পুস্তক পরিচয় ২...
পিতার বয়ানে দুই বিপ্লবী কন্যার কাহিনি
আজিজস নোটবুক/ অ্যাট দ্য হার্ট অব দি ইরানিয়ান রেভলিউশন, চৌরা মাকারেমি। ইয়োদা প্রেস, ২৫০.০০
তেত্রিশ বছর আগে আয়াতোল্লা খোমেইনির নেতৃত্বে পারস্যে এক বিপ্লব সংঘটিত হয়। মার্কিন তাঁবেদার রাজা শাহ রেজা পল্লভির ক্ষয়িষ্ণু স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি পেতে গণতন্ত্রকামী বিভিন্ন শক্তি গত শতকের ষাটের দশকেই যে আন্দোলন শুরু করে, খোমেইনির ইসলামি বিপ্লবে তা-ও শরিক হয়ে যায়। ১৯৬৫-তে প্রতিষ্ঠিত ‘জনগণের মুজাহিদিন’ (মুজাহিদিন-ই-খালক) ছিল এমনই এক সংগঠন। ইরানের শিক্ষিত মধ্যশ্রেণির ব্যাপক অংশ এতে শামিল হয়। খোমেইনির নেতৃত্বে ইসলামি প্রজাতান্ত্রিক দল যখন শাহ-বিরোধী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে কার্যত ছিনতাই করে ইরানকে গোঁড়া মোল্লাতন্ত্রের মধ্যযুগীয় ক্ষয়িষ্ণুতার দিকে নিয়ে যেতে উদ্যত, তখনই মুজাহিদিন ও অন্যান্য বাম-ঘেঁঁষা সংগঠন ও আন্দোলনের সঙ্গে তার সংঘাতের সূচনা। তা ক্রমে এমন অসহিষ্ণুতার পর্যায়ে পৌঁছয় যে, মুজাহিদদের ইসলামের শত্রু, মুনাফেক বা ভণ্ড মুসলিম, এমনকী মুরতাদ বা ধর্মদ্রোহী হিসাবেও শনাক্ত করে রাষ্ট্রযন্ত্র ও হেজবুল্লা মিলিশিয়াকে তাদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া হয়। নেমে আসে তীব্র দমন-পীড়ন।
আজিজের নোটবই তেমনই এক মুজাহিদ পরিবারের দুই কন্যার কারাবাস ও দণ্ডের ইতিবৃত্ত, আজিজ যাঁদের হতভাগ্য পিতা। চোখের সামনে প্রতি দিন তিনি দুই মেয়েকে নির্যাতিত হতে দেখেছেন। প্রতি দিন আশা করেছেন, এ বার বোধহয় প্রমাণাভাবে তাঁর নির্দোষ মেয়েরা ছাড়া পেয়ে যাবে। তার পরই গভীর হতাশা আর অবসাদে ডুবে গিয়েছেন। তাঁর এক মেয়ে ফাতানে-কে যখন মোল্লাতন্ত্রের জল্লাদরা বন্দর-আব্বাসে গুলি করে হত্যা করে, তখন সে আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা। অন্য মেয়ে ফতিমা যখন সাড়ে সাত বছর নিঃসঙ্গতা ও নির্যাতন সহ্য করার পর মুক্তিসম্ভাবনার কিনারায় এসে মৃত্যুদণ্ড পায়, তখন তার ছেলের বয়স ১১, মেয়ের ৮। সেই মেয়ে চৌরা মাকারেমি বড় হয়ে দাদু আজিজের নোটবইটা হাতে পায়। আজিজ লেখক নন, কিন্তু একজন সংবেদনশীল, স্নেহময় পিতা, যিনি অসহায় ভাবে মৃত্যুপথযাত্রী আত্মজাদের যন্ত্রণা, আবেগ, দুঃখ ও অবসাদের শরিক হয়েছেন আর অপটু দিনলিপির বয়ানে তা লিপিবদ্ধ করেছেন। তাঁর প্রশ্নকাতর মনে যা বারবার অনুরণিত হয়েছে, অনূদিত নোটবইয়ের বয়ান তাকে বিশ্বজনীনতা দিয়েছে। আয়াতোল্লা খোমেইনির মতো সর্বশক্তিমান ঈশ্বরপ্রতিম ধর্মগুরু (যাঁকে শিয়া ইসলামের দ্বাদশ ইমাম ‘মাহ্দি’র অবতার বলেই গণ্য করা হচ্ছিল) কেন ফতিমা ও ফাতানের মতো দুই অবলা গৃহবধূকে ভয় পাচ্ছেন? এমন নিরীহ, নিরস্ত্র মহিলারা কি ইসলামি বিপ্লবের অন্তর্ঘাতক হতে পারেন? কী অপরাধ করেছে ফতিমার শিশু পুত্রকন্যারা যে শৈশবেই তাদের মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হতে হল? যে শোষণমুক্তির স্বপ্নকাজল চোখে নিয়ে ইরানি জনগণ শাহ-র স্বৈরতন্ত্রকে উৎখাত করলেন, মোল্লাতন্ত্র তো তার চেয়ে উৎকৃষ্ট সমাজ দিল না! ব্যক্তিস্বাধীনতা, ইচ্ছার স্বাধীনতা, চিন্তা, মনন, সংস্কৃতির স্বাধীনতা তো অধরাই রয়ে গেল! সাম্য বা সৌভ্রাতৃত্বের ইসলামি আদর্শই বা বাস্তবায়িত হল কোথায়?
আজিজ নিজে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক ব্যক্তি, স্নেহার্দ্র পিতাও। তাই হয়তো খোমেইনির ইরানে তাঁর মেয়েদের ‘মুজাহিদিন’ হওয়ার রাজনৈতিক তাৎপর্য তাঁর চেতনায় সম্যক ধরা পড়েনি। ‘জনগণের মুজাহিদিন’ সংগঠনটির শুরু থেকেই কিন্তু হিংসাত্মক ও সন্ত্রাসবাদী কাজের দিকে দুর্মর ঝোঁক ছিল। ’৭১-এই বোমা বিস্ফোরণ, বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টার মধ্য দিয়ে তাদের এই প্রবণতা স্পষ্ট হয়। শাহ-র সিক্রেট পুলিশ ‘সাভাক’ ৭৫ জন মুজাহিদিন সদস্যকে খতম করে, হাজার-হাজার কর্মী-সমর্থককে জেলে পোরে। ১৯৭৮-’৭৯-তে— ইমাম খোমেইনির ইরানে পদার্পণের ঠিক আগে— গণ-বন্দিমুক্তির সরকারি সিদ্ধান্তে তারা ছাড়া পায়। ইসলামি বিপ্লবে যোগদানও করে। কিন্তু অচিরেই ইসলামপন্থীদের সঙ্গে তাদের বিরোধ শুরু হয়। ‘আরব বসন্ত’র পর গণতন্ত্রকামী শক্তিগুলির সঙ্গে একজোটে স্বৈরশাসনের অবসান চাওয়া ইসলামপন্থীরা যেমন ক্রমে গণতন্ত্রীদের কোণঠাসা করে নিজেরা ক্ষমতা কুক্ষিগত করছে, কতকটা সেই ধাঁচেই দ্বন্দ্ব মোড় নিতে থাকে। খোমেইনি নিজে মুজাহিদ তত্ত্ববিশ্বকে ‘পল্লবগ্রাহী’ আখ্যা দেন। তাদের ‘অবিশ্বাসী’ ও ‘কাফের’ বলেও চিহ্নিত করা হয়। এর পর তাঁর মিলিশিয়া হেজবুল্লার পক্ষে মুজাহিদিন সভায়, বইয়ের দোকানে হামলা করতে কোনও অসুবিধা থাকে না। আক্রমণের লক্ষ্য হয় বামপন্থীরাও। অতঃপর মোল্লারাই হয়ে ওঠে মুজাহিদদের প্রত্যাঘাতের লক্ষ্য। সাদ্দাম হুসেনের ইরান আক্রমণের সময় মোল্লাতন্ত্র যখন জাতীয় নিরাপত্তা নিয়ে ব্যস্ত, সেই সুযোগে মুজাহিদিন আরও নাশকতা চালায়। মোল্লারা যে সর্বদা খুব নিরীহ লোকদের জেলে পুরছিল, এমন মনে করার কারণ নেই। পরে এই মুজাহিদরাই সাদ্দাম হুসেনের সঙ্গে যোগ দিয়ে ইরানি সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়াই করে, ইরাকে সাদ্দামের নিরাপত্তার ছায়ায় বসে ইরানের ‘জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ সঞ্চালন করে। জাতির শত্রু সাদ্দামের সহযোগী হওয়ার ফলে স্বদেশে তাদের জনপ্রিয়তা ও গণভিত্তিও দ্রুত ক্ষয় পায়। ইরাকে, ফ্রান্সে, ইয়োরোপে এই মুজাহিদরা এখনও সমান্তরাল নির্বাসিত ইরানি সরকার চালায়।
আজিজ জারেই-এর ব্যক্তিগত বেদনা ও হতাশার প্রতি যথোচিত সম্মান জ্ঞাপন করেও তাই বলা যায়, তাঁর যে দুই মেয়ে মুজাহিদিন প্রার্থী হিসাবে খোমেইনির ইরানে জনপ্রতিনিধিত্ব অর্জন করতে চেয়েছিল, তারা রাজনৈতিক ভাবে খুব নিরীহ ছিল না। আজিজ এ কথা না বুঝলেও তাঁর দৌহিত্রী চৌরা মাকারেমি বিলক্ষণ তা বুঝতেন। অথচ তাঁর সংযোজিত লেখনীতেও প্রসঙ্গটি রহস্যজনক ভাবে অনুল্লেখিত। তবে তা কোনও ভাবেই তাঁর মা ও মাসির উপর নেমে আসা রাষ্ট্রীয় নিপীড়নকে বৈধতা দেয় না।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.