জেলায় মোট ৯৮টি গ্রাম পঞ্চায়েত। অন্তত ৩৫টি গ্রামে সুষ্ঠু পানীয় জলের বন্দোবস্ত আজও হয়নি। খালবিল-পুকুর-নদীর জলই ভরসা গ্রামবাসীদের। এ হেন জলকষ্ট যেখানে রয়েছে, সেই উত্তর দিনাজপুরে পানীয় জল প্রকল্পের জন্য কেন্দ্রের বরাদ্দ থেকে ৬৮ লক্ষ টাকা খরচ হয়নি দু’বছরেও। বিহার-লাগোয়া উত্তর দিনাজপুরের প্রত্যন্ত এলাকার দিনমজুর সুনীল রায়, বৃন্দাবন দাস, শেখ রফিকুলদের আক্ষেপ, ফি বছর পঞ্চায়েতের অফিসে গিয়ে ধর্না দিয়েও কোনও লাভ হয়নি।
ইসলমাপুর মহকুমার বিস্তীর্ণ এলাকার রাস্তাঘাটেরও ভগ্নদশা। বেশ কয়েকটি রাস্তায় প্রাণ হাতে করে যাতায়াত করতে হয়। অথচ জেলা পরিষদের অধীনে কত রাস্তা রয়েছে, তার তালিকা নেই। কত রাস্তা সারানো প্রয়োজন, জেলা পরিষদের কাছে নেই সেই তথ্যও। অথচ প্রতি বছর ‘স্বমূল্যায়ন প্রতিবেদন’-এ এই প্রশ্নগুলির উত্তর দাবি করা হয়। |
হেমতাবাদের শেরপুর-বাঘরোল রাস্তায় কুলিকের উপরে নবনির্মিত সেতু। |
মানব উন্নয়নের নিরিখে রাজ্যে ১৮টি জেলার মধ্যে সবার শেষে রয়েছে উত্তর দিনাজপুর। অথচ পঞ্চায়েত দফতরেরই হিসেবে দেখা যাচ্ছে, গত তিন বছর জেলা পরিষদের মোট বরাদ্দের ২৫-৩০ শতাংশ পড়েই থাকছে। কেন এমন হচ্ছে? জেলা পরিষদের বিদায়ী বিরোধী দলনেতা তথা সিপিএমের জেলা সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য মনোরঞ্জন দাস তার দায় চাপিয়েছেন কংগ্রেস-পরিচালিত জেলা পরিষদের উপর। তিনি বলেন, “জেলায় ৯৮টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ৩০টিরও বেশিতে যেখানে পানীয় জলের সঙ্কট রয়েছে, সেখানে কেন পানীয় জল সরবরাহ প্রকল্পের টাকা খরচ করা সম্ভব হল না?” জেলা তৃণমূল সভাপতি তথা ইটাহারের বিধায়ক অমল আচার্যও বলেন, “ইটাহারের ১০টিরও বেশি গ্রাম পঞ্চায়েতে গরমের শুরুতেই জলের সঙ্কট দেখা দেয়। ইসলামপুর মহকুমার চাকুলিয়া, গোয়ালপোখর, চোপড়া এলাকার জেলা পরিষদের রাস্তাগুলি বেহাল। টাকা পড়ে থাকতেও জেলা পরিষদ পঞ্চায়েত এলাকায় জলের পরিষেবার উন্নয়ন করতে পারেনি। এমন নানা ব্যর্থতার দায়ে কংগ্রেসকে মানুষ ছুঁড়ে ফেলে দেবেন।”
জেলা পরিষদের কংগ্রেসের বিদায়ী সভাধিপতি মোক্তার আলি সর্দার বিরোধীদের অভিযোগ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করেছেন। তাঁর যুক্তি, “২০১২-১৩ আর্থিক বছরের একেবারে শেষের দিকে পানীয় জল সরবরাহ প্রকল্পের ৬৩ লক্ষ টাকা হাতে পায় জেলা পরিষদ। সে জন্য টাকা খরচ করা সম্ভব হয়নি।” জেলা পরিষদের ২০১২-১৩ সালের হিসেব অবশ্য দেখাচ্ছে, ওই বছর ‘রুরাল ওয়াটার সাপ্লাই’ খাতে আসা ৬৮ লক্ষ ২২ হাজার টাকা গোটা বছরই খরচ না হয়ে পড়ে রয়েছে।
সভাধিপতির দাবি, গত পাঁচ বছরে কেন্দ্র ও রাজ্যের প্রায় ১৫০টি উন্নয়নমূলক প্রকল্পে জেলা পরিষদ কয়েকশো কোটি টাকা খরচ করেছে জেলা পরিষদ। বিএডিপি, আরআইডিএফ সহ কেন্দ্র ও রাজ্যের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পে ১০০ কোটিরও বেশি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। জেলা জুড়ে কয়েকশো অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্র, সেতু, রাস্তা, ইন্দিরা আবাস তৈরি, স্বাস্থ্য পরিষেবার উন্নয়ন, এবং ১০৩৭টি মৌজায় বিদ্যুৎ পৌঁছনো সম্ভব হয়েছে।
তবে কংগ্রেসের দখলে-থাকা বিন্দোল গ্রাম পঞ্চায়েতের বিদায়ী উপপ্রধান মনসুর আলির মতো অনেকেই কিন্তু অন্য কথা বলছেন। যেমন মনসুরবাবু বলেন, “আমাদের গ্রাম পঞ্চায়েতে নলকূপের অভাব রয়েছে। ফি বছর গরম পড়তেই পানীয় জলের তীব্র সঙ্কট দেখা দেয়। পঞ্চায়েতের তরফে জেলা পরিষদের কাছে গত পাঁচ বছর ধরে বহু বার পানীয় জলের পরিষেবা ও রাস্তাঘাটের উন্নয়ন জানিয়েছি। কোনও লাভ হয়নি।”
সাতটি পঞ্চায়েত ভোট পার করেও যে তেষ্টার জলটুকু মিটছে না, সেটাই রাজ্যের সব চাইতে অনুন্নত জেলায় পঞ্চায়েতি ব্যবস্থার হাল বুঝিয়ে দেয়। |
খরচের খতিয়ান
|
কিছু প্রকল্প যাতে বরাদ্দের এক টাকাও গত অর্থবর্ষে খরচ হয়নি |
• গ্রামীণ জল সরবরাহ (৬৮ লক্ষ)
• কমিউনিটি গ্রন্থাগার তথ্যকেন্দ্র (২ লক্ষ)
• নিয়ন্ত্রিত বাজার গঠন (৭ লক্ষ) • সাংসদের উন্নয়ন তহবিল (২ লক্ষ) |
কয়েকটি প্রধান প্রকল্পে যত খরচ হয়েছে |
প্রকল্প |
হাতে মোট টাকা |
পড়ে আছে |
খরচ হয়েছে (%) |
স্বর্ণজয়ন্তী গ্রাম স্বরোজগার যোজনা- পরিকাঠামো উন্নয়ন |
২১ লক্ষ |
১৮ লক্ষ |
১২.৯২ |
খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ ও উদ্যানপালন |
৯৩ লক্ষ |
৭৫ লক্ষ |
১৯.৩৩ |
স্বজলধারা |
২.৩৯ কোটি |
১.৮৬ কোটি |
২১.৮৭ |
জন স্বাস্থ্য কেন্দ্র |
৫৬ লক্ষ |
৪২ লক্ষ |
২৫.২২ |
গ্রামস্তরের রেকর্ড রুম |
২৯ লক্ষ |
২২ লক্ষ |
২৫.২৭ |
টোটাল স্যানিটেশন ক্যাম্পেন |
২৮.৮৩ কোটি |
১৭.৫৩ কোটি |
৩৯.১৯ |
রাজ্য গ্রামোন্নয়ন |
৩.৮৫ কোটি |
২.৩৩ কোটি |
৩৯.৪৪ |
আশ্রয় |
২.৩৯ কোটি |
১.২৭ কোটি |
৪৬.৯১ |
ত্রাণ তহবিল |
১৬ লক্ষ |
৭ লক্ষ |
৫৫.৯৯ |
পশ্চাৎপদ গ্রাম তহবিল |
৬.৩৫ কোটি |
২.৫৭ কোটি |
৫৯.৬০ |
পশ্চাৎপদ এলাকা উন্নয়ন তহবিল (বিআরজিএফ) |
৩.৯৬ কোটি |
১.৪৮ কোটি |
৬২.৬৬ |
সীমান্ত এলাকা উন্নয়ন প্রকল্প |
১৪.৬৭ কোটি |
৩.২৬ কোটি |
৭৭.৭৮ |
রাষ্ট্রীয় সমবিকাশ যোজনা |
২৩ লক্ষ |
৫ লক্ষ |
৭৮.৯০ |
পশুকল্যাণ |
৩৫ লক্ষ |
৪ লক্ষ |
৮৭.৭৭ |
ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প |
১৫ লক্ষ |
১ লক্ষ |
৯০.৯৪ |
সড়ক পরিবহণ অনুদান |
৩৬ লক্ষ |
০.৫৫ লক্ষ |
৯৮.৪৪ |
সংখ্যালঘু প্রশাসনিক ভবন |
৩৯ লক্ষ |
০.১৯ লক্ষ |
৯৯.৫১ |
ইন্দিরা আবাস যোজনা |
২২.২০ কোটি |
৬ লক্ষ |
৯৯.৭৪ |
|
প্রায় ৮ কিমি রাস্তা বেহাল। জলের ব্যবস্থা না হওয়ায় সারা বছর পেটের রোগ হচ্ছে শিশুদের। জেলা পরিষদের আরও সক্রিয় হওয়া উচিত ছিল।
দীননাথ দাস, চাকরিজীবী |
জেলা সদর লাগোয়া পঞ্চায়েত এলাকার রাস্তাঘাট দেখলে কষ্ট হয়। বর্ষায় গর্ত হয়ে রাস্তায় চলা যায় না। তা হলে কাজের কাজ হল কোথায়?
চন্দন সরকার, গ্রামবাসী |
শেরপুরে থাকি। একটা নতুন সেতু হয়েছে। কিন্তু, রাজ্য সড়কে চলাচল করা যায় না। কত বার আবেদন করেও এলাকায় উপ স্বাস্থ্যকেন্দ্র হয়নি। সালমা আখতার বানু, ছাত্রী |
|
|