|
|
|
|
|
|
|
প্রিসাইডিং অফিসারের ডায়েরি |
পাঁচ বছর আগে, পঞ্চায়েত ভোটে একটি বুথে প্রিসাইডিং অফিসার হওয়ার রকমারি অভিজ্ঞতা।
ট্র্যাজেডি আছে, কমেডিও, আর মধ্যবর্তী শেড।
সীমান্ত গুহঠাকুরতা
|
১২ মে ২০০৮, সোমবার, সন্ধে ৭:০০ |
সাবান, তেল, মগ, গামছা, বিছানার চাদর, মশারি, পেটখারাপ আর জ্বরের ওষুধ, কার্বলিক আসিড...লিস্টি মিলিয়ে মিলিয়ে প্যাকিং চলছে। না, কোথাও বেড়াতে নয়, আমি চলেছি ভোট করাতে। আগামী পরশু পঞ্চায়েত ভোট। আমি মহামান্য ইলেকশন কমিশন কর্তৃক নিযুক্ত এক জন প্রিসাইডিং অফিসার।
‘জীবনে প্রথম বার ভোটেই প্রিসাইডিং অফিসারের ডিউটি, তাও আবার পঞ্চায়েত ভোট? তুই মরেছিস।’ চিন্তিত মুখে বলেছিল চিত্তদা, আমার সিনিয়র সহকর্মী।
প্রচণ্ড ঘাবড়ে গেলাম। সদ্য চাকরি পেয়েছি, বিয়ে-থা হয়নি, তার মধ্যেই ঝানু ভোট-করিয়ে চিত্তদার এহেন উক্তি...পালস রেট বেড়ে গেল। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘এটা কাটিয়ে দেওয়ার কোনও উপায় নেই চিত্তদা?’ মোটর বাইকের চাবি দিয়ে কান খোঁচাতে খোঁচাতে চিত্তদা বলল, ‘থাকবে না কেন? তিনটে রাস্তা আছে। নিজেই ভোটে দাঁড়িয়ে যা নির্দল প্রার্থী হয়ে, বা চাকরিটা ছেড়ে দে, অথবা নিজেকে মৃত প্রমাণ করে ডেথ সার্টিফিকেট জমা দে।’ |
১৩ মে ২০০৮, মঙ্গলবার, রাত ১১:০০ |
কাল সকাল সাতটায় ভোট শুরু। একটু আগে যাবতীয় কাজ গুছোনো শেষ হল। এই ভোটকেন্দ্রে ভোটার সংখ্যা ৯৬৫। তার তিন গুণ সংখ্যক ব্যালট পেপারের (কেননা এটা ত্রিস্তর নির্বাচন— গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি আর জেলা পরিষদ) পিছনে দুটি করে স্ট্যাম্প মারা, প্রত্যেকটা ব্যালট পেপারের পিছনে পুরো সই করা, হাজারো কাগজপত্র আর খামের ওপর সেই একই স্ট্যাম্প আর সই, ভোটকেন্দ্রের দেওয়ালে নানা কাগজ সাঁটানো— কাজ আর ফুরোয় না। খানিক আগেই চার জন পোলিং অফিসার এই স্কুলবাড়ির স্যাঁতসেঁতে মাটির মেঝেতে চাদর পেতে তার ওপর মশারি খাটিয়ে শুয়ে পড়েছেন। আমাদের সঙ্গে আসা আধবুড়ো পুলিশ কনস্টেবলটিও অনেক ক্ষণ হল বারান্দায় কয়েকটা বেঞ্চি জুড়ে তার ওপর লম্বমান। আর আমি ঘরের এক কোণে চাদর পেতে শুয়ে মশা থাবড়াচ্ছি।
স্কুলবাড়িটার সামনে দিগন্তবিস্তৃত মাছ চাষের ভেড়ি। একটা সোঁদা গন্ধমাখা বাতাস মাঝে মাঝে উঠে আসছে সেখান থেকে। পিছনে ঘন বাঁশঝাড়। ঝিঁঝির প্রবল ডাকে কান বন্ধ হবার জোগাড়। কাছাকাছি কোথাও সাপে ব্যাং ধরেছে, কটর-কটর ডাক শোনা যাচ্ছে। গণতন্ত্রের প্রহরী আমরা আজ, ব্যালট পেপারের বান্ডিল আঁকড়ে জেগে আছি সভ্যতার এই মহারণ্যে।
শেষ বিকেলে প্রবল এবড়োখেবড়ো মাটির রাস্তা ধরে ঝাঁকুনি খেতে খেতে আমাদের গাড়িটা যখন এই ফ্রি-প্রাইমারি স্কুলটার সামনে এসে পৌঁছেছিল, পালে পালে কোমরে ঘুনসি-বাঁধা ল্যাংটো বাচ্চার দল ছুটতে ছুটতে এসেছিল চার দিক থেকে। অবাক চোখে তারা দেখছিল প্যান্ট-শার্ট পরা লোকগুলোকে। আমিও দেখছিলাম ওদের। হাড়-জিরজিরে শরীরের ওপর বেঢপ বড় পেট, গায়ের চামড়া খড়ি ওঠা, চুলে রাজ্যের ধুলো-ময়লার জট। হঠাৎ মনে হল, এই যে ভোটের নামে সুবিশাল কর্মযজ্ঞ, কোটি কোটি টাকার অন্তহীন উড়ান— এর অনেকটাই হয়তো জোগাড় হয়েছে এই শিশুদের প্রাপ্য বরাদ্দ থেকে ধার করে। |
|
১৪ মে ২০০৮, বুধবার, সকাল ৯:০০ |
সাতসকালেই এক প্রস্থ নাটক হয়ে গেল। ভোট শুরুর আগে ব্যালট-বক্সটাকে ভিতর থেকে একটা ‘পেপার সিল’ দিয়ে বন্ধ করে দেওয়ার নিয়ম। ভোট গণনার সময় ওই সিল-টা ছিঁড়ে, তবেই বাক্সটাকে খোলা যায়। ভোটকেন্দ্রে থাকা রাজনৈতিক দলের এজেন্টরা পেপার সিল-এর নম্বরটা টুকে রাখে, যাতে গণনার সময় সেটা মিলিয়ে দেখে নিতে পারে এবং নিশ্চিত হতে পারে, ব্যালট বক্সটা আগে খোলা হয়নি। তা আমার কেন্দ্রের দুজন এজেন্ট হঠাৎ বেঁকে বসল। ‘ও সব পেপার সিল-ফিল আমরা বুঝি না স্যর। ও সবের ডুপ্লিকেট বানানো যায়, হয়তো অলরেডি বানানোও হয়ে গেছে। আমরা একটা দশ টাকার নোট এখানে গেঁথে দেব, আর তার নম্বরটা টুকে রাখব। নোটের ওপর সইও করে দেব। নোট তো আর বদলাতে পারবেন না।’
প্রমাদ গুনলাম। স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম এরা কোনও যুক্তি-তক্কো বুঝবে না, না-বোঝার ট্রেনিং নিয়েই এসেছে উচ্চ-নেতৃত্বের কাছ থেকে। এ দিকে বেলা বয়ে যায়, ভোট শুরু করতেই হবে। ফোন করলাম সেক্টর অফিসারকে। ভদ্রলোক একগাড়ি পুলিশ নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। সমস্যাটা শুনে নিদান দিলেন: ‘লাগাও বাবারা, দশ টাকা, একশো টাকা, সাপ ব্যাং হাতি ঘোড়া যা খুশি লাগাও। শুধু তার সঙ্গে আমাদের সরকারি কাগজটাও লাগাতে দাও। কী, তাতে অসুবিধে নেই তো?’ |
১৪ মে ২০০৮, বুধবার, দুপুর ১২:০০ |
‘স্যর, কোথায় রাখব?’
সকাল থেকে বেশ মসৃণ ভাবেই চলছিল ভোটগ্রহণ। ভোটাররা একে একে এসে ভোট দিয়ে যাচ্ছিলেন, চার জন পোলিং অফিসার পাশাপাশি যন্ত্রের মতো কাজ করে যাচ্ছিলেন। আমি টেবিলে বসে কাগজপত্রের স্তূপে মাথা গুঁজে ছিলাম। হঠাৎই শুনতে পেলাম এই প্রশ্ন। চমকে তাকিয়ে দেখি, এক জন মাঝবয়সি লোক, পরনে লুঙ্গি আর স্যান্ডো গেঞ্জি, এক থুত্থুড়ে বুড়িকে পাঁজাকোলে করে আমার সামনে দাঁড়িয়ে। আমাকে বিস্ময়-বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকতে দেখে লোকটা একগাল হেসে বলল, ‘আমার মা, স্যর, কোথায় রাখব?’
যেন মা আর একটা প্যাকিং বাক্সের মধ্যে কোনও তফাতই নেই। বললুম, ‘কোথায় আর রাখবেন, মেঝেতেই রাখুন।’ লোকটা বিনা বাক্যব্যয়ে ঘরের ঠিক মধ্যিখানে চিৎ করে শুইয়ে দিল বুড়িকে, তার পর লুঙ্গির গোঁজ খুলে হলুদ তেলচিটে ভোটার আই-ডি কার্ড বের করে একগাল হেসে বলল, ‘মায়ের ভোটটা আমিই দেব স্যর, এই যে মায়ের কার্ড।’
অমনি উলটো দিক থেকে হাঁ হাঁ করে উঠল এক জন এজেন্ট। ইনি রুলিং পার্টির। ‘ও হবে না স্যর। ওর মা আজ দু’বছর নড়াচড়া পর্যন্ত করতে পারে না। দাওয়ার এক কোনায় পড়ে থাকে। ওই বুড়ির আবার ভোট কীসের? তা ছাড়া ও তো ওর মাকে ভাত দেয় না, পাড়া প্রতিবেশীরা ভাত দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে।’ বুঝলাম, ‘সুপুত্র’-টি বিরোধী পার্টির সমর্থক। বললাম, ‘নড়াচড়া করতে পারুক বা না-পারুক, ভোট দেবার পুরো অধিকার ওর আছে। এটাই গণতন্ত্রের নিয়ম। আর অক্ষম বা অশক্ত লোকের হয়ে তার ছেলে ভোট দিতে পারে। আইন তাই বলছে। তবে তার জন্য ওর ছেলেকে দিয়ে কিছু কাগজপত্রে সই-সাবুদ করিয়ে নিতে হবে আমায়।’
রুলিং পার্টি তখন তেরিয়া, ‘এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না স্যর। এ রকম ঘাটের মড়া আমাদেরও অনেকের ঘরেই আছে। এ বার আমরাও কিন্তু ওদের পর পর নিয়ে আসতে থাকব।’ মিষ্টি হেসে বললাম, ‘নিশ্চয়ই আনবেন। শরীরে প্রাণটুকু থাকলেই হবে। শুধু দেখবেন, এক জন ছেলে যেন এক জন মাকে নিয়েই আসেন।’ |
১৪ মে ২০০৮, বুধবার, দুপুর ২:০০ |
ভোটকেন্দ্রের বাইরে, স্কুলবাড়ির গেটের মুখে একটা বচসার আভাস পেলাম হঠাৎ। কেউ যেন খুব উঁচু গলায় ধমকাচ্ছে কারওকে। তাড়াতাড়ি টেবিল ছেড়ে বাইরে গিয়ে দেখি— এক জন বৃদ্ধ ভদ্রলোক আমাদের পুলিশ কনস্টেবলটিকে দেশি হিন্দিতে শাসাচ্ছেন, ‘তুমহারা নোকরি খা লুঙ্গা ম্যায়, জানতা হ্যায় ম্যায় কৌন হুঁ?’ ভদ্রলোকের পরনে গিলে করা আদ্দির পাঞ্জাবি আর কোঁচানো শান্তিপুরি ধুতি, মাথার চুল সব সাদা, হাতে একটা মাথা-বাঁকানো শৌখিন লাঠি। পুরো সত্তরের দশকের সিনেমার নায়কের বাবার মতো চেহারা আর পোশাক-আশাক, গলার স্বরটিও তদনুরূপ।
গেটের কাছে ঝামেলা বাড়লে বিপদ, তাই ভদ্রলোককে বললাম, ‘আপনি ভিতরে আসুন। আমাকে বলুন কী ব্যাপার?’ আমার ইশারায় পুলিশ কনস্টেবলটি ছেড়ে দিল তাকে।
ভদ্রলোক বুথের ভিতর ঢুকেই সরাসরি আমাকে অত্যন্ত তাচ্ছিল্য ভরে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কে হে ছোকরা?’ বিনীত ভাবে জবাব দিলাম, ‘আমি এই বুথের প্রিসাইডিং অফিসার’।
‘ও সব অফিসার-টফিসার আমার অনেক দেখা আছে। আমি নিজেও তিরিশ বছর রাইটার্স বিল্ডিং-এ অফিসারের চাকরি করেছি। এখন এই গ্রামে পৈতৃক ভদ্রাসনে এসে বাস করছি বলে আমাদের গেঁয়ো ভূত ভেবো না। যাই হোক, তাড়াতাড়ি আমার ভোটটা দেবার ব্যবস্থা করে দাও দেখি। আর শোনো, ও সব আঙুলে কালি-টালি লাগানো চলবে না। আমার গিন্নি পছন্দ করেন না।’
ভদ্রলোকের হাবভাব দেখে হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছিলাম না। যথাসম্ভব গাম্ভীর্য বজায় রেখে বললাম, ‘আপনার পরিচয়পত্রটা না দেখালে তো আপনাকে ভোট দিতে দেওয়া সম্ভব নয়।’
‘তোমার স্পর্ধা দেখে আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি’, ভদ্রলোকের গলায় রীতিমত জমিদারি সুর, ‘এখানে দশটা গ্রামের লোক আমার পরিচয় জেনেই আমার কাছে আসে, আর তুমি আমার কাছে পরিচয়পত্র দেখতে চাইছ?’
আমারও ধৈর্যের সীমা ছাড়াচ্ছিল, একটু অসহিষ্ণু ভাবেই বলতে বাধ্য হলাম, ‘আপনি যে-ই হোন, আমি আপনাকে চিনি না, আর ভোট দিতে হলে আমার কাছে আপনার পরিচয়পত্রই শেষ কথা। ওটা নিয়ে আসুন, তবেই আপনি ভোট দিতে পারবেন।’
আমার কণ্ঠস্বরের দৃঢ়তাতেই বোধ হয় ভদ্রলোক একটু থমকে গেলেন। এই প্রথম গলা একটু নামিয়ে বললেন, ‘তাই বুঝি? আচ্ছা বেশ।’ বলেই দরজার কাছে গিয়ে গলা তুলে লাইনে অপেক্ষমাণ জনতার উদ্দেশ্যে হাঁক
দিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ রে, কেউ এক জন একটু দৌড়ে গিয়ে আমার বাড়ি থেকে কার্ডটা নিয়ে আয় তো।’
বলাই বাহুল্য, ওঁর এই আদেশে উপস্থিত জনতার কারওরই কোনও হেলদোল দেখা
গেল না।
‘হুম, কাজের সময় কাউকে পাওয়া যায় না, যাই আমিই তবে নিয়ে আসি গিয়ে’, বলতে বলতে বৃদ্ধ গটগট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
উনি বেরিয়ে যেতেই খিকখিক করে হাসতে লাগল বুথে বসে থাকা এজেন্ট দুজন। জানতে চাইলাম, ‘চেনেন নাকি ওঁকে?’
‘চিনব না কেন স্যর?’ হাসতে হাসতেই বলল এক জন, ‘বুড়ো পুরো তার-কাটা মাল স্যর। কলকাতায় বড় চাকরি করত। দুটো ছেলে ছিল, বাপের দাপটের ঠেলায় দুটোই আমেরিকা পালিয়েছে। এখন এখানে এসে পুরনো ভাঙাচোরা বাড়িটা সারিয়ে-সুরিয়ে বুড়োবুড়িতে থাকে। পেনশন-এর টাকায় ফুটানি মেরে বেড়ায় আর মাতব্বরি করে। কেউ পাত্তা দেয় না স্যর, বাচ্চাগুলো তো পিছন থেকে ধুতির কোঁচা খুলে দিয়ে পালায়।’
মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেল। মনে হল, ভোটটা দিতে দিলেই হত বুড়ো মানুষটাকে। না হয় মিথ্যে করেই লিখে দিতাম একটা কার্ড নম্বর। কারই বা চোখে পড়ত ওই সামান্য গরমিলটুকু। তাতে এই একঘর লোকের সামনে হারিয়ে যাওয়া সম্মানের অন্তত খানিকটা হলেও তো ফেরত পেতেন মানুষটা। |
১৪ মে ২০০৮, বুধবার, বিকেল ৩:০০ |
ঈশান কোণে মেঘ জমতে শুরু করেছিল বেলা বারোটার পর থেকেই। দেখছিলাম, রুলিং পার্টির দুজন এজেন্টের মুখ ক্রমশ থমথমে হয়ে উঠছে। বুঝতে পারছিলাম, তাহাদের বরাতে ভোট কম পড়িতেছে। তার ওপর বেশ কয়েক জন পরিচয়পত্রহীন ভোটারকে ফিরিয়ে দিয়েছি আমি। উষ্মা বাড়ার সেটাও একটা কারণ বটে।
তার পরই ঘটল সেই ঘটনাটা। মেয়েটা অল্পবয়সি, সুন্দরী, চোখে-মুখে বেশ একটা ঢলে পড়া ভাব— ব্যালট পেপারটা হাতে নিয়ে চট দিয়ে ঘেরা ভোটিং কম্পার্টমেন্টের ভিতর ঢুকে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল। দেরি দেখে আমাদের এক জন পোলিং অফিসার তাড়া দিলেন, ‘কী হল, তাড়াতাড়ি করুন।’ ‘আমি কিছু বুঝতে পারছি না, কোথায় ছাপ দেব?’ একটা অসহায় ন্যাকা ন্যাকা গলা ভেসে এল চটের পরদার পিছন থেকে। ‘কী মুশকিল। আরে, ব্যালট পেপারে ছাপা চিহ্নগুলো দেখতে পাচ্ছেন না?’ অধৈর্য হয়ে বললেন পোলিং অফিসার। ‘কীসের চিহ্ন, আমি কিছু বুঝতে পারছি না’, আবার সেই ন্যাকা গলা, এ বার তাতে যেন একটু কান্নার সুর লেগেছে।
সমস্যা দেখে প্রিসাইডিং অফিসার হিসেবে আমাকেই হস্তক্ষেপ করতে হল। গলা তুলে বললাম, ‘ব্যালট পেপারটা কি আপনার হাতে আছে?’ উত্তর এল, ‘হ্যা।ঁ’ ‘এ বার দেখুন, তার ডান দিকে পর পর কিছু চিহ্ন আছে, ওগুলো সব বিভিন্ন দলের প্রতীক। আপনি যে দলকে ভোট দেবেন, তার চিহ্নের ওপর ছাপটা দিন।’
খানিক ক্ষণ সব চুপচাপ, তার পর আবার সেই কান্নাভেজা গলা, ‘আমার খুব ভয় করছে, আপনি একটু এসে দেখিয়ে দিন না।’
আচ্ছা মুশকিলে পড়া গেল। বললাম, ‘আমি ওখানে কিছুতেই যেতে পারব না। নিয়ম নেই। আপনি একটু মন স্থির করে দেখুন, ব্যালট পেপারের ওপর ডান দিকে প্রথমে ঘাসফুলের ছাপ আছে। দেখতে পাচ্ছেন? তার পর দেখুন, তার ঠিক নীচে আছে...’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি’, আমাকে আর কিচ্ছুটি বলতে না দিয়ে মেয়েটা মুহূর্তের মধ্যে চটের পরদার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল আর ভাঁজ করা ব্যালট পেপারটা বাক্সে ফেলে দিয়ে খুব দ্রুত বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। আমার শিরদাঁড়া বেয়ে একটা হিম স্রোত নেমে এল, বুঝলাম, ভুল করে ফেলেছি আমি। মারাত্মক ভুল। আমাকে দিয়ে ঠিক যেটুকু বলানোর দরকার ছিল, বলিয়ে নিতে পেরেছে মেয়েটা। এর ফল ভুগতে হবে আমাকে, অবিলম্বেই।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই এক দল ছেলে হুড়মুড় সোজা ঢুকে ঢুকে এল ভোটকেন্দ্রের ভিতরে। ‘ভোট বন্ধ করুন, বন্ধ করুন ভোট’ বলতে বলতে ওরা আমার টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়ে গেল। ‘কী দাদা, আপনি এখানে বসে বসে ভোটারদের কোন চিহ্নে ছাপ দিতে হবে বলে দিচ্ছেন?’ বলতে বলতে তাদের এক জন কলার ধরে একটা হ্যাঁচকা টান মেরে দাঁড় করিয়ে দিল আমাকে। ‘শালা, বিরোধী পার্টির দালাল, শুরু থেকে দেখছি মালটা খচরামি করছে’, আর এক জন চিল্লে উঠল চড়া গলায়, আর বলতে বলতেই হাত বাড়িয়ে পকেট থেকে তুলে নিল আমার মোবাইল ফোনটা।
‘আমি...আমি...মানে...আমার কথাটা এক মিনিট শুনুন...’ আতঙ্কে তোতলাচ্ছি আমি।
‘চোপ শালা’ বলেই আমার কলার খামচে ধরে থাকা ছেলেটা সটান একটা চড় কষাল আমার গালে। চোখে অন্ধকার দেখলাম। আর ঠিক তক্ষুনি, টেবিল ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ভিড়ের পিছন থেকে শুনতে পেলাম এক মহিলার গলা, ‘কী হয়েছে এখানে? দেখি, সর তোরা, সরে দাঁড়া, ঝামেলা কীসের?’
জোঁকের মুখে যেন নুন পড়ল। মুহূর্তে দ্বিতীয় চড়টা মারার জন্য উদ্যত হাতটা নেমে গেল। কলারটাও ছাড় পেল শক্ত মুঠি থেকে। তত ক্ষণে ভিড় সরিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন সেই মহিলা। স্নিগ্ধ মুখ, সিঁথিতে চওড়া সিঁদুরের রেখা, কপালে গোল টিপ, পরনে সস্তা কিন্তু পরিষ্কার তাঁতের শাড়ি, হাতে শাঁখা-পলা। কোলে একটা বাচ্চা ছেলে, মায়ের কাঁধে মাথা রেখে অঘোরে ঘুমিয়ে আছে।
‘আমি এক জন ক্যান্ডিডেট, আমাকে বলুন, কী হয়েছে?’
মনে পড়ল, আমার এই পঞ্চায়েত-আসনটা মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত, তাই সব প্রার্থীই মহিলা। ইনি তাঁদেরই এক জন এবং সম্ভবত ক্ষমতাসীন দলেরই। না হলে, ওঁর কথায় এ ভাবে সবাই থেমে যেত না।
‘আমি...মানে ওরা বলছে আমি নাকি...’ স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম জিভের ওপর আমার আর নিয়ন্ত্রণ নেই, কথা জড়িয়ে যাচ্ছে, গোটা শরীরটা তখনও কাঁপছে।
‘আপনি বসুন, জল খান একটু’, আশ্বাসের সুরে বললেন মহিলা। চেয়ারে বসে কাঁপা কাঁপা হাতে সামনে রাখা জগটা তুলে গলায় জল ঢালতে ঢালতেই দেখলাম পিছন ঘুরে সেই মহিলা ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেগুলোকে বললেন, ‘তোরা বাইরে যা, আমি দেখছি।’
‘কিন্তু দিদি, আপনি জানেন না, এই লোকটা...’ দলের এক জন আপত্তি জানাল।
‘বললাম তো, আমি দেখছি, বাইরে যা তোরা। আগেই তোদের বলেছি, আমার বুথে এমন কিছু করবি না যাতে এই এলাকার বদনাম হয়।’ মহিলার গলার স্বরে এমন একটা শান্ত দৃঢ়তা, আর একটি কথাও না বলে ওই ভৈরব বাহিনী সুড়সুড় করে বুথের বাইরে চলে গেল। |
১৪ মে ২০০৮, বুধবার, বিকেল ৪:০০ |
ভোটগ্রহণের কাজটা এখন একটু হালকা। লাইনে ভিড়ও বেশি নেই। মানুষজন সব দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সারছে। আমি কাগজ-পত্রের স্তূপ থেকে মাথা তুলে একটু বিশ্রাম করছিলাম। সেই সময়ই লক্ষ করলাম, এক জন মাঝবয়সি ভদ্রলোক, গালে রুখু দাড়ি, ভোট দেওয়ার ছলে বার বার ঘুরে ঘুরে আমার দিকে দেখছেন। কোনও রকমে চটের আড়ালে গিয়ে ছাপটা মেরে, ব্যালটটা বাক্সে ফেলেই তিনি সোজা চলে এলেন আমার টেবিলের সামনে। তার পর খুবই বিনীত ভঙ্গিতে বললেন, ‘আপনার সঙ্গে একটু কথা ছিল স্যর, একটু বাইরে আসবেন?’
অবাক হয়ে বললুম, ‘কী ব্যাপার? যা বলার আপনি এখানেই বলতে পারেন?’
‘না, মানে, কথাটা একটু পার্সোনাল। আসুন না একটু...’
ভোট দিতে এসে প্রিসাইডিং অফিসারের সঙ্গে পার্সোনাল কথা কী থাকতে পারে রে বাবা! তবু উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, ‘আচ্ছা চলুন।’
ভদ্রসোক আমাকে স্কুলবাড়ির বারান্দার একটা নির্জন কোনায় টেনে নিয়ে গেলেন প্রায়, তার পর আবার সেই বিনয়ে গদগদ ভঙ্গিতে বললেন, ‘ইয়ে, মানে, আপনি কি বিবাহিত?’
চট করে ব্যাপারটা বুঝে গেলাম। গ্রামদেশে বছর দুয়েক চাকরির অভিজ্ঞতা থেকে এই হন্যে হয়ে সরকারি চাকুরে খোঁজা মেয়ের বাপেদের হাড়ে হাড়ে চিনি আমি। কিন্তু এরা যে এই ভোটকেন্দ্রের ভিতরও হানা দিতে পারে তা স্বপ্নেও ভাবিনি।
‘আজ্ঞে না। বিয়ে এখনও করিনি আমি। কিন্তু এখানে এ কথা কেন?’
‘না মানে, আমার মেয়ের ব্যাপারে একটু কথা বলতাম। সময় বাঁচিয়ে আসুন না একটু আমার বাড়িতে। এই পাশেই বাড়ি আমার।’
আমার বিরক্তি বাড়ছিল। তবু নিজেকে যথাসম্ভব সংযত রেখে বললাম, ‘এই ভোটকেন্দ্র ছেড়ে বেরনো তো আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তা ছাড়া...’
‘ও কিছু হবে না স্যর...’ ভদ্রলোক আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন, ‘আমাদের এলাকা খুবই শান্তিপূর্ণ, আপনি নিশ্চিন্তে ঘুরে আসতে পারেন। আমার মেয়ে স্যর, উচ্চ মাধ্যমিক পাশ, রংটা কালো, কিন্তু সুন্দরী। রান্নাবান্না, সেলাই সব জানে স্যর আমার মেয়ে। একেবারে মা লক্ষ্মী। আসবেন স্যর একটু, আমাদের বাড়িতে?’
কেন জানি না, কোনও দিনই আমি এই জাতীয় মানুষগুলির প্রতি রুক্ষ হয়ে উঠতে পারি না। অগত্যা সেই নির্জলা মিথ্যা, কিন্তু অব্যর্থ টোটকা প্রয়োগ করলাম। খুবই বিনীত ভঙ্গিতে বললাম, ‘আমি খুবই দুঃখিত। আমার এক জন বান্ধবী আছে, তাকে হয়তো খুব শিগগিরিই বিয়ে করব। আপনার মেয়ের জন্য না হয় আমি ভাল একটা পাত্র দেখে দেব, নাম-ঠিকানা দিয়ে দিন আমায়।’
বড়ই হতাশ মুখে চলে গেলেন ভদ্রলোক। । স্কুলবাড়ির বারান্দার গ্রিলের ফাঁক দিয়ে দেখলাম, সূর্য এখন অনেকটাই ঢলে পড়েছে পশ্চিমে। আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে গোধূলির আলো। মনটা হঠাৎ কেমন বিষণ্ণ হয়ে গেল আমার। সে বিষণ্ণতার খানিকটা সেই আমার না-দেখা অনূঢ়া কৃষ্ণকলিটির জন্য, আর বাকিটা তার সেই অভাগা বাপের জন্য, গ্রামজোড়া এই তুমুল রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যেও মেয়ের বিয়ে না দিতে পারার বিপন্নতা যাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। |
১৫ মে ২০০৮, বৃহস্পতিবার, ভোর ৪:০০ |
মফস্সলের একটা শান্ত নির্জন রেল-প্ল্যাটফর্মের মেঝেতে চাদর পেতে শুয়ে আছি। ভোট শেষ হয়েছিল রাত আটটায়। কাগজপত্র গুছিয়ে বেরুতে বেরুতে দশটা বাজল। রিসিভিং স্টেশনে মালপত্র বুঝিয়ে দিয়ে যখন ছাড়া পেলাম, রাত একটা। দুপুরে সামান্য ডাল-ভাতের ব্যবস্থা করা গিয়েছিল। দাম পড়েছিল মিল প্রতি একশো টাকা। গ্রামের লোকেরা জানে— এরা শহরের বাবু, পয়সাওয়ালা লোকজন, তাই অসহায়তার সুযোগ নিয়ে ইচ্ছেমত দাম হাঁকে ওই এক বেলার খাবারের। আর তার পর থেকে এই পর্যন্ত খানকয়েক বিস্কুট আর জল ছাড়া পেটে একদম কিচ্ছুটি পড়েনি।
প্ল্যাটফর্মে ইতিউতি আমার মতোই আরও অনেক ভোটকর্মী ভোরের প্রথম ট্রেনের অপেক্ষায় শুয়ে-বসে সময় কাটাচ্ছেন। ঘুম নেই কারও চোখেই। হালকা আলাপ-পরিচয় চলছে মৃদু স্বরে পরস্পরের সঙ্গে, চলছে সারা দিনের নানা যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতার আদান-প্রদান।
আমি একদৃষ্টে তাকিয়ে আছি বহু দূর পর্যন্ত এলিয়ে পড়ে থাকা সমান্তরাল রেললাইন দুটোর দিকে। সিগনালের আলো প্রতিফলিত হয়ে লোহার পাতগুলো আগুনের মতো লাল। বার বার মনে পড়ছে সেই মহিলার কথা, যাঁর জন্য তুমুল অপমান আর শারীরিক নিগ্রহের হাত থেকে আজ রক্ষা পেয়েছি আমি। মনে পড়ছে বুথ ছেড়ে চলে যাবার আগে সেই মহিলার বলা শেষ কথাগুলো: ‘আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন, কেউ আর কিছু বলবে না আপনাকে। তবু দরকার হলে ফোন করে ফোর্স ডাকিয়ে নিন। শুধু দেখবেন, সবাই যেন ঠিকঠাক নিজের নিজের ভোটটা দিতে পারে।’ মনে পড়ছে জলসাঘরের ছবি বিশ্বাসের মতো সেই গমগমে ভদ্রলোকের কথাও, যিনি নিজের একটা অতীত ইমেজকে আঁকড়ে এখনও তার মধ্যেই বাস করে চলেছেন। আরও কত কী মনে পড়ছে, হিজিবিজি।
পুব দিকে, প্ল্যাটফর্মের মাথায় সিগনালটা হঠাৎ সবুজ হয়ে গেল। ব্যাগপত্তর গুছিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। ট্রেন আসছে। (সব ঘটনাই যে সত্যি সত্যি আমার ক্ষেত্রেই ঘটেছিল, তা নয়। বন্ধু প্রিসাইডিং অফিসারের মুখ থেকে শোনা এক-আধ টুকরোও জুড়ে দিলাম। তাতে বিরাট কিছু এসে যায় না, গল্প সব সময়ই সত্যির চেয়ে বড়।) |
ছবি: সুমন চৌধুরী |
|
|
|
|
|