|
|
|
|
|
|
ল্যাজে পা
|
ঈপ্সিতা পালভৌমিক |
থার্টি প্লাস পুত্র কিংবা টোয়েন্টি সিক্স প্লাস কন্যার এযাবৎকাল তীব্র বিবাহবিমুখতার পিছনে অত্যধিক কেরিয়ারমনস্কতা থেকে শুরু করে কোষ্ঠীতে সাংসারিক বৈরাগ্যযোগ বা গোপন বাস্তবে অন্য কোনও বিবাহিত পুরুষ বা নারীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন— সব রকম সম্ভাবনাই তলিয়ে দেখতে গিয়ে আপনি যখন কূল-কিনারা কিছুই পাচ্ছেন না, তখনই এল সেই বিস্ফোরক স্বীকারোক্তি বা সেকেন্ডারি মেসেঞ্জার কর্তৃক প্রবাহিত ইনফো, সে সমকামী। হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। আপনার সন্তান সমকামী।
তিনশো সাতাত্তরোত্তর যুগের বাসিন্দা হয়ে এই সংবাদে আপনি অবশ্যই আকাশ থেকে পড়েননি। কিন্তু আকাশ আপনার মাথায় ভেঙে পড়েনি, এ কথা হলফ করে বলা যাচ্ছে না। স্যুট-প্যান্ট পরিহিত পুত্রবধূর চিবুক স্পর্শান্তে কুলো ঘুরিয়ে বরণ করার কর্ণ জোহরীয় সিনের কল্পনা আপনাকে বিন্দুমাত্র কমিক রিলিফ দেবে না, সে কথা অবিশ্যি অবশ্য করেই বলা যায়।
সেটা স্বাভাবিকও। কারণ, আর যাই হোক, সমকামিতা তো আর স্বাভাবিক নয়। আপনার স্বাভাবিক বুদ্ধি বিচার প্রয়োগ করেই আপনি জানেন, এটি আর পাঁচ জন স্বাভাবিক মানুষের থেকে আলাদা ব্যাপার। চার পাশের বাকি মানুষজনের থেকে আলাদা হওয়া অস্বাভাবিকতা নয় তো কী? আর, অস্বাভাবিকতা, অসুখ নয় তো কী? হ্যাঁ, অপরাধ না হোক, এটা অসুস্থতা। এবং, অসুখ বলেই সমকামিতা সেরেও যেতে পারে।
অতএব, অসুখ সারান।
কিন্তু সারাতে চাইলেই বা এ নিয়ে জানতে পারছেন কই? চার পাশ তো ছেয়ে গেছে হোমো বা হোমোপ্রেমী লিবারেল নব্য আঁতেলগণে, যাঁরা সমকামিতাকে অসুখ বললেই রে-রে করে তেড়ে আসেন, এলজিবিটি রাইটস নিয়ে উথলে না পড়লে অদ্যকার আঁতেল সমাজে কলকে মেলা দায়।
ফেসবুকে যাবেন? সেখানে তো দেওয়ালে দেওয়ালে এই সব পোস্টার! সমকামিতা নাকি অসুখ তো নয়ই, উলটে হোমোফোবিয়াই নাকি অসুখ! We are gay, we are lesbian, we are as normal as you; Love needs no cure — লেখা প্ল্যাকার্ডপত্তর হাতে ছেলেপুলেদের ছবি-ছাব্বা। গুগ্লে গিয়েও বিধি বাম, gay কি homosexuality টাইপ করলেই পাতার পর পাতা জুড়ে সমকামী বিবাহকে ওবামা-র স্বীকৃতি দানের খবর, তা নিয়ে হুল্লোড়বাজি। |
|
ঘাবড়ানোর কিছু নেই। নেট খুঁজে শুধু বিষ না, অমৃতেরও সন্ধান পাবেন। ২৬ থেকে ৪৭ বছরের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন নানা ‘ক্লিনিক’-এর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে ইন্টারনেটেই। যেখানে টাক, অর্শ, ভগন্দর, দাদ, হাজা থেকে শুরু করে সমকামিতা, সবেরই যত্ন সহকারে চিকিৎসা করা হয়। অবশ্য ওষুধে অনেকের অ্যালার্জি থাকে। সাইড এফেক্টের সম্ভাবনাও প্রবল। সে ক্ষেত্রে বিশুদ্ধ ভারতীয় মতে যোগাভ্যাস করে দেখা যেতে পারে। অনেকে হয়তো ভুলে যেতে পারেন যে, ৩৭৭ ধারা সংক্রান্ত রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ ফাইল করে রামদেব বাবা জানিয়েছিলেন, ‘সমকামিতা জন্মগত রোগ বই কিছু না। তাই আরও নানা এ রকম রোগের মতোই যোগে এই রোগ বিয়োগ সম্ভব, মানসিক ভাবে বিকারগ্রস্ত লোকেরাই সমলিঙ্গের সঙ্গে সম্পর্কে লিপ্ত হয়।’ রামদেব বাবাকে নাকি চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন মহেন্দ্র গোহিল নামে এক রাজপরিবারের সন্তান (গে বলে তিনি নিজেকে জাহির করার পর যদিও রাজবাড়ি থেকে বিতাড়িত)। তাঁর বক্তব্য, তিনি দশ বছর ধরে নিয়মিত ভাবে ওই সকল যোগাভ্যাস করার পরও যেমন গে তেমনই থেকে গেছেন, বিন্দুমাত্র সোজা হননি। তবে মামলার ফল যাই হোক, আসল কথা হল, অবিশ্বাসী মন নিয়ে কোনও কাজ করলেই ঠিকঠাক ফল হয় না, মনের অসুখের বেলা তো আরওই না।
ওষুধ আর যোগাভ্যাসের সঙ্গে পড়তে থাকুন বই। যেমন ধরুন, পুরুষ সমকামিতা সারানোর জন্য জো ডালাস প্রণীত ‘ডিজায়ার্স ইন কনফ্লিক্ট’ ও লেসবিয়ানত্ব কাটাতে অ্যানা পোলক-এর ‘রেস্টোরিং সেকশুয়াল আইডেন্টিটি’। আর প্রিভেনশন কিয়োর হতে বেটার, সুবিদিত এই আপ্তবাক্য স্মরণে রেখে উঠতি বয়সের সন্তানের পিতামাতার জন্য অবশ্যপাঠ্য বই হল নার্থ (ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর রিসার্চ অ্যান্ড থেরাপি অব হোমোসেকশুয়ালিটি)-এর নিকোলসি দম্পতি প্রণীত ‘আ পেরেন্টস্ গাইড টু প্রিভেন্টিং হোমোসেকশুয়ালিটি’।
কিনতে গিয়ে দেখবেন, নানা সাইট ভরে রয়েছে এই ধরনের রিভিউ-তে: ব্লার্বে বলা আছে, বইটি ‘ক্লিনিকাল এক্সপিরিয়েন্স ও প্রফেশনাল রিসার্চের ভিত্তিতে লেখা’। অথচ আদৌ তা না, এটা লেখকের কোনও রকম ভিত্তিহীন নিজস্ব মতামত মাত্র, যা একটি গোষ্ঠীর বিশেষ প্রোপাগান্ডা। মনোচিকিৎসক ও গবেষকদের সঙ্গে এই মত মেলে না। এমনকী এ রকম বেশ কিছু বই উইথড্র করাও শুরু হয়েছে!’ পড়ে ঘাবড়াবেন না। সব পাঠক সমালোচককে সন্তুষ্ট করতে সক্ষম হওয়া বই বুদ্ধের বলা কোনও মৃত্যুস্পর্শহীন বাড়ির সরষেদানার মতোই বিরল!
এ ছাড়াও সমকামিতা সারানোর জন্য আছে নানাবিধ ‘থেরাপি’। তার একটি হল রিপারেটিভ থেরাপি। নার্থ, রিলিজিয়াস টলারেন্স, এক্স-গে-র মতো প্রাক্তন গে-দের তৈরি সংস্থা বহু দিন ধরে সমকামিতা সারানো নিয়ে গবেষণা, কাউন্সেলিং করে আসছেন। রিপারেটিভ ও অ্যাফার্মেটিভ থেরাপিতে উৎসাহ দিচ্ছেন এঁদের মনোবিজ্ঞানীরা। অর্থাৎ, বিষমকামিতাকে ভাল লাগানোর চেষ্টা। কিন্তু এ নিয়েও নিন্দুকের দল সরব। সমকামিতা একটি মানসিক অসুখ, শোনামাত্র ঝাঁপিয়ে পড়বেন এঁরা। বলবেন, এ সবই নাকি সাজানো, চক্রান্ত, অপপ্রচার! আমেরিকান সাইকায়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশন নাকি ১৯৭৩-এই এই মর্মে রায় দিয়ে দিয়েছেন আর লগে লগে আমাদের ভারতীয় সাইকায়াট্রিক অ্যাসোসিয়েশনও নাকি একই কথা বলেছেন, টেবিল চাপড়ে দেখিয়ে দেবেন সব তথ্য-প্রমাণাদি। প্রফেসর রবার্ট স্পিৎজারের (যিনি, খুব আশ্চর্যজনক ভাবে, সেই ১৯৭৩-এ সমকামিতা অসুখ নয়, এই নিয়ে আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন!) যে পেপারটিতে বলা হয়েছিল, এই রিপারেটিভ থেরাপিতে কাজ হবার সম্ভাবনা আছে, এবং নিন্দুকরা বলতেন, সেটিই নাকি সবেধন নীলমণি, একমাত্র প্রামাণ্য জার্নালের পেপার ছিল, আর সমকামিতা- সারানেওয়ালারা কুমিরছানার মতো নাকি কেবল ওটিকেই কোট করে চলতেন, সেই স্পিৎজারও কিনা শেষে মীরজাফর হলেন! ওই পেপার ভুল ছিল বলে এখন নিজেই রিট্র্যাক্ট করতে চেয়েছেন। বলেছেন, এই থেরাপিতে কাজ হয়, এমন কথা ওই স্টাডি দিয়ে আদৌ বলা যায় না!
পাত্তা দেবেন না। বুড়ো বয়সে ভীমরতি ধরেছে!
সমকামিতা সারানোর দ্বিতীয় ও মোক্ষম থেরাপিটির নাম হল অ্যাভার্শন থেরাপি, যা প্রয়োগ করা হয় একেবারে বেঁকে যাওয়া কেসে। আর কেস যেহেতু বাঁকা তাই ওরিয়েন্টেশন স্ট্রেট করতে আপনাকেও একটু আঙুল যে বেঁকাতে হবে। পুরুষকে নগ্ন পুরুষের ছবি দেখানো হবে, আর তার সঙ্গে সঙ্গে ইলেকট্রিক শক বা অনুরূপ কড়া ওষুধ। অর্থাৎ সেই সমলিঙ্গ-কামনার সঙ্গে অ্যাসোসিয়েট করে দিতে হবে অত্যন্ত অপ্রীতিকর একটি অনুভূতি। তো, এই নিয়ে কানে আসবে যে, এটি নাকি অত্যন্ত ক্ষতিকর!
এই ‘অস্বাভাবিকতা’ কাটাতে গিয়ে কেউ নাকি আর কখনও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি, কেউ করেছেন আত্মহত্যাও। শুধু নেটের আর্টিক্লপত্তরে রক্ষা নেই, আছে ইউ টিউব দোসর। কোন সময় উটার কোন ইউনিভার্সিটিতে ছাত্ররা গে হলেই ধরে ধরে বাধ্যতামূলক ভাবে অ্যাভার্শন থেরাপি করা হত, সে সব গ্রাফিক বর্ণনা সমেত ইন্টারভিউ এমন ভাবে দেওয়া যে দেখলে এ সব থেরাপির প্রতি আপনারও অ্যাভার্শন চলে আসতে পারে! এই সব থেরাপি করতে গিয়ে যাঁরা যাঁরা আত্মহত্যা করতে বসেছিলেন, তাঁদের অ্যাকাউন্ট নিয়ে অবধি এরা ভিডিয়ো বানিয়ে রেখেছে! এ সব নেগেটিভ কথাবার্তা অন্য কান দিয়ে বের করে দেবেন। দেখালে চোখ বন্ধ করে রাখবেন।
এই হল সমকামিতা সারানোর একটি মোটামুটি কম্প্রিহেনসিভ টু-ডু লিস্ট, কেবলমাত্র সমকামী সন্তানের নয়, যে কোনও এক্সিস্টিং বা উড বি পিতামাতাই এই লেখা পড়তে পারেন। তবে ওই আর কী! এ সবে কিছু করার সুযোগ সুবিধে না হলে তেমন চিন্তা করবেন না। একটি সর্বরোগহর ট্রায়েড অ্যান্ড টেস্টেড এজ ওল্ড মোক্ষম দাওয়াই থাকতে। বিবাহ। একটা বিয়ে দিয়ে দিলে আর বাচ্চাকাচ্চা হলেই সব ঠিক হয়ে যায়। এই অসুখ সারাতে উদগ্রীব সকলের জন্য রইল শুভেচ্ছা বার্তা, গেট ওয়েল সুন। |
|
|
|
|
|