুব ধীর গতিতে ভোট হচ্ছিল। ভোটকর্মী বাড়ানোর জন্য প্রিসাইডিং অফিসারকে বারবার বলেও কোনও সুরাহা মেলেনি। তাঁদের হিসেবে, ওই বুথে (নম্বর ১৭২) ১১৩৮ জন ভোটার। রাত ৭টা পর্যন্ত ভোট পড়েছিল ৫০০-এর কাছাকাছি। এলাকাবাসীর একাংশের অভিযোগ, বহু মহিলা কোলের ছেলেকে নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। ছিলেন অনেক বয়স্ক মানুষও। রাত বাড়তে দেখে ভোটারদের কয়েক জন প্রিসাইডিং অফিসারের সঙ্গে কথা বলতে গেলে দু’পক্ষের বচসা বাধে। তার জের ছড়িয়ে পড়ে ভোটকেন্দ্রের বাইরেও। এক পুলিশকর্তা বলেন, “তখনকার মতো লাঠি চালিয়ে উত্তেজিত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হলেও অল্প সময়ের তারা ফিরে আসে। এ বার আরও লোক নিয়ে।”
সেই উত্তেজনার মধ্যেই ফের ভোটগ্রহণ শুরু হয়। এর মধ্যেই সেখানে পৌঁছয় সিআইএসএফের ছ’জনের একটি দল। পুলিশ জানায়, তাদের দেখেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে জনতা। কেন্দ্রীয় বাহিনীর গাড়ি ঘিরে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করে। পুলিশের দাবি, হইচইয়ের মধ্যে কয়েক জন সিআইএসএফের গাড়ির সামনের কাচ ভেঙে দেয়। গ্রামবাসীরা অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁদের দাবি, গাড়ি থেকেই আচমকা তিন-চার রাউন্ড গুলি চালান এক জওয়ান। ভোটের লাইনে শেষের দিকে দাঁড়িয়েছিলেন ঘোষালের চক গ্রামের অমল হালদার। একটি গুলি তাঁরা মাথা ফুঁড়ে বেরিয়ে যায়। গুলির শব্দে আতঙ্কিত ভোটারদের কেউ পুকুরে, কেউ বা ঝোপঝাড়ে লাফ দিয়ে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করেন। হুড়োহুড়িতে কয়েক জন জখমও হন। সেই সুযোগে সিআইএফএফ জওয়ানরা ফিরে যায়। এই পরিস্থিতিতে ভোটগ্রহণ স্থগিত হয়ে যায়। মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা অমলকে গ্রামবাসীরাই হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানেই চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন তাঁকে।
বাপুলির চক বুথ থেকে ঘোষালের চক দেড় কিলোমিটার। অমলের বাড়ি সেখানেই। মাস চারেক আগে বিয়ে হয়েছিল তাঁর। বাতাসা তৈরি করে সংসার চালাতেন। তাঁর স্ত্রী টুম্পা এ দিন কথা বলার অবস্থায় ছিলেন না। অমলের মা একাদশীদেবী বলেন, “আমরা বহু দিনের এসইউসি সমর্থক। ভোট দেবে বলে ছেলেটা শুক্রবার সকাল থেকেই চেষ্টা করছিল। লাইন এগোচ্ছিল না বলে কয়েক বারই বুথ থেকে ঘুরে এসেছিল। সন্ধ্যায় গিয়ে আর ফিরল না। ”
এসইউসির অভিযোগ, বিনা প্ররোচনাতেই কেন্দ্রীয় বাহিনী গুলি চালিয়েছে। রিগিংয়ের জন্য সময় বেশি লাগছে কি না, সে কথা জানতে চান বিরক্ত ভোটারদের একাংশ। শোরগোল শুনে গুলি চালানো হয়। দলের রাজ্য সম্পাদক সৌমেন বসুর অভিযোগ, ভোটের লাইনে এমন গোলমাল হয়নি যে গুলি চালানো জরুরি ছিল। তাঁর প্রশ্ন, যদি গুলি চালাতেই হয়, কেন তা হাঁটুর নিচে করা হল না? গুলি চালনার বিচারবিভাগীয় তদন্ত ও নিহতের পরিবারের এক জনকে চাকরির দাবি করেছেন তিনি। গুলি চালনার জন্য প্রকারান্তরে রাজ্য প্রশাসনকেই দায়ী করেছেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য। তাঁর বক্তব্য, কারা ভোটার, কারা নন, তা কেন্দ্রীয় বাহিনীকে চেনানোর দায়িত্ব রাজ্য প্রশাসনের। প্রদীপবাবুর কথায়, “বাহিনীকে ঠিক ভাবে পরিচালনা করলে এই দুঃখজনক ঘটনা ঘটত না।” তৃণমূল অবশ্য এই ঘটনা নিয়ে নীরবই থেকেছে।
|