পঞ্চায়েত ভোটের সামনে দাঁড়িয়ে সিপিএম নিয়ন্ত্রিত দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা পরিষদ উন্নয়নের মনগড়া খতিয়ান তৈরি করেছে। এই অভিযোগ কেবল বিরোধী দলের নয়, রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরের অফিসারদের একাংশও তাই বলছেন। কারণ, গ্রামোন্নয়ন দফতরে গত বছর যে ‘স্বমূল্যায়ন রিপোর্ট’ পৌঁছেছে তাতে নানা অসঙ্গতি ধরা পড়েছে।
যেমন, প্রতি বছরের প্রকল্প ভিত্তিক আয়-ব্যয়ের স্পষ্ট হিসেব দিতে পারছে না জেলা পরিষদ। নারী ও শিশু কল্যাণ, বন ও ভূমিসংস্কার, খাদ্য সরবরাহ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ স্থায়ী সমিতিগুলির বাজেট তৈরি হলেও বরাদ্দ টাকা মেলেনি। ফলে, ওই স্থায়ী সমিতিগুলির কোনও কাজই ছিল না বলেও অভিযোগ রয়েছে। অথচ জেলা পরিষদের দেওয়া খতিয়ানে স্থায়ী সমিতিগুলির কাজকর্ম ‘ঠিক আছে’ বলে উল্লেখ রয়েছে। আগাগোড়াই নিজেদের ‘ভাল’ নম্বর দিয়েছেন জেলা পরিষদের কর্তারা।
তৃণমূলের বিদায়ী বিরোধী সদস্য অখিল বর্মনের অভিযোগ, “ইন্দিরা আবাস, পিছিয়ে-পড়া ও আদিবাসী এলাকার উন্নয়ন, রাস্তা তৈরি, পানীয় জল এবং সেচ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের কাজ নিয়ে যে সব তথ্য-পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে তাতে জল মেশানো রয়েছে। |
গ্রামে গিয়ে মানুষের সঙ্গে কথা বললেই বোঝা যায়, গত ৫ বছরে বলার মতো কাজ করতে পারেনি জেলা পরিষদ। সে জন্য ভুয়ো তথ্য দিয়ে খতিয়ান বানিয়েছে।” জেলা পরিষদের বিদায়ী সভাধিপতি সিপিএম নেত্রী মাগদালিনা মুর্মু বলেন, “প্রতিটি মিটিং-এ বিরোধী সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। জেলার আধিকারিকদের পরামর্শ নিয়েই কাজ হয়েছে। এখন ভোটের মুখে রাজনীতি করতে এ সব বলা হচ্ছে। খতিয়ান ঠিকই আছে।” জেলা পরিষদের অতিরিক্ত কার্যনির্বাহী আধিকারিক তাপস বাগচী জল-মেশানো রিপোর্ট তৈরির দায় এড়িয়ে গিয়েছেন। তিনি বলেন, “স্বমূল্যায়ন থেকে হিসেব দেওয়া, এই পুরো বিষয়টিই জেলা পরিষদের হেড ক্লার্ক ও কর্মীরা তৈরি করেন। আমরা শুধু সই করি।”
আসল চিত্রটা কী? তার খানিকটা ধরা পড়ছে গ্রাম পঞ্চায়েত দফতরের ওয়েবসাইটে দেওয়া জেলার বার্ষিক খরচের খতিয়ানে। তাতে দেখা যাচ্ছে, পশ্চাৎপদ এলাকা উন্নয়নের জন্য পাওয়া প্রায় ৯ কোটি টাকার অর্ধেকেরও বেশি খরচ না হয়ে পড়ে রয়েছে। সীমান্ত এলাকা উন্নয়ন প্রকল্পের ৯.৫ কোটি টাকা থেকে পড়ে রয়েছে সাড়ে চার কোটি টাকা। গরিবের বাড়ি তৈরির ‘আশ্রয়’ প্রকল্পের প্রায় পুরো টাকাটাই পড়ে রয়েছে। তফশিলি জাতি ও জনজাতির উন্নয়নের জন্য বরাদ্দের এক টাকাও খরচ হয়নি।
তৃণমূল বিধায়ক বিপ্লব মিত্রের অভিযোগ, “নানা প্রকল্পের টাকা অযথা ফেলে রেখে মনগড়া তথ্য-পরিসংখ্যান তৈরি করে রাজ্য সরকারকে জমা দেওয়া হয়েছে।” নিজের অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়ে বিপ্লববাবু বলেন, “ফি বছর জেলায় বন্যা হয়। পাঁচ বছরে নদী ভাঙনের জন্য বাজেটে বরাদ্দ দেখিনি। জেলা পরিষদের সাধারণ সভায় বিষয়টি তুলেছিলাম। গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ।”
বিরোধীদের মতো, টাকা খরচের ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ শরিক আরএসপি-ও। নারী ও শিশু কল্যাণের মতো স্থায়ী সমিতিগুলির আর্থিক বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাবে সাধারণ সভায় আরএসপির কর্মাধ্যক্ষরাও সরব ছিলেন। বামফ্রন্ট সূত্রের খবর, খাদ্য ও সরবরাহ স্থায়ী সমিতির আরএসপির কর্মাধ্যক্ষ নিতাই বসাক কিংবা মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ স্থায়ী সমিতির আরএসপির কর্মাধ্যক্ষ নন্দদুলাল ঘোষেরাও ঘনিষ্ঠ মহলে বরাদ্দ না-বাড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন।
হিলির আরএসপি নেতা তথা বিদায়ী কর্মাধ্যক্ষ নিতাইবাবু বলেন, “সংশ্লিষ্ট দফতরগুলিতে সরকারের মাধ্যমে সরাসরি অর্থ বরাদ্দ হয়। সে সব সরকারি দফতর কাজ করে থাকে। তাই বাজেটে স্থায়ী সমিতিগুলির বরাদ্দ কম বলে উল্লেখ করেছিলাম।” তবে পরিষদের গত বছরের তথ্য বলছে, মৎস্য স্থায়ী সমিতিকে মাছ চাষের উন্নয়নে বরাদ্দ ১৪ লক্ষ টাকা খরচই হয়নি। জেলা পরিষদের দায়িত্বে থাকা রাস্তার কত শতাংশে সারাই ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন, তার তথ্য পরিষদ দিতে পারেনি।
অনেক ক্ষেত্রে টাকা পেয়েও তা খরচ করতে পারেনি জেলা পরিষদ। যেমন, স্বজলধারা প্রকল্পে ২২ কোটি টাকা ব্যাঙ্কে পড়ে রয়েছে। সাংসদ তহবিলের ৭ কোটি টাকা, ক্ষুদ্র সেচে বরাদ্দ প্রায় ৩ কোটি টাকা, প্রথা বহির্ভূত শিক্ষা খাতে বরাদ্দ ৩০ লক্ষ টাকা, এবং সর্বশিক্ষা অভিযানে ১ কোটি ২৪ লক্ষ টাকা খরচ করতে পারেনি। জেলা পর্যায়ের তদারকি ও নজরদারি কমিটির বৈঠকও নিয়মিত হয় না। কয়েক মাস আগে ওই কমিটির বৈঠক একবার হয়। সেখানে ধরা পড়ে, ইন্দিরা আবাস যোজনার কাড ঢিমেতালে চলছে। প্রধানমন্ত্রী সড়ক যোজনার কাজের হালও ভাল নয়। ওই কাজ দ্রুত করানোর জজন্য জেলা পরিষদকে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দেয় কমিটি। তাতে অবশ্য হাল ফেরেনি কর্মসংস্কৃতির। তাই রাজ্যের পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতরে গত অর্থবর্ষে কাজের স্বমূল্যায়ন প্রতিবেদনে জেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষকে কবুল করতে হয়, ‘বলার মতো সাফল্য কিছু নেই। আবার বলার মতো ব্যর্থতাও নেই।’ |
খরচের খতিয়ান
|
কিছু প্রকল্প যাতে বরাদ্দের এক টাকাও গত অর্থবর্ষে খরচ হয়নি |
• কৃষি পরিকাঠামো উন্নয়ন (৩ লক্ষ)
• বিএমএস- খরা (২১ লক্ষ)
• তফসিলি জাতি ও উপজাতির মানুষের জন্য পরিকাঠামো উন্নয়ন (৬ লক্ষ)
• ক্ষুদ্র সেচ (৩ লক্ষ)
• সেচ ও বন্যা রোধ প্রকল্প (১ লক্ষ)
• সাংসদের উন্নয়ন তহবিল (২১ লক্ষ) |
কয়েকটি প্রধান প্রকল্পে যত খরচ হয়েছে |
প্রকল্প |
হাতে মোট টাকা |
পড়ে আছে |
খরচ হয়েছে (%) |
আশ্রয় |
১.৬৮ কোটি |
১.৬৬ কোটি |
০.৯৪ |
বিধায়কের এলাকা উন্নয়ন তহবিল |
৪১ লক্ষ |
৩৪ লক্ষ |
১৫.০১ |
পশুকল্যাণ |
২৪ লক্ষ |
২০ লক্ষ |
১৫.২১ |
পশ্চাৎপদ এলাকা উন্নয়ন তহবিল (বিআরজিএফ) |
৮.৯৩ কোটি |
৪.৮২ কোটি |
৪৬.০৫ |
জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন |
১.৭৯ কোটি |
৯৩ লক্ষ |
৪৮.১০ |
টোটাল স্যানিটেশন ক্যাম্পেন |
২৮.৮৮ কোটি |
১১.৯৭ কোটি |
৫৮.৫৬ |
সীমান্ত এলাকা উন্নয়ন প্রকল্প |
৯.৫০ কোটি |
৪.৬৩ কোটি |
৬৫.০৭ |
উদ্যানপালন ও কৃষিপণ্য |
১৩.২৪ কোটি |
৪২ লক্ষ |
৭২.১২ |
সাংসদের উন্নয়ন তহবিল অবনী রায় |
৮ লক্ষ |
১ লক্ষ |
৮৬.০৪ |
স্বজলধারা
|
২.৩২ কোটি |
২৮ লক্ষ |
৮৭.৮৩ |
ইন্দিরা আবাস যোজনা |
১৬.২৪ কোটি |
২২ লক্ষ |
৯৮.৬৪ |
উদ্বাস্তু ত্রাণ ও পুনর্বাসন |
৩২ লক্ষ |
০ |
১০০ |
ক্রীড়া ও যুব |
৩ লক্ষ |
০ |
১০০ |
সম্পূর্ণ গ্রামীণ রোজগার যোজনা |
১৮ লক্ষ |
০ |
১০০ |
|
উন্নয়ন হয়নি। ইন্দিরা আবাস ঘর অসম্পূর্ণ হয়ে রয়েছে।
বিপুল বর্মন, শ্রমিক |
বিদ্যুতের কাজ হয়েছে। তবে রাস্তার কাজ হয়নি। আনন্দ মোহান্ত, চাষি |
পুরো টাকা পাইনি। সাত মাস অর্ধেক ঘর তৈরি হয়ে পড়ে রয়েছে। একাধিকবার ব্লক অফিসে ঘুরেও কাজ হয়নি। পলি মালাকার, বধূ |
|
|