রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ঘিরে একাধিক অশান্তির হিংসার ঘটনা নিয়ে আজ প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন রাজ্যপাল এম কে নারায়ণন। রাজ্যপাল তাঁদের জানিয়েছেন, রাজ্যে সরকারের পরিবর্তন হলেও পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক হিংসার ইতিহাস বদলায়নি। তাঁর মতে, অবিলম্বে রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি হওয়া প্রয়োজন এবং তা করতে হবে রাজ্য সরকারকেই। রাজ্য তা করতে ব্যর্থ হলে নির্বাচন পরবর্তী সময়ে রাজ্যে আরও সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছাড়াও এ দিন রাষ্ট্রপতির সঙ্গেও দেখা করে রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন রাজ্যপাল।
আজ ছিল পঞ্চায়েতের তৃতীয় দফার নির্বাচন। আর এ দিনই দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকারের শীর্ষ কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন নারায়ণন। সেই হিসেবে এ দিনের বৈঠকটি ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। রাজ্যে প্রথম দফা নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ভাবে শেষ হলেও দ্বিতীয় দফা থেকে যে অশান্তি শুরু হয়েছে, তৃতীয় দফাতেও তা অব্যাহতই ছিল। তৃতীয় দফার ভোটে রাত পর্যন্ত পাঁচ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচনের নামে রাজ্যে যে ভাবে এলাকা দখলের রাজনীতি শুরু হয়েছে, তা নিয়ে কিছু দিন আগেই উদ্বেগ জানিয়েছিলেন মনমোহন। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় সূত্রের খবর, আজ নারায়ণনের সঙ্গে রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন মনমোহন। রাজ্যপাল জানান, দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সিপিএমের দেখানো পথেই হাঁটছে তৃণমূল।
রাজ্যপালের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে অবশ্য সরাসরি কোনও মন্তব্য করতে চাননি তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়। তিনি বলেন, “এটা অনেক বড় ব্যাপার। রাজ্যপাল কী বলেছেন, আগে জানি। যা বলার, পরে বলব।”
প্রাক্তন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবাণী থেকে বর্তমানের সুশীল শিন্দে সময় বদলালেও ডিজি সম্মেলনের রিপোর্ট বলছে, রাজনৈতিক সন্ত্রাসের নিরিখে বরাবরই সবথেকে
উপরে থেকেছে পশ্চিমবঙ্গ। রাজ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতার হাত বদল হলেও সেই ট্র্যাডিশনের কোনও বদল এ বারেও হয়নি বলেই কেন্দ্রকে রিপোর্টে জানিয়েছেন রাজ্যপাল। তাঁর মতে, পাঁচ দফার মধ্যে আজকের নির্বাচন ছিল প্রশাসনের কাছে সবথেকে বড় চ্যালেঞ্জ। অশান্তি রুখতে ছিল কেন্দ্রীয় বাহিনীও। কিন্তু তার পরেও আজ যে ভাবে হানাহানি হয়েছে, সে ব্যাপারে কেন্দ্রকে সবিস্তার জানিয়েছেন তিনি। তবে বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলতে চাননি রাজ্যপাল। তিনি শুধু বলেন, “আমার কাছে যা এসেছে, তা সংবাদমাধ্যমের খবর। সম্পূর্ণ রিপোর্ট আগে হাতে আসুক।” রাজ্যপালের মতে, মমতা একক প্রচেষ্টায় সিপিএমকে ক্ষমতা থেকে সরিয়েছেন। কিন্তু পঞ্চায়েত নির্বাচনকে ঘিরে যে এলাকা দখলের রাজনীতি শুরু হয়েছে, তা দ্রুত কড়া হাতে দমন করতে না পারলে ভোটের পরে নৈরাজ্য সৃষ্টি হতে পারে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক সূত্রের খবর, বিষয়টি নিয়ে শিন্দের কাছেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন রাজ্যপাল।
পঞ্চায়েত ভোটে গোলমাল হতে পারে, এই আশঙ্কায় ভোট পর্বের শুরু থেকেই কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করতে চেয়েছিল রাজ্য নির্বাচন কমিশন। কিন্তু তাতে তীব্র আপত্তি ছিল রাজ্যের। বিষয়টি নিয়ে দু’পক্ষের সংঘাত পৌঁছয় আদালতে। শেষ পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে রাজ্যে ভোটের জন্য কেন্দ্রীয় বাহিনী আসে। ওই বাহিনী থাকা সত্ত্বেও তাদের যে ভাবে কার্যত বসিয়ে রাখা হচ্ছে, তা নিয়ে আজ শিন্দের কাছে ক্ষোভ জানিয়েছেন নারায়ণন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সূত্র বলছে, কেন্দ্রীয় বাহিনী আসা সত্ত্বেও যে ভাবে সেই বাহিনীকে কার্যত অপ্রাসঙ্গিক করে রাখার অভিযোগ উঠেছে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে, তাতে ক্ষুব্ধ রাজ্যপাল। গতকালই সেই ক্ষোভের কথা জানিয়েছিলেন তিনি। আজ কার্যত সেই বক্তব্যেরই পুনরাবৃত্তি করে তিনি বলেন, “কেন্দ্রীয় বাহিনীর সুষ্ঠু ব্যবহার নিয়ে আমি আগেও বলেছি। এখনও তাই বলছি। আমি আশাবাদী যে, তাদের মোতায়েন করা হবে। ভোটার ও প্রার্থীদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা খুব দরকারি।” বিরোধীরা অবশ্য এ দিনও অভিযোগ করেন যে, রাজনৈতিক কারণেই কেন্দ্রীয় বাহিনীকে আজও সুষ্ঠু ভাবে ব্যবহার করা হয়নি।
শিন্দের সঙ্গে তাঁর কী নিয়ে আলোচনা হয়েছে, তা অবশ্য বিশদে বলতে চাননি রাজ্যপাল। তিনি কেবল বলেন, “রাজ্যপাল ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে কী নিয়ে আলোচনা হতে পারে, তা আপনারা ভালই জানেন।” দু’পক্ষের বৈঠকের আগেই রাজ্যপাল বলেছিলেন, “কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বিষয়ে কোনও ভূমিকাই নেই। যা করার রাজ্যকেই করতে হবে। কেন্দ্র উদার মনোভাব নিয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়েছে। কিন্তু শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব আমাদেরই।” |