“আমি তোমার মেয়ে। আমি তোমার সম্পদ।”
মলিন হয়ে আসলেও কুশুম্বা হাইস্কুলের ঠিক পাশে রামপুরহাট ১ ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে টাঙানো সরকারি হোর্ডিংয়ের লেখাগুলি আজও জ্বলজ্বল করছে। আর হোর্ডিংটি যে বাড়িটির দিকে আড়াআড়ি ভাবে দাঁড় করানো হয়েছে, সেই প্লাস্টারহীন দোতলা বাড়িটিই রাজ্যের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রীর আঁতুড়ঘর। এই কুশুম্বাতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মামাবাড়ি। আর বীরভূমের প্রতি তাঁর বিশেষ টানের কথা মুখ্যমন্ত্রী নানা সময়ে বারবারই স্মরণ করিয়ে দেন। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে তিনি একাধিক বার এখানে এসে বীরভূমের জন্য বহু প্রকল্পের ঘোষণাও করেছেন।
আর সেই প্রকল্পগুলিকেই জেলায় পঞ্চায়েত ভোটের প্রচারে পাখির চোখ করেছে জেলার তৃণমূল নেতৃত্ব। সম্প্রতি মঞ্চে দাঁড়িয়ে পুস্তিকা ধরে ধরে জেলার উন্নয়নের খতিয়ানও তুলে ধরেছেন তৃণমূলের জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলও। অন্য দাবিগুলির পাশাপাশি নেতাদের মুখে ঘুরেফিরেই আসছে জেলার স্বাস্থ্য পরিষেবায় পরিবর্তন ঘটিয়ে ফেলার কথা। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা এতদিনে ঠিক কতটা কার্যকর হয়েছে? জেলা প্রশাসনের হিসেবেই বলছে বাস্তবের সঙ্গে তার অমিল অনেকটাই। শুধুমাত্র যদি স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়েই বিচার করা হয়, তাহলে ঘোষণা অনুযায়ী বাস্তবের ফারাকটা খুব সহজেই ধরা পড়বে।
দায়িত্বে আসার ৮ মাসের মধ্যেই অন্য সাতটি মহকুমার সঙ্গেই রামপুরহাটকেও ‘স্বাস্থ্য জেলা’ হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। তখন চিকিৎসকদের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, “দয়া করে একটু গ্রামে যান।” কিন্তু তারপরেও কি এখানে গ্রামীণ এলাকার চিকিৎসা পরিষেবা পাল্টাতে পেরেছে পরিবর্তনের সরকার? ‘স্বাস্থ্য জেলা’ হওয়ার পরেও রামপুরহাট মহকুমার গ্রামীণ হাসপাতালগুলির বাস্তব চিত্রটা কিন্তু খুব একটা আশা যোগাচ্ছে না। এই মহকুমার গ্রামীণ হাসপাতালগুলির মধ্যে সবথেকে দৈন্যদশা মুরারই ১ ব্লকের। রাজ্যের প্রাণিসম্পদ বিকাশ মন্ত্রী নুরে আলম চৌধুরীর বিধায়ক এলাকার মধ্যে পড়া এই ব্লকটির স্বাস্থ্য পরিষেবার চিত্র যথেষ্টই উদ্বেগের।
চিত্র ১: মাত্র ১০ শয্যার হাসপাতাল মুরারই ১ ব্লকের রাজগ্রাম প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। দু’জন চিকিৎসকের সেখানে থাকার কথা। অথচ বিগত ৯ মাস হয়ে গেল ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে একজনও চিকিৎসক নেই। কোনও রকমে মুরারই ১ ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে গত চার মাস ধরে অনিয়মিত ভাবে একজন চিকিৎসককে পাঠিয়ে ‘ম্যানেজ’ করা চলছিল। বর্তমানে সেই ব্যবস্থাও বন্ধ। তাই এখন ভরসা ফার্মাসিস্ট ও নার্সেরাই! অথচ মহুরাপুর, রাজগ্রাম, গোঁড়শা এই তিনটি পঞ্চায়েত এলাকা-সহ পার্শবর্তী মুর্শিদাবাদ জেলা ও লাগোয়া ঝাড়খণ্ডের প্রত্যন্ত গ্রামগুলির একটা বড় অংশের গরিব রোগীদের স্বাস্থ্য পরিষেবার ক্ষেত্রে এই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রই একটি গুরুত্বপূর্ণ ঠিকানা। ব্লকের স্বাস্থ্য আধিকারিক প্রবীর মাণ্ডি জানান, চিকিৎসক থাকলে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রতিদিন ১৫০ জন রোগী আসেন।
চিত্র ২: রাজগ্রামের থেকে খুব একটা আলাদা চিত্র নয় চাতরা প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেরও। প্রায় দু’ বছর ধরে একজনও চিকিৎসক যোগ দেননি।
চিত্র ৩: স্বাস্থ্য আধিকারিককে নিয়ে মুরারই ১ ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মোট ৮ জন চিকিৎসক থাকার কথা। অথচ বিএমওএইচকে নিয়ে আছেন তার অর্ধেক জন। তার উপরে রাজগ্রাম ও চাতরার স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অস্থায়ী ভাবে চিকিৎসক পাঠানোর জন্য চাপ পড়তে। বর্তমানে তা বন্ধ হয়েছে। কিন্তু চাপ তো কমেইনি, বরং এখন রাজগ্রাম ও চাতরা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের রোগীদের চাপও নিতে হচ্ছে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রকেই।
চিত্র ৪: মাস খানেক আগেই ১০ থেকে বেড়ে ৩০ শয্যায় উন্নীত হয়েছে নলহাটি ১ ব্লকের করুমগ্রাম স্বাস্থ্যকেন্দ্র। তাতে হাল কি বদলেছে? গত দেড় মাস ধরে কোনও চিকিৎসক নেই এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও।
চিত্র ৫: কাগজে কলমে ১০ শয্যার বিশিষ্ট স্বাস্থ্যকেন্দ্র রামপুরহাট ২ ব্লকের মাড়গ্রাম প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। এমনকী থাকার কথা প্রসূতি মায়েদের শিশু প্রসবের ব্যবস্থাও। অথচ বাস্তব হল, সেখানে আজও অবধি ঠিকঠাক স্বাস্থ্যপরিষেবা দেওয়ার মতো পরিকাঠামো গড়ে তোলা হয়নি। দু’জন থাকার কথা হলেও মাত্র একজন চিকিৎসকই এখন সেখানে সম্বল।
অন্য দিকে, শহরে অবস্থিত হলেও রামপুরহাট মহকুমা হাসপাতালের রোগীদের সিংহভাগই প্রত্যন্ত গ্রামীণ এলাকা থেকে চিকিৎসা পরিষেবা পেতে আসেন। তাই গুরুত্ব বুঝে এই হাসপাতালকে ‘জেলা হাসপাতাল’ হিসেবে ঘোষণা করেছিল নতুন সরকার। কিন্তু বাস্তব হল, ঘোষণার দেড় বছর পরেও প্রকৃত অর্থে ‘জেলা হাসপাতাল’ হয়ে উঠতে পারেনি। কারণ সেখানে জেলা হাসপাতাল হওয়ার মতো পরিকাঠামোই এখনও গড়ে ওঠেনি। ৫০০টি শয্যা দরকার হলেও আছে ২৮৪। একই সঙ্গে চিকিৎসকের সংখ্যাও প্রায় ২৫ শতাংশ বাড়ানো প্রয়োজন আছে। হাসপাতালে ৫৬ জন চতুর্থ শ্রেণির কর্মী রয়েছেন। অথচ প্রয়োজন প্রায় ২৫০ জন। প্রয়োজন ১২৫ হলেও সেখানে নার্স আছেন ৬৬ জন। আর নার্সের অভাবেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে এই তথাকথিত ‘জেলা হাসপাতালে’র সংক্রামক বিভাগ। বিপদজনক ভাবে সাধারণ ওয়ার্ডের রোগীদের সঙ্গেই সংক্রামক রোগীদের চিকিৎসা চলছে। ‘জেলা হাসপাতাল’ ঘোষণার পরপরেই হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ৪ শয্যার ‘অবজার্ভেশন ওয়ার্ড’ তৈরি হলেও তা আজও চালু হয়নি।
সমস্যাগুলি নিয়ে নিজের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সদ্য যোগ দেওয়া মহকুমা স্বাস্থ্য আধিকারিক প্রসেনজিৎ মজুমদার। তিনি বলেন, “ওই গ্রামীণ হাসপাতালগুলি ঘুরে দেখেছি। সেখানে সত্যিই চিকিৎসক নেই। ওই সব হাসপাতালে যাঁরা নিয়োগ পেয়েছিলেন, তাঁরা কেউ কাজ করতে চান না। এটা খুব দুর্ভাগ্যজনক।” তাঁর দাবি, “ভোটের পরেই আমরা নতুন করে চিকিৎসক নিয়োগের ব্যবস্থা করব। পরিকাঠামোরও উন্নতিসাধন করা হবে।” অন্য তৃণমূলের কোনও নেতাই এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। |