বিদ্যুৎ বিক্রির টাকা বাজারে পড়ে রয়েছে। যে কোনও উপায়ে তা তুলে আনতে হবে। রাজ্য বিদ্যুৎ বণ্টন সংস্থার আঞ্চলিক ম্যানেজারদের কাছে এই নির্দেশ পাঠিয়েছেন বিদ্যুৎ-কর্তারা।
কেন এই নির্দেশ?
বণ্টন সংস্থা সূত্রে খবর, বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে গিয়ে এখন প্রযুক্তিগত এবং বাণিজ্যিক ক্ষতি (এগ্রিগেট টেকনিক্যাল অ্যান্ড কমার্শিয়াল লস বা এটিসি লস)-র গড় হার প্রায় ৩২ শতাংশে পৌঁছেছে। বছর দু’য়েক আগে যা ২৭ শতাংশেরও কম ছিল। রাজ্যের কিছু প্রত্যন্ত এলাকায় আবার ক্ষতির পরিমাণ ৬০ শতাংশে ঠেকেছে। হিসেব করে দেখা গিয়েছে, এই ভাবে চলতে থাকলে চলতি আর্থিক বছরেই সংস্থার রাজস্ব ঘাটতি হতে পারে প্রায় ২৫০০ কোটি টাকা। এবং এমনটা হলে দৈনন্দিন কাজ চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় কার্যকরী মূলধনেও টান পড়বে। বণ্টন সংস্থার ইতিহাসে এমন নজিরবিহীন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় রাজ্য বিদ্যুৎ দফতরের কর্তারা বুঝতে পারছেন, এখনই কড়া হাতে রাশ না টানলে সব নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। তাই সংস্থার আর্থিক স্বাস্থ্য ফেরাতে মরিয়া বিদ্যুৎ-কর্তারা ওই নির্দেশ পাঠিয়েছেন। আয় বাড়াতে সংস্থার প্রতিটি আঞ্চলিক অফিসকে বিল আদায়ের মাসিক লক্ষ্যমাত্রাও বেঁধে দেওয়া হয়েছে।
বিদ্যুৎ বিক্রি হলেও কী ভাবে টাকা আদায় হচ্ছে না, বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে গিয়ে প্রযুক্তিগত ও বাণিজ্যিক ক্ষতির পরিমাণই বা কত সম্প্রতি আনন্দবাজারে সেই খবর প্রকাশিত হওয়ার পরেই নড়েচড়ে বসেছেন কর্তারা। মহাকরণের খবর, পরিস্থিতি সামাল দিতে বণ্টন সংস্থার পদস্থ কর্তাদের নিয়ে বিদ্যুৎ ভবনে বৈঠক করেন রাজ্যের বিদ্যুৎসচিব মলয় দে। ওই বৈঠকেই যে কোনও উপায়ে ‘এটিসি লস’ কমিয়ে রাজস্ব আদায় বাড়াতে বলা হয়। পাশাপাশি, বিল মেটাচ্ছেন না এমন গ্রাহকদের সংযোগ কাটারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বণ্টন সংস্থার চেয়ারম্যান রাজেশ পাণ্ডে বিজ্ঞপ্তি জারি করে পদস্থ কর্তাদের জানিয়েছেন, আয় বাড়াতে না পারলে সংস্থা চালানোর জন্য বাজার থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে হবে। বিদ্যুৎ মাসুলের মাধ্যমে সেই ঋণের বোঝা গিয়ে শেষ পর্যন্ত চাপবে গ্রাহকদের উপরেই।
নতুন নির্দেশের সঙ্গে বণ্টন সংস্থার কিছু কর্তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিয়েও সরগরম হয়ে উঠেছে বিদ্যুৎ দফতর। একাংশের মতে, বণ্টন সংস্থার কর্তারা ঢিলেঢালা মনোভাব নিয়ে চলছেন, যোগ্য কর্মীদের আমল দিচ্ছেন না। উল্টে যাঁদের পদোন্নতি হওয়ার কথা নয়, তাঁদের উঁচু পদে বসিয়ে বেতনও বাড়িয়ে দিচ্ছেন। তাঁদের আরও অভিযোগ, কাজে গাফিলতি দেখলেও কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কর্তৃপক্ষ। কোনও গ্রাহক বিদ্যুৎ বিল না মেটালেও লাইন কাটা হচ্ছে না। দক্ষতার সঙ্গে সংস্থা পরিচালনার কাজে যে শৃঙ্খলা ও নজরদারির প্রয়োজন, অনেক ক্ষেত্রেই তা দেখা যাচ্ছে না।
আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ আপস করে চলতে গিয়ে সংস্থার ক্ষতি করছেন। আর এ সবেরই খেসারত দিতে হচ্ছে বণ্টন সংস্থাকে। এক দিকে লোকসানের বহর বাড়ছে, অন্য দিকে কাজ জানা পদস্থ কর্তারা অনেকে চাকরি ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। বিদ্যুৎ দফতর অথবা বণ্টন সংস্থার কর্তারা অবশ্য এই নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলতে নারাজ। মহাকরণ সূত্রের খবর, হাল ফেরাতে বণ্টন সংস্থার ওপরমহলে বেশ কিছু রদবদলের কথা ভাবছে সরকার।
রাজ্য অর্থ দফতরের কর্তারা জানিয়েছেন, ইলেকট্রিসিটি ডিউটি বাবদ প্রতি মাসে সরকারের প্রাপ্য হয় ৬৫-৭০ কোটি টাকা। বণ্টন সংস্থার আর্থিক স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ায় গত কয়েক মাস ধরে তা পাওয়া যাচ্ছে না। রাজ্যের অর্থসচিব হরিকৃষ্ণ দ্বিবেদী এই পাওনা নিয়ে বিদ্যুৎ দফতরের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাঁকে বিদ্যুৎ দফতরের কর্তারা বলেছেন, বণ্টন সংস্থার ঘরে টাকা নেই। তাই ইলেকট্রিসিটি ডিউটি এখনই দেওয়া যাচ্ছে না। যদিও উল্টো দিকে রাজ্যের কাছ থেকে বিদ্যুৎ বিল বাবদ কয়েক’শো কোটি টাকা পাওনা হয়েছে বণ্টন সংস্থার। কিন্তু সে টাকা কবে পাওয়া যাবে, জানা নেই সংস্থা-কর্তাদের।
এই বিষয়ে বিদ্যুৎ মন্ত্রী মণীশ গুপ্তর বক্তব্য জানার জন্য তাঁর সঙ্গে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা হয়। তিনি সাড়া দেননি। এই নিয়ে কোনও মন্তব্য করবেন না বলে জানিয়ে দেন বিদ্যুৎ সচিব। বন্টন সংস্থার চেয়ারম্যানও কথা বলতে নারাজ। তবে তৃণমূল সমর্থিত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ পর্ষদ কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক অরিজিৎ দত্ত বলেন, “রাজস্ব ঘাটতি নিয়ে কর্তৃপক্ষের মতো আমরাও চিন্তিত। তাই নিজেদের উদ্যোগেই আমরা রাজ্যের ৪৭০টি গ্রাহক পরিষেবা কেন্দ্রে একটি করে ‘টেকনিক্যাল কমিটি’ ও ‘রেভিনিউ কমিটি’ গঠন করেছি।”
অরিজিৎবাবুর দাবি, ওই দুই কমিটি ক্ষতি কমানো ও আয় বাড়ানো নিয়ে প্রতি মাসে ইউনিয়নের কাছে রিপোর্ট দেবে। সেই রিপোর্ট তুলে দেওয়া হবে বণ্টন কর্তৃপক্ষের হাতে। সিটু সমর্থিত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুৎ কর্মচারী ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক দীপক রায়চৌধুরী বলেন, “রাজস্ব আদায় বাড়াতে আমরা সব রকম সাহায্য করতে প্রস্তুত। তবে বর্তমান কর্তৃপক্ষের বদলি নীতি ও গা-ছাড়া মনোভাবের জন্য ক্ষতি বাড়ছে।” |