দৃশ্য এক-রিকশায় শরীর এলিয়ে বসে রয়েছেন ময়নাগুড়ির আনন্দপাড়ার বাসিন্দা মন্তে দেবনাথ। তাঁর হাতের শিরায় গাঁথা স্যালাইনের নল। স্যালাইয়ের বোতল ধরে রয়েছেন তাঁর আত্মীয়া প্রতিমা দেবনাথ। সামনে প্রায় কোমর সমান জল। সেই জল পার হয়ে রিকশা উল্টে যওয়ার আশঙ্কায় চালক যেতে চাইছেন না। আশেপাশে দু-একটা অ্যাম্বুল্যান্স দাঁড়িয়ে থাকলেও জলের জন্য চলছে না। মুখ দিয়ে রক্তপাত শুরু হওয়ায় শুক্রবার বিকালে ময়নাগুড়ি হাসপাতাল থেকে রেফার করে দেওয়ার পরে বাসে চাপিয়ে জলপাইগুড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে মন্তে দেবনাথকে। জলপাইগুড়ি সদর হাসপাতালের প্রায় ৬০০ মিটার দূরে রিকশায় বসে তখন শারীরিক যন্ত্রনায় কাঁতরাচ্ছেন মন্তেদেবী।
দৃশ্য দুই, হাসপাতালের চিকিৎসকের লিখে দেওয়া ওষুধের প্রেসক্রিপশন নিয়ে প্রায় ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করেছেন চাউলহাটির বাসিন্দা বিমল রায়। ছেলে অসীম পেটের রোগে হাসপাতালে ভর্তি। যন্ত্রনা উপশমের জন্য চিকিৎসকের ওষুধ নিতে বাইরে যাবেন। কিন্তু জলের জন্য উপায় নেই। সকালে একবার সিভিল ডিফেন্সের নৌকা করে হাসপাতালের বাইরের ওষুধের দোকানে গিয়েছেন। সন্ধ্যার পরে সিভিল ডিফেন্সের বোট চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছে। হেঁটেই রওনা দিয়েছিলেন তিনি। অন্ধকারে জল পাড় হয়ে যেতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে জামা-প্যান্ট চুপচুপে। কোনওক্রমে ওষুধ নিয়ে এসেছেন। যদিও প্রেসক্রিপশন ছিঁড়ে গিয়েছে। |
জল থইথই জলপাইগুড়ি হাসপাতাল চত্বর। শুক্রবার তোলা নিজস্ব চিত্র। |
জলের ঠেলায় জলপাইগুড়ি হাসপাতালের ভিতরে এবং বাইরে শুক্রবার সন্ধ্যার পর থেকে শুধুই দুর্ভোগের ছবি দেখা গেল। সদর হাসপাতালের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে করলা নদী। হাসপাতালের ওয়ার্ডে জল না ঢুকলেও করলা নদী উপচে বিছিন্ন করে দিয়েছে জলপাইগুডি সদর হাসপাতালকে। একপাশে রায়কতপাড়া থেকে শুরু করে পিছনে সেনপাড়া, হাকিমপাড়া জলমগ্ন। হাসপাতালে ঢোকার রাস্তায় কোথাও হাঁটু সমান জল, কোথাও আবার কোমরের উপরে জল বইছে। ইঞ্জিনে জল ঢুকে পড়ছে বলে অ্যাম্বুল্যান্স বা ছোট গাড়ি হাসপাতাল থেকে প্রায় ৬০০ মিটার দূর থকে ঘুরে যাচ্ছে। জলের তোড়ে রিকশাও চালানো সম্ভব হচ্ছে না। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পযর্ন্ত সিভিল ডিফেন্সের একটি নৌকা এবং বিএসএফের ট্রাক রোগী এবং চিকিৎসক, কর্মীদের হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়ার কাজ করলেও, সন্ধ্যার পর সিভিল ডিফেন্সের নৌকা তুলে নেওয়া হয়েছে।
মাটির নিচ দিয়ে বিদ্যুতের তার নিয়ে যাওয়ায় দুপুরের পর বিদ্যুত সংযোগও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সকাল থেকেই জেনারটের দিয়ে কাজ চলেছে, তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা রাতের পরে জেনারেটর আর কাজ করবে না। বড়ছোট কোনও গাড়িই জল ঠেলে যাতায়াত করতে পারছে না। পরিস্থিতি বুঝে হাসপাতালের চিকিৎসক এবং কর্মীদের রাতে হাসপাতালে থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালের সুপার ব্রজেশ্বর মজুমদার বলেন, “বিএসএফের একটি ট্রাক দিয়ে দুপুরে চিকিৎসক এবং কর্মীদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রাতে ফের সমস্যা হবে। সেই কারণে দুপুরের পর থেকে সব বিভাগে অন্তত দুজন করে চিকিৎসক এবং কর্মীদের হাসপাতালে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।”
চিকিৎসক এবং কর্মীরা থাকলেও বিপাকে পড়েছেন রোগী এবং তাঁদের পরিবারের সদস্যরা। অ্যাম্বুল্যান্স বা ছোট গাড়ি না চলায় সন্ধ্যার পরে হাসপাতালে ঢুকতেই দুর্ভোগে পড়েছেন রোগীরা। মাথার যন্ত্রণায় বেরুবাড়ি থেকে অ্যাম্বুল্যান্সে নিয়ে আসা হয়েছে পলেন রায়কে। হাকিমপাড়া এলাকার পরে তা না ঢোকায় পরিজনেরা পলেনবাবুকে জল ডিঙিয়ে পাজাকোলা করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছেন। পলেনবাবুর ভাগ্নে তপন দত্তের কথায়, “কী ভাবে হাসপাতালে ঢুকতে হয়েছে আমরাই শুধু জানি। রোগীদের পারাপারের জন্য প্রশাসন কোনও ব্যবস্থা না নেওয়ায় আমরা হতবাক।” সন্ধ্যায় হাসপাতালে গিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েন পুরসভার চেয়ারম্যান মোহন বসু। তিনি বলেন, “সন্ধ্যার পরে কেন হাসপাতালে যাওয়ার নৌকা তুলে নেওয়া হল জানি না।” রাতে জেলাশাসক স্মারকী মহাপাত্রের সঙ্গে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যোগাযোগ করেন। জেলাশাসকের হস্তক্ষেপে রাতের দিকে ফের বোট পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। জেলাশাসক বলেন, “নৌকা পাঠানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বিএসএফকেও একটি ট্রাক পাঠাতে বলা হয়েছে।” |