ভোটের আগে সংঘর্ষ তো ছিলই। রইলও। সঙ্গে যোগ হল ভোট-পরবর্তী হিংসাও।
প্রথম দফার ভোটে জঙ্গলমহল মোটের উপর শান্ত থাকায় স্বস্তির শ্বাস ফেলেছিলেন অনেকেই। সেই স্বস্তি উধাও হয়ে যায় দ্বিতীয় দফায় তিন জন আর শুক্রবার তৃতীয় দফায় পাঁচ জনের মৃত্যুতে। শনিবার একদিকে কিছু জেলায় ভোট পরবর্তী সংঘর্ষ আর কয়েকটি জেলায় প্রাক্-ভোট সংঘর্ষ মিলেমিশে এক বৃহত্তর আতঙ্কের আবহ তৈরি করল রাজ্যে। গত কালের পরে আজও অগ্নিগর্ভই রইল আমডাঙা। আর নতুন করে সংঘর্ষে মুর্শিদাবাদে মৃত্যু হল দু’জনের। বিভিন্ন জেলায় জখম অন্তত ৮৩ জন। হামলার হাত থেকে রেহাই পেলেন না পাঁচলায় তৃণমূলের বিধায়ক গুলশন মল্লিকও। বোমার টুকরোয় জখম হয়েছেন তিনি।
শনিবার প্রাক্-নির্বাচনী সংঘর্ষে মুর্শিদাবাদে মৃত্যু হয়েছে দু’জনের। কান্দির বড়ঞা থানার সুন্দরপুরে দুষ্কৃতীদের ছোড়া বোমায় মৃত্যু হয়েছে সিপিএম সমর্থক জিতাই শেখ (৩৫)-এর। আর সন্ধ্যায় বেলডাঙা থানার মির্জাপুর দক্ষিণপাড়ার কংগ্রেস সমর্থক ইয়াসিন শেখ (৩৬)-কে গুলি করার পরে কুপিয়ে খুন করে দুষ্কৃতীরা। স্থানীয় কামাল হোসেন বলেন, “ওই ঘটনার খবর গ্রামে পৌঁছতেই মির্জাপুর দক্ষিণপাড়ার পুলিশ ক্যাম্প লক্ষ করে বোমা ছোড়ে ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীরা। পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। যদিও তাতে কেউ হতাহত হয়নি। পরে র্যাফ, কমব্যাট ফোর্স ও বিশাল পুলিশ বাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে।” জেলার পুলিশ সুপার ভরতলাল মিনা বলেন, “রাজনৈতিক কারণেই এই খুন। দু’টি ঘটনায় রাত পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হয়নি। তদন্ত চলছে।” |
মুর্শিদাবাদ জেলা কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেন, “মির্জাপুর গ্রামপঞ্চায়েত এলাকায় কংগ্রেসের সংগঠন দুর্বল করতেই ইয়াসিনকে খুন করা হয়েছে। তবে সুন্দরপুরে খুনের ঘটনা ঘটেনি। জিতাই শেখ সদলবল এ দিন গ্রামে হামলা করতে চেয়েছিল। তাতে গ্রামবাসীরা বাধা দেয়। পালাতে গিয়ে নিজেদের কাছে থাকা বোমা ফেটে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। এই ঘটনায় কংগ্রেস জড়িত নয়।” সিপিএমের জেলা সম্পাদক নৃপেন চৌধুরীর পাল্টা বক্তব্য, “জিতাই শেখ দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন। সেই সময়ে দুষ্কৃতীরা তাঁকে লক্ষ করে বোমা ছোড়ে।”
স্থানীয় দুই কিশোরের মারপিটে হস্তক্ষেপ করতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন হাওড়ার পাঁচলার তৃণমূল বিধায়ক গুলশন মল্লিক। সিপিএম ও কংগ্রেসের লোকেরা তাঁকে লক্ষ করে বোমা-ইট ছোড়ে বলে অভিযোগ। গুলশনের সঙ্গে থাকা কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে হামলাকারীদের মারামারি বেধে যায়। গুলশনের পায়ে বোমার টুকরো লাগলে তিনি রাস্তায় পড়ে যান। সে সময় বিধায়ককে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন তাঁর দেহরক্ষী। তিনি শূন্যে পাঁচ রাউন্ড গুলিও ছোড়েন। পরে পুলিশ ও র্যাফ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। |
আমডাঙায় ঘর ছাড়ছেন বহু পরিবার। ছবি: সুদীপ ঘোষ |
আজিমগঞ্জে ভাঙচুর হওয়া বাড়ি। ছবি: গৌতম প্রামাণিক |
|
ভোট মিটলেও উত্তর ২৪ পরগনার একাধিক জায়গায় ছেদ পড়ল না অশান্তিতে। ভোটের দিন বুথ দখল ও ছাপ্পা ভোট ও প্রিসাইডিং অফিসারকে মারধরের অভিযোগকে ঘিরে এ দিন বসিরহাট মহকুমার বিভিন্ন এলাকায় অশান্তি ছড়ায়। সংঘর্ষে জখম হন ২৫ জন। হিঙ্গলগঞ্জের বাঁকড়া এলাকায় এ দিন সকাল থেকে বোমা-গুলি চলে। বেশ কিছু বাড়িতে ভাঙচুর চালিয়ে আগুনও ধরিয়ে দেওয়া হয়। সংঘর্ষে কয়েক জন আহত হয়েছেন। বসিরহাটের এসডিপিও অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “পরিস্থিতি সামাল দিতে ওই এলাকায় প্রথমে কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠানো হয়। কিন্তু তার পরেও অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় বিএসএফ পাঠানো হয়েছে। ১৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।” সিপিএম-তৃণমূল দু’পক্ষই গণ্ডগোলের দায় একে অন্যের উপরে চাপিয়ে দিয়েছে। বসিরহাট-১ গাছা আখাড়পুর পঞ্চায়েতের পাইকাড়ডাঙা গ্রামে গত কাল, ভোটের দিন সিপিএম-তৃণমূল গোলমাল হয়। তার জেরে আজ দুপুরে ওই এলাকার গ্রাম পঞ্চায়েতের তৃণমূল প্রার্থীর স্বামী বাকি সর্দার-সহ তাদের কয়েক জন কর্মীর উপরে সিপিএম হামলা চালায় বলে অভিযোগ তুলেছে তৃণমূল। তিন জনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কোপ মারা হয়। সরিফা বিবি নামে ওই প্রার্থীর বাড়িতেও ভাঙচুর করা হয়। ভয়ে তিনি বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান। আহত তিন জনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পুলিশ এই ঘটনায় ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে। হাসনাবাদের হাবাসপুরে এ দিন সিপিএম এবং কংগ্রেসের মধ্যে মারামারির ঘটনায় পুলিশ দুই সিপিএম সমর্থককে গ্রেফতার করলে ক্ষুব্ধ জনতা পুলিশরে উপরে চড়াও হয়। তাদের লক্ষ করে ইট-পাটকেলও ছোড়ে। পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর হয়। একই ভাবে এ দিন সন্দেশখালি, মিনাখাঁ, হাড়োয়ার একাধিক গ্রামে তৃণমূল ও সিপিএমের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
ভোট পরবর্তী সংঘর্ষে এ দিন সকাল থেকে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে দক্ষিণ ২৪ পরগনাও। বাসন্তীর ঝড়খালিতে এক তৃণমূল সমর্থকের হাঁস আরএসপি সমর্থকের পুকুরে চলে যাওয়াকে ঘিরে দু’পক্ষে সংঘর্ষ বাধে। জখম হন ২৫ জন। গোলমাল থামাতে গিয়ে তিন পুলিশকর্মী জখন হন। তাঁদের কলকাতার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এই ঘটনায় ১৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ক্যানিংয়ের গোলাবাড়িতে দুই পরিবারের জমি নিয়ে বিবাদ রাজনৈতির সংঘর্ষে রূপ নেয়। সিপিএম ও তৃণমূলের মধ্যে মারামারিতে জখম হন ১৪ জন। গোসাবাতেও সিপিএম-তৃণমূল সংঘর্ষে জখম হন কয়েক জন। জয়নগরের মায়াহাউরিতে সিপিএম এবং এসইউসি দু’দলই পরস্পরের বিরুদ্ধে বাড়ি-ঘর ভাঙচুরের অভিযোগ করেছে। উস্থির লক্ষ্মীকান্তপুর গ্রামে পঞ্চায়েত সমিতির সিপিএম প্রার্থী পঙ্কজ বর এবং তাঁর স্ত্রী পঞ্চায়েত প্রার্থী গীতা বরের বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর চালানোর অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। এ দিনই দুপুরে সংগ্রামপুর বাজারে এক সিপিএম সমর্থকের দোকানে তৃণমূলের লোকজন ভাঙচুর চালায় বলেও অভিযোগ। দু’টি ক্ষেত্রেই তৃণমূল অভিযোগ অস্বীকার করেছে। রায়দিঘির কৌতলা গ্রামে এ দিন সিপিএম এবং তৃণমূলের সংঘর্ষে উভয় পক্ষের ৮ জন জখম হয়েছেন। আহতদের রায়দিঘি গ্রামীণ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সাগরে সিপিএম-তৃণমূলের সংঘর্ষে ৮ জন জখন হয়েছেন। |
হাসনাবাদে সংঘর্ষে আহতেরা। ছবি: নির্মল বসু |
বাসন্তী হাসপাতালে আহত তৃণমূল কর্মী। ছবি: সামসুল হুদা |
|
সাগরের তৃণমূল বিধায়ক বঙ্কিম হাজরা বলেন, “সিপিএমের লোকজন আমাদের মিছিলে হামলা চালালে আমাদের ৪-৫ জন কর্মী জখম হন। পার্টি অফিসেও ভাঙচুর করে ওরা। ঠেলাঠেলিতে আমি পড়ে যাই।” সিপিএমের পক্ষ থেকে তৃণমূলের বিরুদ্ধে পাল্টা হামলার অভিযোগ করা হয়েছে।
বর্ধমানের পাণ্ডবেশ্বরের কেন্দ্রা পঞ্চায়েতের প্রার্থী সুচিত্রা দাসকে রিভলবারের বাট দিয়ে মারধরের অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। শনিবার সকালে ওই ঘটনায় তাঁর বাঁ পায়ের হাড় ভেঙে যাওয়ায় তাঁকে দুর্গাপুর মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তৃণমূল অভিযোগ অস্বীকার করেছে।
|