প্রাণহানির নিরিখে দ্বিতীয় দফাকে ছাড়িয়ে গেল তৃতীয় দফা। জয়নগরে সিআইএসএফের গুলিতে এক জন-সহ শুক্রবার রাত পর্যন্ত দুই ২৪ পরগনাতেই মৃত্যু হল পাঁচ জনের। বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনায় বুথ দখল এবং ভোট লুঠের অভিযোগও উঠল। এবং শাসক দলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের সেই সব অভিযোগকে কেন্দ্র করেই এ বার গণ-প্রতিরোধের ডাক দিল রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল সিপিএম। গত লোকসভা ও
বিধানসভা নির্বাচনের আগে মহিলাদের উদ্দেশে ঠিক যে ধরনের আহ্বান জানিয়েছিলেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
কলকাতার লাগোয়া দুই ২৪ পরগনা ও হাওড়া জেলার ভোটকে যথেষ্ট কঠিন বলে মনে করছিল রাজ্য নির্বাচন কমিশনও। শেষ পর্যন্ত প্রাণহানির সংখ্যা ২০০৩ বা ২০০৮-এর মতো না-হলেও এ দিন বেশ কিছু অশান্তির ঘটনা ঘটেছে। তার মধ্যে উত্তর ২৪ পরগনায় আমডাঙায় মারা গিয়েছেন এক জন, যাঁকে নিজেদের সমর্থক বলে দাবি করেছে সিপিএম। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় নিহত দু’জনকে তাদের সমর্থক হিসাবে দাবি করেছে তৃণমূল। সেই বিচারে দেখলে শাসক শিবিরে নিহতের সংখ্যাই ভারী। যে কারণে বিরোধীদের সন্ত্রাসের অভিযোগের জবাবে তাদের পাল্টা অভিযুক্ত করেছে শাসক দল।
হতাহতের হিসাব যা-ই হোক না কেন, সিপিএমের অভিযোগ, সন্ধ্যা পর্যন্ত হাওড়ায় ২৯১, উত্তর ২৪ পরগনায় অন্তত ৩৪০ এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনায় ৪০২টি বুথ দখল করে নিয়েছে শাসক দল। যার পরিপ্রেক্ষিতে বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, “বারেবারেই বলছি, আগুন জ্বালাবেন না! তৃণমূল, কংগ্রেস, বামফ্রন্ট আগুন এ সব আলাদা করে চিনতে পারে না। আগুন লাগলে তার থেকে শাসক দলও রেহাই পাবে না!” পাশাপাশি বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেছেন, “দ্বিতীয় দফার পরে তৃতীয় দফায় যা হয়েছে, তাতে ১৯৭২ সালের উপসর্গ দেখা যাচ্ছে! রাজ্য সরকার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটাকেই ধ্বংস করতে চাইছে। মানুষকে আরও সতর্ক হতে হবে এবং রাজ্য সরকারের অপকর্ম প্রতিরোধে তাঁদেরই এগিয়ে আসতে হবে।” শাসক দলের আক্রমণের মুখে কোণঠাসা হলেও কোনও ভাবেই বাকি দুই পর্বে তাঁদের ময়দান ছেড়ে আসার কোনও প্রশ্ন নেই বলে জানিয়ে বিমানবাবুর আরও মন্তব্য, “মানুষ যাদের ফুল-বেলপাতা দিয়ে নিয়ে এসেছিল, তাদের তো দেখতে হবে! মানুষই দেখবে, তারা ফুল-বেলপাতা দিয়ে পুজো করার যোগ্য কি না!” |
বামেদের অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় অবশ্য দাবি করেছেন, “দু’তিনটি বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটলেও প্রথম দু’দফার পরে এ বারও মানুষ শান্তিপূর্ণ ভাবে তার গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করেছে। এ বারের পঞ্চায়েত ভোট এখনও পর্যন্ত অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভাবে হয়েছে।” বিরোধীদের পাল্টা দুষে তাঁর আরও মন্তব্য, “সন্ত্রাসের কথা বলছে সিপিএম, অথচ খুন হচ্ছে তৃণমূলের লোকেরাই! গত ১৫ জুন থেকে এ পর্যন্ত আমাদের ২১ জন কর্মী খুন হয়েছেন।” তিনি জানান, এ দিন তাঁদের দু’জন সমর্থক নিহত হয়েছেন। আবার গত ১৬ জুন থেকে নিখোঁজ বর্ধমানের আউশগ্রামের বাসিন্দা তৃণমূল সমর্থক অরণ্য কোঙারের মৃতদেহ উদ্ধার হয়েছে রামচন্দ্রপুরে। উত্তর ২৪ পরগনায় তাদের যে সমর্থকের মৃত্যুর কথা সিপিএম বলছে, সেই প্রশ্নে মুকুলবাবুর বক্তব্য, “আমি শুনেছি ওখানে কোনও সংঘর্ষ হয়নি। নিহত ব্যক্তির বোমা তৈরিতে পেশাদারি দক্ষতা ছিল।”
সূর্যবাবুর দাবি, দক্ষিণ ২৪ পরগনার ওই এলাকায় শাসক দল ভোট বন্ধ করতে সারা দিন সক্রিয় ছিল। এক সময় তারা বাধা পেতে উত্তেজনা তৈরি হয়, গুলি চলে। সুনির্দিষ্ট ভাবে কে গুলি চালিয়েছে, বলা মুশকিল। এর সঙ্গেই সূর্যবাবুর মন্তব্য, “যে দলের যে-ই মারা যান, সেটা বাঞ্ছনীয় নয়। শাসক দলের আক্রমণের বিরুদ্ধে কিছু প্রতিবাদ-প্রতিরোধ হচ্ছে। আক্রান্ত হলে কোনও না কোনও সময় মানুষ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে আত্মরক্ষার চেষ্টা করতে পারেন। যেটা আগে দেখাও গিয়েছে।”
নির্বিঘ্ন ভোটে বাধা দেওয়ার অভিযোগে পূর্বঘোষণা মতোই এ দিন উত্তর ২৪ পরগনার বিভিন্ন জায়গায় রেল ও রাস্তা অবরোধ করেছিল সিপিএম। শ্যামনগর ও ডানলপে গায়ের জোরে সেই অবরোধ তুলে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। শ্যামনগর ও ব্যারাকপুরে সিপিএমের দু’টি কার্যালয় ভেঙে দেওয়ারও অভিযোগ এসেছে। মুকুলবাবু অবশ্য বলেছেন, “বাংলার নিত্যযাত্রীদের অসুবিধা সৃষ্টি করা হয়েছিল। কিন্তু বাংলার জাগ্রত জনগণ সেই অবরোধ হটিয়ে দিয়েছে!”
কংগ্রেস কিন্তু দাঁড়িয়েছে সিপিএমের পাশেই। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্যের কথায়, “ভোটই দিতে না-পারলে অবরোধ তো হবেই! আগে তো কথায় কথায় দিদিমণি (মমতা) অবরোধ করতেন। সেই নীতিটাই এখন সিপিএম অনুসরণ করছে। ভালই!” তৃতীয় দফায় প্রায় ১৮০টি বুথ শাসক দল লুঠ করেছে বলে অভিযোগ করে প্রদীপবাবুর প্রশ্ন, “দু’বছরের মধ্যে এই সরকারের জনপ্রিয়তা এতই কমে গেল যে, রিগিং করে জিততে হবে!” কেন্দ্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার না-করে রাজ্য সরকার শাসক দলকে ভোট লুঠের সুযোগ করে দিয়েছে বলে অভিযোগ সব বিরোধী দলেরই। বিজেপি যেমন পুরো দ্বিতীয় ও তৃতীয় দফার ভোট ফের নতুন করে করার দাবি তুলেছে। দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক অসীম সরকারের অভিযোগ, “শাসক দল নির্বাচন কমিশন এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বিবৃতি দিচ্ছে বলেই সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ বাড়ছে। তৃতীয় দফার ভোটে হিংসার জন্য ওই সব বিবৃতিই দায়ী।” |