|
|
|
|
|
|
|
আমারপ্রথমবই |
মৃণাল সেন
|
শুনলে অবিশ্বাস্য লাগবে, ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় আমাদের স্পোর্টস-টিচার হঠাৎ টেনিস খেলার জন্যে আমাকে বাছাই করলেন। তখন সদ্য ম্যাট্রিক পাশ করে বেরিয়েছি, সায়েন্স নিয়ে দু’বছরের ইন্টারমিডিয়েট পড়ার জন্যে ভর্তি হয়েছি যে কলেজে তাতে একটা টেনিস কোর্ট ছিল। তখনও কলকাতায় আসিনি, তিরিশের দশক প্রায় শেষ হতে চলেছে, জন্মস্থান ফরিদপুরেই বড় হচ্ছি।
আমাদের টেনিস কোর্টটার চার পাশে নেট ছিল না, কয়েক জন ছেলেকে রাখা হয়েছিল যারা প্র্যাকটিসের সময় এ দিক-ও দিক থেকে বলগুলো কুড়িয়ে আনত। এক দিন বিকেলে দেখি একটা নতুন ছেলে, বয়স বড়জোর আট-নয়, গায়ে দরজির ফেলে দেওয়া নানা রঙের ছাঁট-কাপড় দিয়ে বানানো জামা, সেও অন্যদের সঙ্গে বল কুড়োচ্ছে।
বাকি ছেলেরা তা সইবে কেন, ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, চেঁচাতে লাগল— এ আমাদের দলের না, উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। ছুটে গেলাম ছেলেটাকে মারধর থেকে বাঁচাতে, তখন বাকি ছেলের দল আবার বলতে লাগল— ও মুসলমান। ছেলেটা তত ক্ষণে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়েছে, আর ‘না-না’ বলতে বলতে নিজের প্যান্ট খুলতে শুরু করেছে, আমার দিকে তাকিয়ে বলল— আপনি চাইলে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন। আমি তাকে থামালাম, বাকি ছেলেদের বললাম চলে যেতে।
ছেলেটার নাম আকবর। ফুটপাথের বাসিন্দা, ঘর নেই, প্রায়ই ক্ষুধার্ত থাকত, এটা ওটা যা পেত খেয়ে কোনও রকমে বাঁচত। বয়সে ছোট হলেও আমার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। মিশে বুঝলাম মনটা খাঁটি, স্বভাবটাও সরল। আমাদের বাড়িতেও আসতে শুরু করল। আমার বাবা-মা, ভাইরা, ছোট বোন— সবাই ওকে ভালবাসত। বাবা ওকে শোওয়ার জন্যে বালিশ-চাদর-মাদুর কিনে দিয়েছিলেন, ও এসে মাঝেমাঝেই আমাদের বৈঠকখানায় শুত।
আবার মাঝেমধ্যেই উধাও হয়ে যেত... ভবঘুরে, আদ্যন্ত ভবঘুরে ছিল আকবর। এক বার উধাও হওয়ার পর খবর পাওয়া গেল, কাছেই কমিউনিস্টরা সপ্তাহব্যাপী একটা ক্যাম্প করছে জমিহীন চাষিদের নিয়ে, সেখানে গিয়েছে। ফিরে এসে আমাদের মুক্তির গান, লড়াইয়ের গান শোনাতে লাগল— অব কোমরবন্ধ তৈয়ার হো, লাখ-কোটি ভাইয়ো, হম ভুখসে মরনেওয়ালে, হম মওতসে ডরনেওয়ালে, আজাদি কা ডঙ্কা বাজাও। সেই আকবরকেই এক দিন মিছিলে যেতে দেখলাম, ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ স্লোগান দিতে দিতে। তখন বেশ টেনশন, ব্রিটিশরাজ ক্রমশই দাঙ্গাপ্রবণ করে তুলছে আমাদের মফসসল শহরটাকে। অথচ সেখানে যেই কলেরা মহামারীর আকার ধারণ করল, হিন্দুরা সকলে হরি-সংকীর্তনে বেরতে লাগল, আকবরকে দেখা গেল সে-দলে সবচেয়ে উঁচু তারে গান গাইতে। আবার যখন শহরে সার্কাস আসত, পয়সা পেত বলে সার্কাস-পার্টির হয়ে লিফলেটও বিলি করত।
আকবরের গল্প অফুরান, বলতে শুরু করলে থামা মুশকিল। ওর এই ভবঘুরেপনার সঙ্গে চ্যাপলিনের ছবির ভবঘুরেদের আশ্চর্য মিল! ফরিদপুরের মেলায় একবার ট্যুরিং সিনেমা এল, তাঁবু খাটিয়ে ছবি দেখানোর ব্যবস্থা। বিস্তর মানুষ, নানা ধরনের মানুষ, সেই ভিড়ে আমিও এক দিন ভেসে গেলাম। সেখানে এক দিন ‘দ্য কিড’ দেখে খুব হেসেছিলাম, তখন আমার বয়স দশও পেরোয়নি, তখনও ছবির রাজ্যের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই, সিনেমা তখন হাজার মাইল দূরে। কিন্তু দেখে একেবারে মুগ্ধ, এবং মুগ্ধ আমার মতো সবাই। সেই আমার চ্যাপলিন দীক্ষায় হাতেখড়ি বলা যেতে পারে। সেই থেকে আমার সারা জীবন জুড়ে চ্যাপলিন চ্যাপলিন আর চ্যাপলিন। তাঁকে কী ভাবে আজও আমার জীবনে, ছবিতে আবিষ্কার করি, তা নিয়ে লিখেছি, লিখে চলেছি।
দেশভাগের অনেক আগেই চল্লিশের দশকের গোড়ায় কলকাতায় চলে আসি সায়েন্স নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন করতে। পাকাপাকি ভাবে অবশ্য বাড়ির লোকজন আসেন স্বাধীনতার পরে। কলকাতা আসা ইস্তক দেশে বিদেশে যতই চ্যাপলিনের ছবি দেখেছি, বুঝেছি চ্যাপলিন চ্যাপলিনই, চ্যাপলিনের কোনও বিকল্প নেই। তাঁর ছবি দেখলেই সেই হতদরিদ্র দুঃখী মানুষগুলোর সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যেত, যারা অনাদরে অবহেলায় হা-ঘরের মতো রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। তাঁর ছবি দেখলেই আমার আকবরের কথা মনে পড়ে যেত।
কলকাতায় এসে কলেজে লেখাপড়ার সঙ্গে সঙ্গে একটু-আধটু রাজনীতিও করছি, চাকরিবাকরিরও খোঁজ করছি। চাকরি কোথায়? মন্বন্তর, দাঙ্গা, নৌবিদ্রোহ, আজাদ হিন্দ সপ্তাহ, বন্দিমুক্তির মিছিল, ডাক-তার ধর্মঘট, শ্রমিক ধর্মঘট, রক্তপাত... সারা দেশ তখন চলছে এ সবের ভেতর দিয়ে, এ সবের মধ্যেই কাটছে আমাদের দিনদুপুর। ’৪৩-এর মন্বন্তর, সে একেবারে আমাদের চোখের সামনে। শহরটা চাষিদের নয়, কলকাতার রাজপথে তবু পড়ে থাকে চাষিদের মৃতদেহ। শহরের রাজপথে কী নির্মম ঔদাসীন্য! ফের চ্যাপলিনের কথা মনে পড়ে যায়, কমেডির ভাঁজে ভাঁজে লুকনো নিষ্ঠুর সময় আর সমাজের ছবি।
এক দিন ইমপিরিয়াল লাইব্রেরিতে হাজির হলাম, এখন সেটাই ন্যাশনাল লাইব্রেরি, সেখানে চার পাশে সারি সারি নতুন আর পুরনো বইয়ের গন্ধে এক অদ্ভুত জগৎ। পড়তে শুরু করলাম। সকাল ন’টা বাজলেই লাইব্রেরিতে এসে ঢুকি, থাকি সন্ধে ছ’টা পর্যন্ত। সন্ধেবেলা টিউশনি করে কিছু পয়সা রোজগার করি। এক দিন এখানেই পড়ে ফেললাম রুডলফ আর্নহাইমের ‘ফিল্ম’, পড়ে ফেললাম ভ্লাদিমির নিলসেনের ‘সিনেমা অ্যাজ আ গ্রাফিক আর্ট’। এখানেই প্রথম ‘মন্তাজ’ শব্দটা আবিষ্কার করি। সিনেমা যে এ রকম শক্তিশালী শিল্পমাধ্যম, এখানে আসার আগে জানা ছিল না। এক নিশ্বাসে পড়ে ফেললাম থিয়োডর হফ-এর লেখা ‘চার্লি চ্যাপলিন’। মাথার মধ্যে তাঁকে নিয়ে লেখার কথা ঘুরপাক খেতে লাগল।
কালীঘাট দমকলের কাছে হেমবাবুর চায়ের দোকান— প্যারাডাইস কাফে, সকাল-সন্ধে ওখানে আমরা আড্ডা দিই। আইজেনস্টাইন, অরসন ওয়েলস, প্যাশন অব জোন অব আর্ক, রোজেলিনি, নিয়ো-রিয়ালিজম, ডি সিকা, চ্যাপলিন...
দেখলাম ডি সিকা, সকলেই যাঁকে ‘বাইসাইকেল থিভস’-এর পরিচালক বলে চেনেন, এক প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন: প্রথম বিশ্বযুদ্ধ থেকে আজ পর্যন্ত সিনেমার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় হলেন চ্যাপলিন, কেউ তাঁকে ছাপিয়ে যেতে পারেননি।
আমার প্রথম বই চার্লি চ্যাপলিন যখন লিখি তখন তো আমি ছবির জগতে কেউই নই, একেবারে বাইরের মানুষ। দু’চার মাস শিক্ষানবিশি করেছি, স্টুডিয়ো মহলে ঘোরাফেরা করেছি, ওপর-ওপর টেকনিকাল কাজকর্ম দেখেছি— এই পর্যন্ত। বাকিটা সবটুকুই কেতাবি বিদ্যা। ওই অবস্থাতেই কয়েকজন বন্ধুর কথায় বইটা লিখে ফেলি।
যদিও ’৪৬ সালে আমার একটা অনুবাদের বই বেরিয়েছিল, কারেল চাপেক-এর ‘দ্য চিট’-এর অনুবাদ। কিন্তু ঠিক ষাট বছর আগে আমার প্রথম বইটা লিখতে আমি উদ্যোগী হয়েছিলাম সহজ করে সহজ ভাষায় চ্যাপলিনকে তাবৎ পাঠকের সঙ্গে পরিচিত করানোর উদ্দেশ্যে।
তখনও ছবির জগতে পাকাপাকি ভাবে আসিনি বটে, কিন্তু চা খাওয়ার মতো করে ছবি দেখি, বলাই বাহুল্য বিদেশের। সে সব ছবি দেখার বন্দোবস্ত করে দেয় বংশী, বংশী চন্দ্রগুপ্ত, আমার বন্ধু। ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি থেকে সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আলাপ সেই সূত্রেই। মানিকবাবু তখন বিজ্ঞাপন সংস্থায় কাজ করেন, আমি আর ঋত্বিক মাঝেমধ্যেই ওঁর বাড়ি যাই।
এক দিন গিয়ে বললাম চ্যাপলিন নিয়ে বইটার কথা, যদি উনি প্রচ্ছদ এঁকে দেন তা হলে চটপট বেরিয়ে যেতে পারে। শুনেটুনে উনি বললেন, ‘দু’দিন পরে আসুন।’ গেলাম দু’দিন পর, দেখি প্রচ্ছদ রেডি। হাতে নিয়ে বললাম: ‘টাকা দিতে হবে তো আপনাকে?’ উত্তরে মানিকবাবু বললেন: ‘এক কাপ চা খান।’ চমৎকার চা খেলাম, সঙ্গে ওঁর দেওয়া দামি সিগারেট। প্রচ্ছদের জন্যে পয়সার প্রসঙ্গটা আর তুলতে দিতে চাইছেন না, বুঝতে পারলাম।
আকবরও কলকাতা চলে এসেছিল, ১৯৪৮-এ। ওকে বুটপালিশের সরঞ্জাম কিনে দিলাম রোজগারের জন্যে, সে সব চুরি হয়ে গেল, অন্য পালিশওয়ালারা ওকে মেরে তাড়িয়ে দিল। কোনও মতে একটা কাজ জোগাড় করল আকবর, তিন জন মুসলিম কেরানি একটা ছোট্ট ঘরে ভাগাভাগি করে থাকেন, তাঁদের রান্নাবান্না করে যেটুকু রোজগার।
প্রায়ই দিন দুপুরে আমাদের বাড়ি আসে, আর বাবাকে মহাভারত পড়ে শোনায়, কোথা থেকে পড়তে শিখেছিল কে জানে! আমার সঙ্গে গীতার (তখনও গীতা সোম, আমাদের বিয়ে হয়নি) ভাব হয়েছে শুনে এক দিন চলে গেল উত্তরপাড়ায়, ওর সঙ্গে দেখা করতে। ফিরে এসে আমায় বলল: ‘চোখ দুটো ভারী সুন্দর।’
মাঝেমাঝেই তাজ্জব বনে যেতাম, আকবরের মধ্যে অসাধারণ একটা মানুষকে বসবাস করতে দেখে। খুব বেশি দিন অবশ্য বাঁচেনি তার পর, ব্যস্ত রাস্তা পেরতে গিয়ে দুটো ট্রামের মাঝখানে পড়ে গিয়েছিল, পিষে মারা যায়। ১৯৫৩-য় ঠিক আমার বিয়ের পর পরই বেরল আমার প্রথম বই চার্লি চ্যাপলিন, প্রকাশক: শতাব্দী। উৎসর্গ করলাম আকবরকে, লিখলাম: আমার চিরকালীন ভবঘুরের স্মৃতিতে। |
|
|
|
|
|